লা-সাযহাবী ভাইদের অনেকেই শরীয়তের প্রমাণাদির পরিপন্হী এই বেদআতের প্রচলন করার জন্য নিন্মেক্ত অমূলক কথাগুলোর আশ্রয় নিয়ে থাকে।
ক. তারা দাবী করে থাকে যে, আট রাকাআত তারাবীর হাদীস সহীহ বুখারীতে আছে। অথচ সহীহ বুখারীর হাদীসটি তাহাজ্জুদের ব্যাপারে, তারাবীর ব্যাপারে নয়। নিচে হাদীসটি দেওয়া হলো:
“আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান (রহ:) থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত আয়েশা (রা:)কে জিজ্ঞেস করেন, রমযান মাসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায কেমন হত? হযরত আয়েশা (রা) বলেন, তিনি রমযানে ও রমযানের বাইরে এগারো রাকাআতের অধিক পড়তেন না। চার রাকাআত পড়তেন, এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতার কথা তোমাকে কী বলব ! এরপর চার রাকাআত পড়তেন, যারদীর্ঘতা ও সৌন্দর্য হত অতুলনীয়। এরপর তিন রাকাআত পড়তেন।”
— সহীহ বুখারী, হাদীস নং২০১৩,১১৪৭,৩৫৬৯, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং৩৭৩/১২৫
নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, উপরোক্ত হাদীসে ঐ নামাযের কথা উল্লেখিত হয়েছে, যা রমযান ও অণ্যাণ্য মাস তথা সারা বছর আদায় করা হয়। বলাবাহুল্য যে, তা হল তাহাজ্জুদের নামায। অতএব তাহাজ্জুদের নামাযের ব্যাপারে আম্মাজান হযরত আয়েশা (রা) বলেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার রাকাআত করে আট রাকাআত পড়তেন। এরপর বিতর পড়তেন।
হাদীসের উদ্দেশ্য হল, সাধারণভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাহাজ্জুদের নামাজ আট রাকাআত পড়তেন। হাদীসের অর্থ এই নয় যে, নবীজী সর্বদাই তাহাজ্জুদের নামাজ আট রাকাআত পড়তেন। কেননা আম্মাজান হযরত আয়েশা (রা) থেকে সহীহ বুখারীর অপর বর্ণনায় এসছে, রাসুললুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামুল লােইল তথা তাহাজ্জুদের নামায তের রাকাআত পড়তেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৬৪, ফাতহুল বারী:৩/২৬, কিতাবুত তাহাজ্জুদ, বাব-১০
বিভিন্ন সহীহ হাদীসের আলোকে এ কথাও প্রমাণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাতের নামায (ইশার দু রাকাআত সুন্নত ও বিতর ছাড়াই) কখনো কখনো ১৪বা ১৬ রাকাআতও হত। বরং কোন কোন বর্ণনা থেকে ১৮ রাকাআতের কথাও বুঝে আসে। (নাইলুর আওতার: ৩/২১-২২, হাদীস ৮৯৭; আত-তারাবীহ আকসারু মিন আলফি আমিন ফিল মাসজিদিন নাবিয়্যি: ২১-২৩)
বুঝা গেল,তারাবীহ তো দুরের কথা খোদ ’কিয়ামুল লাইল’-এর ব্যাপারেও এ কথা বলা ঠিক নয় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতর ব্যতীত সর্বদা আট রাকাআত পড়তেন।
খ. তাদের কেউ কেউ বলে থাকে যে, আট রাকাআত তারবীর হাদীস হযরত জাবের (রা:) এর বর্ণনায় ইবনে হিব্বান ও অন্যান্য হাদীসগ্রন্হে রয়েছে, যা একটি সহীহ হাদীস।
বাস্তব কথা হল, হাদীসটি সহীহ নয় বরং তা যয়ীফ হওয়ার পাশাপাশি মুনকারও বটে। অর্থাৎ তা যয়ীফের মধ্যেও নিম্নমানের। হাদীসটির বর্ণনাকারীদের মধ্যে রয়েছে ‘ইয়াকুব আলকুম্মী’; এ একজন শিয়া। অপর একজন হল ‘ইসা ইবনে জারিয়া’; যার ব্যাপারে রিজালশাস্ত্রের ইমামদের মন্তব্য হল, সে ‘মাতরূক’ ও ‘মুনকারুল হাদীস’। ইমাম আবু দাউদ (রহ), ইমাম নাসায়ী (রহ) প্রমুখ একথা বলেছেন। অর্থাৎ তার বর্ণনা ‘প্রমাণ প্রদানের ক্ষেত্রে তো নয়ই, ‘সমর্থন’ হিসেবেও উদ্ধৃত করা চলে না। কেননা তার ব্যাপারে আপত্তিজনক কথাবার্তা হাদীস হিসেবে বর্ণনা করার অভিযোগ রয়েছে।
দ্রষ্টব্য: তাহযীবুল বামাল: ১৪/৫৩৩-৫৩৪, তাহযীবুত তাহযীর: ৮/২০৭; আল-কামেল, ইবনে আদী: ৬/৪৩৬-৪৩৮
ইমাম ইবনে আদী (রহ) ঈসা ইবনে জারিয়ার আলোচনায় এই হাদীস উল্লেখ করে স্পষ্ট বলেছেন, হাদীসটি ‘মাহফুয নয়’। এ শব্দ (,াহফুয নয়) দ্বারা ইমাম ইবনে আদী (রহ)-এর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে যে, সংশ্লিষ্ট হাদীসটি মওযূ বা মুনকার। অর্থাৎ তা দ্বারা প্রশাণ দেয়ার প্রশ্নই আসে না।
তাছাড়া এই মুনকার বর্ণনাটির মধ্যেও স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, তা শুধু এক রাতের ঘটনা ছিল। (কিয়ামুল লাইল, ইবনে নাসর:১৯৭
গ. কেউ কেউ এ সম্পর্কে হযরত উবাই (রা) এর প্রতি সম্বন্ধকৃত একটি ঘটনারও উল্লেখ করে থাকেন, যাতে আট রাকাআতের কথা উল্লেখ রয়েছে। অথচ এ কথাই নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত নয় যে, তা রমযান মাসের ঘটনা. নাকি অন্য মাসের। যদি রমযান মাসের হয়ে থাকে তাহলে তা তাহাজ্জুদের ঘটনা, নাকি তারাবীর। তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হলো যে, এ বর্ণনাটিও সেই ’ঈসা ইবনে জারিযা ‘ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে; যাকে বিজ্ঞ মুহাদ্দেসীনে কেরাম ‘মাতরূক’ ও ’মুনকারুল হাদীস’ আখ্যা দিয়েছেন। (রাকাআতে তারাবীহ, মুহাদ্দেস হাবীবুর রহমান আযমী:৩৬-৩৭)
ঘ. কেউ কেউ নিরূপায় হয়ে এই বলে বসেছে যে, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই নামাযের দুই নাম। তাই তাহাজ্জুদ যখন আট রাকাত তারাবীও আট রাকাত।
এই কেীশলটি লা-মাযহাবীদের সবচেয়ে বড় কেীশল। এর ভিত্তিতেই তারা তাহাজ্জুদের হাদীসসমূহকে তারাবীর ব্যাপারে প্রয়োগ করে। অথচ এটি একটি ভ্রান্ত ও দলীলবিহীন কথা।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, তাহাজ্জুদ সারা বছরের নামায আর তারাবীহ রমযান মাসের বিশেষ নামায। তাহাজ্জুদের নামায রমযানের রোযা ফরজ হওয়ারও আগে কেুরআনের আদেশক্রমে শুরু হয়েছে। অথচ তারাবীর সূচনা হয়েছে অনেক পরে; রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পর হাদীসের মাধ্যমে।
মোটকথা তারবী ও তাহাজ্জুদ ভিন্ন ভিন্ন্ নামায। এ দুটিকে এক মনে করা বা এক বলা মারাত্নক ভ্রান্তি।
যদি কোন লা-মাযহাবী আলেম কুরআনের কোন আয়াত বা কোন ‘সহীহ’ সরীহ (স্পষ্ট) হাদীস দ্বারা প্রমাণ করতে পারেন যে, তারাবীহ এবং তাহাজ্জুদ একই নামাযের দুই নাম; তবে তাকে তার কাঙ্খিত পুরস্কার প্রদান করা হবে।
ঙ. কেউ কেউ ইনসাফের মূলেকুঠারাঘাত করে হল আরেকটি মুনকার বর্ণনা দ্বারাই প্রমাণ দিয়ে বসেছে। বর্ণনাটি হল, মুহাম্মদ ইবনে ইউসুফ সায়েব ইবনে ইয়াযীদের উদ্বৃতিতে বলেছেন যে, হযরত উমার (রা) উবাই ইবনে কা’ব (রা) ও তামীম দারী (রা) কে এগারো রাকাআত পড়ানোর আদেশ করেছেন।
এ বর্ণনাটি সূত্র ও আনুষঙ্গিক বিচারে মুনকার হওয়া ছাড়াও এ কথা তো সবাই জানেন যে, হযরত উমার (রা) এর যুগে যখন তারাবীর নামায বড় জামাআতে এক ইমামের পিছনে পড়ার নিয়ম চালু হয়; তখন সকলে এক ইমামের পিছনে ২০রাকাত তারাবীহ পড়তেন এবং এ ব্যপারে কারো কোন দ্বিধাদ্বন্দ্বও ছিল না।
ইমাম ইবনে আব্দুল বার (রহ) প্রমুখ মহাদ্দিসগণ অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, বর্ণনাকারী ভূলক্রমে বিশ রাকাআতের স্হলে এগারো রাকাআতের কথা উল্লেখ করেছেন।
তার এই ভ্রান্তির একটি প্রমাণ হল,সায়েব ইবনে ইয়যিীদ থেকে অপর বর্ণনাকারী ইয়াযীদ ইবনে খুসাইফা বর্ণনাটি সঠিকভাবে মনে রেখেছেন। তার বর্ণনায় বিশ রাকাআতের কথা উল্লেখিত হয়েছে; এগারো রাকাআত নয়।
(আল-ইস্তিযকার শরহুল মুআত্তা, ইবনে আব্দুল বার: ৫/১৫৪; রাকাআতে তারাবীহ, মুহাদ্দিস হাবীবুর রহমান আযমী: ৩৭-৫৬)
এইখানে একটি বিষয় লক্ষনীয় যে, সায়েব ইবনে ইয়াযীদের এই বর্ণনার সমর্থনে ইম্মাহর অবিচ্ছিন্ন কর্শধারা ছাড়াও আনো ৫টি হাদীষ রয়েছে; যাতে এই বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে যে, হযরত উমর (রা) এর যুগে তারাবীর নামায বিশ রাকাআতই পড়া হত।
(দ্রষ্টব্য: মুআত্তা ইমাম মালেক: ৪০; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ২/২৮৫, ২৮৬; মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক: ৪/২২৬, হাদীস নং ৭৭৩৩; সুনানে কবরা (বায়হাকী) : /৪৯৬,৪৯৭; সৌদি আরবের কেন্দ্রীয় দারুল ইফতার সাবেক গবেষক শাইখ ইসমাঈল ইবনে মুহাম্মদ আনসারী রচিত তাসহীহু হাদীসি সালাতিত তারাবীহ ইশরীনা রাকাআতান ওয়ররুদ্দু আলাল আলবানী ফী তাযঈফিহী’ ১১-২৭)
এ বিষয়ে অন্যাণ্য লিখা সমূহ:
তারাবীর নামায কি ৮ রাকাত? এ বেদআতের সূচনা কবে?