মাকে সন্তষ্ট কর, দুনিয়া-আখেরাতের কোথাও তুমি আটকাবে না

আজ তোমাদেরকে শুধু একটি কথা বলার জন্য একত্র করেছি। এই সফরে হারামে নববীতে বসে আমার বন্ধু মাওলানা ইয়াহইয়াকে বললাম, ‘এখন আমি কী ভাবছি জানো? আমি ভাবছি, কীভাবে আমার ছেলেদেরকে বোঝাতে পারি যে, মায়ের দোয়ার ফযীলত কী; মায়ের দোয়া থাকলে কী হয় আর দোয়া না থাকলে কী হয়। আমি জানি না, কীভাবে বললে, কোন ভাষায় বললে আমার ছেলেরা বুঝতে পারবে এবং মায়ের জন্য জান কোরবান করবে। ওরা যদি বলে যে, আপনার কলিজাটা বের করে দেন, আমরা ওটা চিবিয়ে খাব, তারপর বুঝব, তাহলে আমি আনন্দের সাথে আমার কলিজাটা বের করে টুকরো টুকরো করে সবাইকে খাইয়ে দিব।’ এর অর্থ এই নয় যে, আমি খুব বুঝে গিয়েছি। তবে এতটুকু বুঝেছি যে, মা ছাড়া সন্তানের কোনো গতি নেই। মা যেমনই হোক মায়ের দোয়া যারা পাবে জীবনে তাদের কোনো ভয় নেই। মানুষ তো মূল্যবান সম্পদ অনেক পয়সা খরচ করে অর্জন করে। আমরা সবাই যেন মায়ের সন্তুষ্টিকে মূল্যবান সম্পদ মনে করি এবং যেকোনো মূল্যে তা অর্জন করার চেষ্টা করি।
এই হজ্বের সফরে আল্লাহর কাছ থেকে যা কিছু পেয়েছি, তা সবই আমার মায়ের দোয়ার বরকত। এটা আমাকে আল্লাহ তাআলা হাতে ধরে ধরে বুঝিয়ে দিয়েছেন। সফরে একজন আমাকে বলল, ‘আপনি শুধু মায়ের কথা বলছেন, বাবার কথা কেন বলছেন না?’
বললাম, ‘ভাই! আমি কী করব? আমার আল্লাহই শুধু মায়ের কথা বলেছেন’- ووصينا الانسان بوالديه احسانا حملته امه كرها ووضعه كرها
‘মা-বাবার প্রতি সদাচরণ কর কারণ মা কষ্ট করে তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছেন …।’

দেখুন, মা-বাবা দু’জনের সাথেই সদাচরণের আদেশ করেছেন এরপর আর বাবার কথা নেই, আছে শুধু মায়ের কথা। এর দ্বারা বোঝা যায়, বাবা যা কিছু পাচ্ছেন মায়ের সঙ্গে থাকার কারণে পাচ্ছেন। যেহেতু তিনি মাকে অর্থ দিয়ে, শক্তি দিয়ে সাহায্য করেছেন তাই তিনি কিছু পাচ্ছেন। সুতরাং আমার বাবা যদি আমার মায়ের সাথে ভালো আচরণ না করেন তাহলে তিনি আমার মুহাব্বত পাবেন না। তবে রক্তের হক আছে তাই বেআদবী করব না, আদব রক্ষা করব এবং কোরআন যে আনুগত্যের কথা বলেছে সে আনুগত্য করব। কিন্তু মুহাব্বত আর করব না। আমার মুহাব্বত পেতে হলে আমার বাবাকে আমার মায়ের মাধ্যমে আসতে হবে। এই কথাটা আমি নিজেকেও বলছি। আমি যদি আমার সন্তানের মুহাব্বত পেতে চাই তাহলে তার মায়ের সাথে আমাকে ভালো ব্যবহার করতে হবে। তোমরা যদি মায়ের মর্যাদা বুঝতে পার তাহলে আমি আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে নিশ্চয়তার সাথে বলতে পারি যে, দুনিয়াতে এবং আখেরাতে কোনোখানে ইনশাআল্লাহ তোমরা আটকাবে না।

মাদরাসাতুল মদীনার সাথে যদি তোমাদের সম্পর্ক থাকে তাহলে শোন! তোমরা মাদরাসাতুল মদীনার তালিবুল ইলম তখনই হতে পারবে যখন তোমরা মায়ের অনুগত হবে এবং তোমার মা তোমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকবেন।
এবার সফরের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। আম্মাকে বললাম, আম্মা! আমি কী নিয়ে আল্লাহর ঘরে যাব? আমার ভিতর তো একেবারে খালি।
আম্মা বললেন, ‘আল্লায় দিব।’
মায়ের এই দোয়াটা নিয়ে আমি আল্লাহর ঘরে গিয়েছি। আল্লাহ এত দিয়েছেন যে, আমি আল্লাহর প্রতি খুশি হয়ে গিয়েছি। আল্লাহ পদে পদে এত দয়া, এত মায়া, এত মুহাব্বতের আচরণ করেছেন যে, ঐ হাদীসটি বার বার মনে পড়েছে-‘মায়ের চেয়েও আল্লাহর মুহাব্বত বেশি।’ ওখান থেকেই আমার নিয়তে এসেছে, আমি গিয়েই আমার ছেলেদেরকে জমা করব এবং মায়ের দোয়া দিয়ে কী পাওয়া যায় তা বলব। এটা যদি আমার ছেলেদেরকে না বলি তাহলে আর কাদেরকে বলব? আমার ছেলেদের চেয়ে প্রিয় আমার আর কে আছে? এবারের এ আয়োজনটাও (সবাইকে খেজুর ও যমযম পান করানো) মায়ের দোয়ার বরকত। মাদরাসাতুল মদীনায় তোমাদের কিছু পাওয়ার দরকার নেই। সবাই মাকে খুশি রাখ। মা যদি না পড়লে খুশি হন পড়ো না, আর পড়লে খুশি হলে পড়। মূল উদ্দেশ্য হল, মাকে খুশি করা। আর মাকে কেন খুশি করবে? আল্লাহ বলেছেন তাই। মায়ের খেদমত করা, মাকে খুশি রাখা অর্থাৎ খিদমাতুল ওয়ালিদাইন ও ইহসান ইলাল ওয়ালিদাইন হল মাদরাসাতুল মদীনার নেসাব। এটায় যে পাশ করল সে মাদরাসাতুল মদীনা থেকে পাশ করে গেল। আর এই নেসাবে যে পাশ করল না সে মাদরাসাতুল মদীনার ছাত্র পরিচয় দেওয়ার-আমি মনে করি-অধিকার রাখে না। আল্লাহ যেন আমার সকল ছেলেকে, এখন যারা আছে তাদেরকে, পিছনে যারা ছিল তাদেরকে, এবং সামনে যারা আসবে তাদেরকে মায়ের খেদমত করার এবং মাকে খুশি করার তাওফীক দান করেন।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছেলেকে বাঁচানোর জন্য মায়ের মমতাকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন। মৃত্যুর সময় মুখে কালিমা জারি হচ্ছিল না। তখন তিনি বললেন, এ ব্যক্তি হয়তো মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে তাই কালিমা জারি হচ্ছে না। ওর মাকে নিয়ে আস। মাকে বললেন, তুমি তোমার ছেলেকে মাফ করে দাও।
মা বললেন, না আমাকে ও অনেক কষ্ট দিয়েছে, আমি ওকে মাফ করব না।
মাফ করবে না? আচ্ছা এক কাজ কর, লাকড়ি জোগাড় করে আগুন জ্বাল। এরপর ছেলেটাকে আগুনে ফেলে দাও।
তখন মা বলে কি, আল্লাহ! আল্লাহ! এটা করবেন না! এটা করবেন না! আমি মাফ করে দিলাম। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার সন্তান দুনিয়ার আগুনে জ্বলুক-এটা সইতে পারছ না, কিন্তু তোমার বদ দোয়ার কারণে সে যখন জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে তখন সহ্য করবে কীভাবে?

তো তিনি মায়ের মমতাকে জাগ্রত করে সন্তানকে রক্ষা করেছেন। প্রত্যেক হজ্বের সফরে আমি সঙ্গীদেরকে বলার চেষ্টা করি যে, ‘হজ্ব করতে এসেছেন তো হজ্ব থেকে ফায়দা হাসিল করারও চেষ্টা করুন। হজ্ব থেকে ফায়দা হাসিল করতে হলে আপনার সাথে যে কয়জন নারীর সম্পর্ক আছে তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। আপনার সাথে মায়ের সম্পর্ক আছে, বোনের সম্পর্ক আছে, মেয়ের সম্পর্ক আছে, স্ত্রীর সম্পর্ক আছে। তাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করলে আপনি হজ্বের ফায়দা পাবেন, হজ্বের বরকত পাবেন।’
দেখ, আল্লাহ তাআলাও আমাদেরকে যমযম দান করার জন্য হাজেরা আ.-এর মাতৃত্বকে অসীলা বানিয়েছেন। তাঁর তড়প ও বে চায়নী না হলে যমযম আসত না। অনেক বছর আগে একটা গজল শুনেছিলাম-‘যমযম ক্যায়্যা হ্যায়, এক মা কি তড়প।’ ‘যমযমের হাকীকত কী? শুধু একজন মায়ের ব্যাকুলতা।’ যখনই যমযমের একটা ঢোক পান করি তখনই আমার মনে হয় আমি যেন মাতৃত্বের দান গ্রহণ করছি। সাফা ও মারওয়ার যে সাঈ এটা তো আসলে মায়ের তড়প। বলতে গেলে পুরো হজ্বটাই নারী সমাজের একটা অবদান পুরুষ সমাজের উপর।

মোটকথা, মায়ের প্রতি, বোনের প্রতি, স্ত্রীর প্রতি, কন্যার প্রতি এবং নারী সমাজের প্রতি সদয় হওয়া হজ্বের শিক্ষা।

মদীনায় পৌঁছে ভিতরটা খুব অন্ধকার মনে হল। যিয়ারতে যাওয়ার সাহস হচ্ছিল না। সবাই গেলেন, কিন্তু আমি যেতে পারলাম না। হারামে নববীতে শুয়ে আছি, হঠাৎ শেষ রাত্রে মনে হল, আল্লাহ আমাকে ডাক দিয়েছেন, মিয়া! তোমার না মা আছে। তুমি এত চিন্তা করছ কেন? তোমার মায়ের থেকে দোয়া নাও। মায়ের থেকে দোয়া নিলেই আমি তোমার রাস্তা খুলে দিব। মনে হল, আমি এই সম্বোধনটা আমার আল্লাহর কাছ থেকে শুনতে পেলাম। আসমানের দিকে তাকিয়ে বললাম, আল্লাহ! তোমার শোকর, তুমি দিলের মধ্যে ঢেলে দিয়েছ। তোমার সম্বোধন আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার শোকর। আমি তো কোনো সফরের মধ্যে মায়ের সাথে ফোনে কথা বলিনি, কিন্তু তুমি দিলে ঢেলে দিয়েছ তাই আমি মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলব। মায়ের কাছ থেকে দোয়া নিব। এরপর কিন্তু তুমি আর আমাকে না দিয়ে পারবে না।
এরপর ফোন করে মায়ের সাথে কথা বললাম, আম্মা! আমার অবস্থা খুব খারাপ। আমি সাহস পাচ্ছি না আল্লাহর নবীর সামনে যেতে। আপনিও তো সালাম পেশ করার দায়িত্ব দিয়েছেন কিন্তু আমি তো যেতে সাহস পাচ্ছি না। আপনি আমার জন্য দোয়া করেন। আমি এখন রওনা দেব। মা বললেন, ‘আচ্ছা।’ একটিমাত্র শব্দ। আমার মনে হল, ঠাণ্ডা পানি পান করলে যেমন গলা-বুক শীতল করে পানিটা নেমে যায়, তেমনি আচ্ছা শব্দের শীতলতাও আমার প্রতিটি শিরায় উপশিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। সমগ্র সত্তাকে শীতল ও স্নিগ্ধ করে দিল একটি শব্দ। আমি অনুভব করলাম, আচ্ছা শব্দের আলোটা আমার ভেতর প্রবেশ করছে আর আমার অন্ধকারগুলি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। আমার সর্বসত্ত্বা পূর্ণ আলোকিত হয়ে গেল মায়ের একটি ‘আচ্ছা’ শব্দ দ্বারা। একজন প্রশিক্ষিত সৈনিক যেমন অস্ত্র হাতে পেলে নির্ভীক হয়ে যায় আমি তেমনি ‘আচ্ছা’ শব্দের অস্ত্রটা পেয়ে নির্ভীক হয়ে গেলাম। আমি রওয়ানা দিলাম। এত তৃপ্তি! এত শা্ন্তি! গিয়ে যখন দাঁড়ালাম মনে হল, আমি যেন দুনিয়ার সবচেয়ে আপন জায়গায় এবং সবচে প্রিয় জায়গায় এসে পড়েছি। জীবনে এমন সুন্দর সালাম মনে হয় আর কখনো পেশ করার তাওফীক হয়নি। আমি আল্লাহকে বললাম, আল্লাহ! আমি মায়ের দোয়া নিয়ে এসেছি। এখন তুমি আমাকে খালি হাতে কীভাবে ফিরিয়ে দিবে! খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে চাইলে তো তুমি মায়ের কথাটা মনে করিয়ে দিতে না। তো আলহামদুলিল্লাহ, ঐ দুরুদ ও সালামের বরকত খুব অনুভব করেছি। তখনই মনে হয়েছে যে, আমার সন্তানদেরকে এটা বোঝাতে হবে। দেখ, আল্লাহ কেমন ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। মায়ের দিকে মুহাব্বতের নযরে তাকালে তুমি মাকবুল হজ্বের সওয়াব পাবে। কিন্তু মানুষের তো ঐ হজ্বের দরকার নেই, তাদের শুধু দরকার দুই লাখ তিন লাখ টাকা খরচ করে এই হজ্ব করা! তোমরা মায়ের হয়ে যাও। মায়ের হয়ে গেলে আল্লাহর হয়ে যাবে। আর আল্লাহর হয়ে গেলে আল্লাহও তোমাদের হয়ে যাবেন। মাকে কখনো কষ্ট দিয়ো না। যে মায়ের অবস্থা এমন যে, সন্তান অসুস্থ হলে তাঁর আর কোনো অসুস্থতা থাকে না, নিজের সকল অসুস্থতার কথা ভুলে যান সন্তানের চিন্তায়-সেই মাকে মানুষ কীভাবে কষ্ট দেয়! আমি অনেক সময় অনেকের জন্য দোয়া করি যে, আল্লাহ তাআলা যেন তোমার প্রতি তোমার মায়ের মুহাব্বত কমিয়ে দেন। কারণ মায়ের অন্তরে যদি তোমার প্রতি বেশি মুহাব্বত থাকে তাহলে জ্বলনও বেশি হবে। আর তুমি যেহেতু তার মুহাব্বতের মর্যাদা রক্ষা করছ না সুতরাং জ্বলনটা যত বেশি হবে তোমার পক্ষ থেকে অমর্যাদাও তত বেশি হবে। ফলে তুমি ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকবে। তারচে তোমার প্রতি যদি তোমার মায়ের মুহাব্বতটা কমে যায় তাহলে জ্বলনটাও কমে যাবে। ফলে তুমি একটু রক্ষা পাবে। কিংবা আল্লাহ যেন তোমাকে মুহাব্বতের মর্যাদা রক্ষা করার তাওফীক দান করেন। যাই হোক, তোমরা যদি বাঁচতে চাও তাহলে মায়ের বিষয়টা খেয়াল রাখার চেষ্টা কর। এটা আমাদের জন্য একটা বিরাট রাস্তা। এই রাস্তায় আমাদের বড় বড় সৌভাগ্য আসতে পারে। আবার এটা আমাদের বরবাদিরও কারণ হতে পারে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- هما جنتك أو نارك মা-বাবা হল তোমার জান্নাত কিংবা জাহান্নাম
অর্থাৎ মা-বাবার মর্যাদা রক্ষা করে কেউ জান্নাতে যাবে আবার মা-বাবার অমর্যাদা করে কেউ জাহান্নামে যাবে। আর আল্লাহ তাআলা তো মুশরিক মা-বাবার সঙ্গেও সদাচরণ করার আদেশ দিয়েছেন। এই পৃথিবীতে তোমাকে নিয়ে ভাববার কেউ নেই। এমনকি বাবাও তোমাকে নিয়ে তেমন ভাবেন না যেমন ভাবেন তোমার মা। ঘরে ভালো কিছু রান্না হলে তুমি নেই তাই নিজেও খেতে পারেন না। এমন মাকে ভালবাসবে না, সম্মান করবে না তো কাকে করবে! মাকে ভালবাসলে, মাকে সম্মান করলে নিজেই লাভবান হবে। লেখাপড়া শিখতে মেধা লাগে, শ্রম লাগে, অনেক কিছু লাগে, কিন্তু মাকে ভালবাসতে, মাকে সম্মান করতে, মাকে খুশি করতে কিছুই লাগে না। তো বাবারা! মাকে ভালবাস, মাকে সম্মান কর, মাকে সন্তুষ্ট কর এবং মায়ের দোয়া হাসিল কর। তাহলে দেখবে দুনিয়া ও আখেরাতের কোথাও তুমি আটকাবে না। তোমার সন্তান হবে মর্যাদার শীর্ষে। আল্লাহ সকলকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published.