স্ত্রীর তালীম-তরবিয়তে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব

মধ্যপন্থার লংঘন যে সকল ক্ষেত্রে ভয়াবহ, স্ত্রীর তালীম-তরবিয়তের বিষয়টিও তার অন্যতম। দাম্পত্য শান্তি, স্বামীর মানসিক প্রশান্তি, আদর্শ পরিবার তথা বিবাহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপেই নির্ভর করে দম্পতির দ্বীনদারীর উপর। পরিবারের কর্তা হিসেবে স্বামীরই কর্তব্য নিজের দ্বীনচর্চার সাথে সাথে স্ত্রীও যাতে দ্বীন ও ঈমান দ্বারা চালিত হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা। পূর্ণাঙ্গ ইসলামী জীবন-যাপনে পারস্পরিক সাহায্য-সহযোগিতা তো মানব-জীবনের সকল অংগনেই জরুরী, যে কারণে কুরআন মাজীদের নির্দেশ-

وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى

(তোমরা পুণ্যের কাজ ও তাকওয়া অর্জনে একে অন্যের সহযোগিতা কর। (মায়িদা : ২) সেখানে বিবাহের মাধ্যমে যখন এক নর ও এক নারী পরস্পর একীভূত হয়ে যায় এবং তারা পরস্পরে এক অবিচ্ছেদ্য জীবনের অংশীদার হয়ে যায়, যদ্দরুণ কুরআন মাজীদ ঘোষণা করছে, স্ত্রীগণ তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরাও তাদের পরিচ্ছদ (নিসা : ১৮৭), তখন দাম্পত্য জীবনে সেই সহযোগিতা যে অনেক বেশি প্রাসংগিক, বরং সেটা বৈবাহিক সম্পর্কেরই এক জোর দাবি তা বলাই বাহুল্য। সুতরাং একজন মুসলিম নর ও একজন মুসলিম নারী হিসাবে জীবন চলার পথে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বামী-স্ত্রীকেই পালন করতে হবে। অন্য সকলের তুলনায় তাদের পক্ষে এ ভূমিকা পালন সহজও বটে। দাম্পত্য সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ের মতো এ ক্ষেত্রেও দায়বদ্ধতা স্বামীরই বেশি। তার প্রতিই প্রত্যক্ষ নির্দেশ-

قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا

(তোমরা নিজেদেরকে ও তোমাদের পরিবারকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও। (তাহরীম : ৬)

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

والرجال راع على أهل بيته …

এবং পুরুষ তার গৃহবাসী সকলের যিম্মাদার এবং তাকে তার এ যিম্মাদারি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫২০০; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪৮২৮

এটা তো পরিষ্কার কথা যে, এ দায়িত্ব কেবল স্ত্রীর পার্থিব প্রয়োজনসমূহ পূরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; কুরআন মাজীদের উপরিউক্ত আয়াত দ্বীনী প্রয়োজন সমাধাকেও এর অন্তর্ভুক্ত করছে। অর্থাৎ স্ত্রীর ঈমান-আকীদা, ইবাদত-বন্দেগী, আখলাক-চরিত্র, দায়িত্ব-কর্তব্য, চিন্তা-চেতনা ইত্যাদি সবকিছু যেন কুরআন-সুন্নাহ মোতাবেক হয় সে লক্ষ্যে তাকে এসব শেখানো ও সে শিক্ষা অনুযায়ী তাকে গড়ে তোলার দায়িত্ব অবশ্যই স্বামীর উপর বর্তায়। কিন্তু আফসোস, অধিকাংশ স্বামী এ বিষয়টাকে গুরুত্বের সংগে দেখছে না। দায়িত্বশীল স্বামী স্ত্রীকে ভালো জায়গায় রাখা, ভালো খেতে দেওয়া ও ভালো পোশাক পরানোকেই যথেষ্ট মনে করছে। অর্থাৎ স্ত্রীর প্রতি তার দায়িত্ববোধ ইহজাগতিকতার বৃত্তে আবদ্ধ থাকছে। তার বোধ সে বৃত্ত ভেদ করছে না, যেহেতু সে ভাবনাটাই তার মাথায় নেই।

প্রচলিত অর্থে যারা দ্বীনদার নয়, কথা তাদের সম্পর্কে হচ্ছে না। যে নিজের ব্যাপারেই দ্বীনের কথা ভাবছে না, স্ত্রীর জন্য সে তা ভাবতে যাবে কেন? বরং ভাগ্যক্রমে স্ত্রী যদি দ্বীনমনস্ক হয়, সে নিজের জন্য তাকে দুর্ভাগ্যই গণ্য করবে। এমন বদনসীব স্বামীও আছে, যার স্ত্রীর দ্বীন ও আমলের পক্ষে সবচে বড় বাধা সে নিজে। সে স্ত্রীর রূহ হয়ত হযরত আছিয়া আ.-এর মতো ফরিয়াদ জানায়-

رَبِّ ابْنِ لِي عِنْدَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِنْ فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ

হে আমার প্রতিপালক! তোমার সন্নিধানে জান্নাতে আমার জন্য একটি ঘর বানাও এবং আমাকে নাজাত দাও ফিরআওন ও তার দুষ্কর্ম হতে এবং আমাকে নাজাত দাও এই জালেম জাতি থেকে। (তাহরীম : ১১)

সুতরাং ‘স্ত্রীর দ্বীনী জীবন বিনির্মাণে শৈথিল্য করছে’-এ কথা তাদের সাথে যায় না। তাদের প্রতি আমাদের প্রথম দাওয়াত এবং অবশ্যই আমার নিজের প্রতিও ‘নিজেকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর।’

اللهم أجرني من النار

(হে আল্লাহ! আমাদেরকে জাহান্নাম থেকে পানাহ দিন।)

প্রশ্ন হচ্ছে, যারা দ্বীনের সাথে সম্পর্ক রাখছে, যারা আলেম-উলামার সাথে যোগাযোগ রাখে, মসজিদে যায়, ওয়াজ-নসীহত শোনে, দ্বীনী রচনাদি পড়ে এবং দ্বীন সম্পর্কে কম-বেশি জানে, এমনকি দ্বীনদার ও মুত্তাকী-পরহেযগার হিসেবে পরিচিতও, তারা এ বিষয়ের প্রতি ঠিক কতখানি গুরুত্ব দেয়? এর সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া কঠিন। মূলত এই শ্রেণীর স্বামীদেরও স্ত্রী-শিক্ষার প্রতি বিশেষ দায়বোধ নেই। নিজেদের তো কমবেশি শেখার সদিচ্ছা আছে এবং অল্পবিস্তর শেখার সুযোগও আছে, কিন্তু স্ত্রীদের বেলায় অঘোর ঘুম। স্ত্রীর আকীদা-বিশ্বাস দুরস্ত কি না, নামায-রোযা-হজ্ব ও যাকাতের মাসায়েল জানা আছে কি না, পাক-পবিত্রতার নিয়ম-কানূন সম্পর্কে কতটুকু খবর রাখে, আল্লাহর হক ও বান্দার হক সম্পর্কে কতটুকু সচেতন, জায়েয-নাজায়েয ও হালাল-হারাম ইত্যাদি সম্পর্কে কতটুকু অবহিত, আকছার স্বামী এর কোনো খোঁজ নেয় না। ফলে দ্বীনের সাথে সম্পর্করহিত বিপুল নারীশ্রেণীর সাথে তারাও সর্বগ্রাসী অজ্ঞতার উদরস্থ। না আছে তাদের জন্য ওয়াজ-নসীহতের এন্তেজাম, না ব্যক্তিগত যোগাযোগের মাধ্যমে শেখার সুযোগ এবং না আছে তাদের পাঠ্যাভ্যাস, যাও কিছু পড়ে আকছার তার দৌড় মকসূদুল মুমিনীন বা এ জাতীয় কিছু তরল বই-পুস্তক পর্যন্ত, জ্ঞানবৃদ্ধি অপেক্ষা কুসংস্কারের বিস্তার ও অজ্ঞতা বৃদ্ধিতেই বরং তা বেশি ভূমিকা রাখে।

একদিকে স্ত্রীশিক্ষার প্রতি স্বামীদের এই নির্বিকার ভূমিকা ও তজ্জনিত সর্বাত্মক অজ্ঞতা, অন্যদিকে তথাকথিত প্রগতিবাদের বহুমুখী নিরসল প্রচারণা ও উগ্র নারীবাদী চিন্তা-চেতনাকে সংক্রমিত করে দেওয়ার নানারকম স্থূল-সূক্ষ্ম প্রচেষ্টা। লা-ওয়ারিশ শূন্যভান্ডে সেই আবর্জনার ঠাঁই না হওয়ার তো কোন কারণ নেই। চেতনার প্রতিরোধক যে আত্মায় নেই জাহিলিয়াতের জীবাণুতে তা সংক্রমিত না হবে কেন? সুতরাং স্বামীগণ যতই নিশ্চিত মনে বসে থাকুন না কেন, ভেতরে কিন্তু অন্ধকার ঠিকই হানা দিচ্ছে।

বেদ্বীনী লেখাজোখায় দেশকাল সয়লাব। বাহিরে-অন্দরে তার অবাধ গতি। তার বোল বড় চিত্তহারী। মূঢ় মন-মস্তিষ্ককে তা বেশ নাড়া দেয়। তাছাড়া অন্যের সাথে যোগাযোগের আছে বিস্তর মাধ্যম। সেইসব মাধ্যম ধরে অন্যের ডাক-দাওয়াত-ভাবনা-কল্পনা কোন্ অজান্তে ভেতরে জানান দিয়ে দেয় অনেক সময় তা অনুভবও করা যায় না। অনুভব যখন করা যায়, ততক্ষণে জল গড়িয়ে গেছে বহুদূর। প্রতিকার তখন কষ্টসাধ্য এমনকি দুঃসাধ্যও হয়ে যায়। তখন একই ছাদের নিচে বাস করেও দুই জগতের দুই জনা। দাম্পত্যের দিনগুলি হয়ত কেটে যায়, কিন্তু কাটে তো মাধুর্যহীন। স্ত্রী হয়ত সে জীবনকে অভিভাবক বা সমাজের চাপানো যাতনাই মনে করে। কেননা কাল্পনিক যে জীবনের ছবি ইতিমধ্যে তার মানসপটে আঁকা হয়ে গেছে, তা থেকে সে নিজেকে নিদারুণভাবে বঞ্চিতই মনে করছে। বড় আক্ষেপে তার দিন কাটে। উপায়হীনভাবে সে এই দুর্বহ জীবনের ভার বয়ে যায়। এই যে তার মানসিক যাতনা, প্রকৃতপক্ষে যা মিথ্যা যাতনা, অথচ তার জীবনে তা কতই না বাস্তব!

এ তো কেবল তাকেই ক্লিষ্ট করে না, এর আঁচ কোনও না কোনওভাবে সংশ্লিষ্ট সকলেরই গায়ে লেগে যায়। স্বামী নিজে না হয় তা সয়ে নিল কিংবা তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠল, কিন্তু তাদের স্বপ্নের সন্তানেরা তা কেন ভুগতে যাবে? কিন্তু তারা নিরুপায়। তাদের তা ভুগতেই হয়। প্রভাব পড়ে তাদের কেবল শরীর-স্বাস্থ্যেই নয়, মন-মানসিকতাও আক্রান্ত হয়। বাবার বা মায়ের মনপীড়া তাকে ব্যথিত করে। তার মনে বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়। আমি এমন শিশু দেখেছি, যে তার বাবাকে ঘৃণা করে, এমনও দেখেছি যার চোখে মা স্বামীপীড়ক। দাম্পত্য অমিলই সন্তানকে এই দুঃখজনক অবস্থানে উপনীত করেছে। এমন অনেক চোখে পড়েছে, যেখানে পিতা চায় সন্তানের দ্বীনসম্মত নির্মাণ আর মায়ের চোখে তার রঙীন ভবিষ্যত। টানা-হেঁচড়া, লড়াই-সংগ্রাম চলে অনেক দিন। শেষ পর্যন্ত অনেক পিতাকেই দেখা গেছে পরাভব স্বীকারে বাধ্য হয়েছে। ‘কি কঠিন ঝুঁকিতে অবোধ শিশুকে ফেলে দেওয়া হল’-স্পষ্ট দেখা সত্ত্বেও ঘরের শান্তির খাতিরে তাকে তা মেনে নিতে হয়। কিন্তু পেছনে তাকালে এসব কিছুর জন্য প্রধানত দায়ী সে নিজেই। কেন সে স্ত্রীর দ্বীনী হক আদায় করল না? ভাত-কাপড়ের তুলনায় এ হক তো কোন অংশে লঘু ছিল না! সেই-ই তো স্ত্রীর তালীম-তরবিয়তের দিকে নজর না দিয়ে প্রথমে স্ত্রীর দ্বীন-দুনিয়া বরবাদ হওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আর এখন যা কিছু ঘটছে তারই কুফল, তারই প্রতিক্রিয়া।

এ তো গেল স্ত্রীর তালীম-তরবিয়তের ব্যাপারে শৈথিল্যমূলক প্রান্তিকতা। সংখ্যার দিকে তাকালে এই শ্রেণীর স্বামীই বেশি। তবে সংখ্যায় কম হলেও এমন অনেক স্বামীও আছে, যারা স্ত্রীকে শিক্ষাদান করতে গিয়ে বা তাকে দ্বীনের পথে আনতে গিয়ে পদ্ধতিগত বাড়াবাড়িও করে থাকে। অর্থাৎ তারা চায় দুদিনেই তার আমূল পরিবর্তন ঘটে যাক। অথচ বিয়ে করার সময় সে দ্বীনদারীকে সর্বাপেক্ষা কম গুরুত্ব দিয়েছে বা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছে। কথা ছিল এটাই হবে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। সে বিবেচনা করলে আজ এ নিয়ে তাকে পেরেশান হতে হত না। এখন তার মেহনত তাকে দ্বীনের পথে আনার জন্য করতে হত না, বরং দ্বীনের পথে আরও উৎকর্ষ লাভ কীভাবে সম্ভব, সে ব্যাপারে তারা একে অন্যকে সহযোগিতা করতে পারত। কিন্তু প্রথমেই যখন সে চিন্তা করা হয়নি, বা নিজেই আমলে গাফিল থাকার কারণে সে ভাবনা মাথায় আসেইনি, তখন তার ভোগান্তি তো এখন কিছুটা পোহাতেই হবে। এখন তো রাতারাতি সবকিছু বদলে ফেলা সম্ভব হবে না। তা করতে চাইলে হিতে বিপরীত হবে এবং তা হচ্ছেও। এমন ঘটনা শোনা গেছে যে, পর্দাসহ ইসলামের অন্যসব অনুশাসন মানানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করায় স্ত্রী সম্পূর্ণ বেঁকে গেছে। সে নিজেও তাকে নিজের পক্ষে নির্যাতন হিসেবে দেখেছে এবং অন্যরাও তাকে নারীর নির্যাতনের মাত্রায় ফেলেছে। এতে করে তার চেষ্টা তো ভেস্তে গেছেই, সেই সংগে দ্বীনবিরোধী প্রচারণায়ও হাওয়া লেগেছে।

সুতরাং শৈথিল্য ও বাড়াবাড়ি উভয় প্রান্তিকতাই পরিত্যাজ্য। স্ত্রীকে দ্বীনের শিক্ষা অবশ্যই দিতে হবে এবং অবশ্যই তার চিন্তা-চেতনা ও মন-মানসিকতায় ঈমানের আলো সঞ্চার করতে হবে। স্বামী হিসেবে এটা তার দায়িত্ব। এ দায়িত্ব পালনে কোনওরূপ শৈথিল্য প্রদর্শনের সুযোগ নেই। কিন্তু সেই সংগে পরিমিতিবোধেরও পরিচয় দিতে হবে। কিছুতেই মাত্রাজ্ঞান হারানো চলবে না। মনে রাখতে হবে, সব কিছুতে মধ্যপন্থাই উত্তম। প্রত্যাশিত ফল তাতেই লাভ হয়।

স্ত্রী কেমন পরিবেশ থেকে এসেছে, কী চিন্তা-ভাবনা সে লালন করে, আমল-আখলাকের ঠিক কোন পর্যায়ে সে অবস্থান করছে, প্রভৃতি বিষয়গুলো নজরে রেখেই কাজ করতে হবে। সে যাতে চাপ বোধ না করে, ভড়কে না যায়; বরং উৎসাহবোধ করে সে দিকে লক্ষ রাখা চাই। তার সামনে তুলে ধরতে হবে ইসলামের মহিমা, ইসলামের সৌন্দর্য ও ইসলামী জীবনের শান্তিময়তা। নিজ ব্যক্তিত্ব, নিজ আচরণের মাধুর্য ও ইসলাম নির্দেশিত নিজ দায়িত্বশীলতাই হতে পারে তার জন্য সর্বাপেক্ষা কার্যকর দাওয়াত। সুতরাং বুদ্ধিবৃত্তিক দাওয়াতের সাথে এই ব্যবহারিক দাওয়াতকেও বিশেষ গুরুত্বের সাথে দেখা জরুরি।

তবে বুদ্ধিবৃত্তিক দাওয়াত চিন্তা-চেতনাকে পরিচ্ছন্ন ও পরিপুষ্ট করে। কাজেই এ খোরাকও তাকে জোগাতে হবে। তার সামনে দুয়ার খুলে দিতে হবে। চাই ভেতরে ইসলামের আলো প্রবেশের সুযোগ। সে বুঝে উঠুক মুসলিম কাকে বলে। সে যে আল্লাহ তাআলার এক মহান সৃষ্টি তাকে তা বুঝতে হবে। নারী হিসেবে নিজ মহিমা তার উপলব্ধিতে আসুক। নব্যজাহিলিয়তের বিষবাষ্পে তার চৈতন্য ধূম্রাচ্ছন্ন। তথাকথিত নারী প্রগতির ভড়ং তার চোখে ঘোর লাগিয়েছে। সে একরকম অসুস্থ। তার আরোগ্য দরকার। তার দরকার মমতার হাত, যে হাত তার সম্মুখ থেকে সব প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করবে। ধোঁয়াশা সরিয়ে দেবে। দরকার ধীর-স্থিরতা। সে ধাতস্থ হোক। চোখ কচলে তাকাক। তারপর তার চৈতন্যে আঘাত হানুক ইসলামের মর্মবাণী।

ইসলাম মানে আত্মসমর্পণ-নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। নারী-পুরুষ সকলেই আল্লাহর বান্দা। বান্দা হিসেবে প্রত্যেকের কর্তব্য আল্লাহর হুকুমের দিকে তাকানো এবং বিনাবাক্যে তা শিরোধার্য করা। আল্লাহ তাআলার অধিকাংশ হুকুমই উভয়ের জন্য সাধারণ। অভিন্ন আকীদা-বিশ্বাস উভয়ের জন্য পালনীয়। ইবাদত-বন্দেগীতেও কোন প্রভেদ নেই। কিন্তু আল্লাহ তাআলা নিজ হিকমতে একজনকে পুরুষ ও একজনকে নারী বানিয়েছেন। মানব-প্রজন্মের বাহ্য ও অন্তর্গত সুরক্ষার জন্য প্রত্যেকের দ্বারা পৃথক কাজ নেওয়ার রয়েছে। সে লক্ষ্যে উভয়ের মধ্যে গঠন ও মননগত কিছু পার্থক্য রেখেছেন। এ পার্থক্য একটা অনঃস্বীকার্য বাস্তবতা। ইরশাদ হয়েছে-

وَلَيْسَ الذَّكَرُ كَالْأُنْثَى

পুরুষ নয় নারীর মত। (আলেইমরান : ৩৬)

দেহমনে নারী অপেক্ষা পুরুষ শক্ত-সমর্থ। নারী নম্র-কোমল। এই স্বাতন্ত্র্য উদ্দেশ্যবিহীন নয়। শক্তিমত্তার ভিত্তিতে পুরুষের উপর কিছু বাড়তি বিধান আরোপিত আছে। মুসলিম হিসেবে সে বিধান পালনে তাকে সমর্পিত থাকতেই হবে। অনুরূপ ললিত-কোমল হওয়ার সুবাদে নারীর প্রতিও কিছু আলাদা হুকুম আছে। মুসলিম নারী হিসেবে তার তা অগ্রাহ্য করার সুযোগ নেই। মুসলিম তথা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পিত থাকার অর্থ এ ছাড়া কিছুই নয় যে, তার সকল বিধানকে খুশিমনে, নিজ মঙ্গলের বিশ্বাসে মেনে চলা হবে। কাজেই গনা-গুনতি যে পৃথক বিধান প্রত্যেক শ্রেণীর উপর আরোপিত খুশিমনেই তাদের তা পালন করা চাই। নয়ত মুসলিম নাম প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।

নারীর প্রতি আরোপিত প্রধান দায়িত্ব দুটি। একটি স্ত্রী হিসেবে, আরেকটি মা হিসেবে। স্ত্রী হিসেবে তার কাজ কঠোর-কঠিন শ্রমক্লান্ত স্বামীর দেহমনে প্রশান্তি যোগানো। এটা তার  কাছে স্বামীর প্রাপ্য। ইরশাদ হয়েছে-

خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا

তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকেই সংগিনী বানিয়েছেন, যাতে তাদের কাছে পৌঁছে প্রশান্তি লাভ করতে পার। (সূরা রূম : ২১)

আর মা হিসেবে তার দায়িত্ব গর্ভে সন্তান ধারণ, তার হেফাযত ও পরিচর্যা। এতে একেক সন্তানের পেছনে তার টানা কয়েক বছর সময় দিতে হয়। সর্বাপেক্ষা ব্যস্ত-কঠিন সময়ই তো কমপক্ষে ত্রিশ মাস। ইরশাদ হয়েছে-

وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلَاثُونَ شَهْرًا

এবং তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও দুধ ছাড়াতে লাগে (কমপক্ষে ত্রিশ মাস)। (সূরা আহকাফ : ১৫)

তারপরও তাকে দীর্ঘকাল সেবা দিয়ে যেতে হয়, যতদিন না সে নিজের কাজ নিজে করতে সক্ষম হয়। সেই সাথে আবার নতুন শিশুর আগমন ও তার লাগাতার সেবাযত্ন।

বলাবাহুল্য স্ত্রী ও মা হিসেবে নারীর এই যে দায়িত্ব এটা তো বাইরে থেকে পালন সম্ভব নয়। গৃহই এর জন্য উপযুক্ত স্থান। তাই তার প্রতি আদেশ

وَقَرْنَ فِي بُيُوتِكُنَّ

তোমরা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান কর। (সূরা আহযাব : ৩৩)

স্ত্রীকে এ কথা ভালোভাবে বুঝতে হবে যে, বহির্মুখিতা তার জন্য নয়। তা তার পক্ষে শোভন নয়, সংগতও নয়। আয়-রোজগারের জন্য বাইরে দৌড়ঝাঁপ, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দায়-দায়িত্ব নিয়ে ছোটাছুটি এবং যে কোনও রকমের বহির্জাগতিক সংশ্লিষ্টতা তার মূল দায়িত্বের সাথে সংগতিহীন; বরং তা পালনের পক্ষে অন্তরায় ও ক্ষতিকারক। আর সে ক্ষতি কেবল দম্পতি ও পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, তার আওতায় চলে আসে বৃহত্তর সমাজও। বিদগ্ধজনেরা তা ঠিকই উপলব্ধি করছে এবং অধুনা সমাজে তার ভয়াবহ ক্রমবিস্তার দেখে তারা যথারীতি আতংক বোধ করছে।

সুতরাং গৃহই নারীর আসল জায়গা। সে যাতে ঘরের ভেতর নিশ্চিন্তে, স্বস্তিতে, শান্তিতে থাকতে পারে এবং নির্বিঘ্নে আপন দায়িত্ব পালনে রত থাকতে পারে, সে লক্ষ্যে ইসলাম তাকে সম্পূর্ণরূপে বৈষয়িক ভারমুক্ত রেখেছে। আয়-ব্যয়ের কোন দায়-দায়িত্ব তার উপর নেই। অন্যের তো নয়ই, তার নিজেরও খাওয়া-পরার কোন চিন্তা তার মাথায় দেওয়া হয়নি। এসব ব্যাপারে তাকে দেওয়া হয়েছে-‘মাখদূম’-এর মর্যাদা। অর্থাৎ তার বৈষয়িক প্রয়োজনাদি পূরণের জন্য পুরুষকে তার সেবক বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সুতরাং চাই মূল্যবোধের চর্চা। যাকে সেবিতের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, অফিস-আদালতে সে কেন সেবিকা হয়ে থাকবে? অন্যের মনোরঞ্জনের উপকরণ হওয়ার ভেতর মর্যাদা কোথায়? যার পদপ্রান্তে সন্তানের জান্নাত তার উচিত নিজ মর্যাদার স্থানটি চিনে নেওয়া এবং স্ত্রীত্ব ও মাতৃত্বের মহিমাকে অনুভব করা। সে মহিমাকে অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে তার দ্বিতীয় কর্তব্য স্বামীর আনুগত্য করা।

মনে রাখতে হবে আনুগত্য মানে দাসত্ব নয়; বরং কর্তব্য পালন। কেন যেন আধুনিক নারীদের কাছে শব্দটি কদর্য মনে হয়। তারা স্বামীর আনুগত্য করাকে নিজের পক্ষে অবমাননাকর মনে করে। প্রকৃতপক্ষে এতে অসম্মানের কিছু নেই। সংসারযাত্রায় সুষ্ঠুতা আনয়নের জন্য এটা জরুরি। দাম্পত্য জীবন দুদিনের তামাশা নয়। এমন নয় যে, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দুই নর-নারী একত্রবাসে চুক্তিবদ্ধ হল। সন্তান-সন্ততির স্বপ্ন নেই, পরিবার গড়ার প্রশ্ন নেই, কোন স্বপ্নিল ভবিষ্যতের কল্পনা নেই, কেবলই জান্তব যূথবদ্ধতা; বরং বিবাহ, বিশেষত ইসলামী বিবাহ দ্বারা দুই নর-নারীতে যে সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তার রয়েছে বহুমাত্রিক সংশ্লিষ্টতা। এ সম্পর্কের কোন মেয়াদ নেই; বরং মৃত্যুতেও নিঃশেষ হয় না। এর মাধ্যমে যে পরিবার গড়ে ওঠে, তা যেন এক ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। একটি রাষ্ট্রের মতই এর আছে অর্থ বিভাগ-আয়-ব্যয়, উৎপাদন-বণ্টন, আমদানি-রপ্তানি প্রভৃতির ব্যবস্থাপনা। আছে অভ্যন্তরীণ নিয়ম-শৃঙ্খলা বা স্বরাষ্ট্র বিভাগীয় কার্যক্রম। সেই সাথে আত্মীয়, স্বজন এবং নিকট ও দূর প্রতিবেশীসহ অন্যান্য মানুষজনের সাথে যোগাযোগ বা পররাষ্ট্রবিভাগীয় কার্যক্রম। এমনিভাবে শিক্ষাবিভাগ, বিচারবিভাগসহ রাষ্ট্রীয় সবকিছুর ক্ষুদ্র নমুনা। আবার এই বাহ্য পার্থিব কর্মানুষ্ঠানের সাথে আছে নিবিড় পারলৌকিক যোগ। অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে অতি ক্ষুদ্র এক গন্ডি হলেও কর্মবৈচিত্র্যে একটি রাষ্ট্রতুল্য। প্রশ্ন হচ্ছে পরিবাররূপী এ রাষ্ট্র কি বিনা নেতৃত্বে চলতে পারে, না চলা উচিত? কোন যৌথ কাজই নেতা ছাড়া সংগত নয়, তার সভ্য দুজনও যদি হয়। রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এমনকি দুজন লোক একত্রে সফর করলেও তাঁর নির্দেশ, তারা যেন একজনকে আমীর বানিয়ে নেয়। সুতরাং দাম্পত্য সফরেও একজন আমীর বা কর্তা থাকা অপরিহার্য। অন্যথায় পরিবারের সর্বাঙ্গনে সুষ্ঠু পরিচালনা এবং একটি আদর্শ ও শান্তিপূর্ণ পরিবার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তা কে হবে এ অংগনের আমীর? এ সিদ্ধান্ত কি মানুষের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়া হবে? হয়ত অনেকেই সে কথা বলবে, কিন্তু সেটা অপরিণামদর্শিতা। জগতের অগণ্য পরিবারের প্রত্যেকটির নেতা নির্বাচনকে মানুষের ইচ্ছাধীন রেখে দেওয়া হলে বর্তমানে নেতা না মানার যে অরাজকতন্ত্র চলছে এবং এর পরিণামে অধিকাংশ পরিবারে যে অস্থিরতা বিরাজ করছে এটাই হত তার অবধারিত পরিণতি। কে কাকে ছাড় দিত? কাকে সহজে মেনে নেওয়া হত? ফলে কোনও পরিবারেই কাউকে নেতৃত্বের আসনে বসানো হত না। ফলে ‘মানি না-মানব না’- এর ডামাডোলে দাম্পত্য জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য চির-অধরা থেকে যেত, যেমন থাকছে ‘না মানা-মানির’ আধুনিক পরিবারগুলোতে। এর থেকে রক্ষার জন্যই মানুষের সৃষ্টিকর্তা ও দাম্পত্যের বিধানদাতা স্বয়ং স্থির করে দিয়েছেন

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ

পুরুষ নারীর কর্তা। (সূরা নিসা : ৩৪) একজন মুসলিম নারী যখন তার অন্তরে ইসলাম ও আত্মসমর্পণের বিশ্বাস লালন করে, তখন আল্লাহ তাআলার এ ফয়সালাকে খুশীমনে গ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক। এর উপর আমল করাতেই তার নিজের, পরিবারের ও গোটা সমাজের কল্যাণ।

অর্থাৎ সে আল্লাহ তাআলার একজন বাধ্যগত দাসী হিসেবে প্রথমত নিজেকে তার হুকুমের কাছে দায়বদ্ধ মনে করবে। তারপর চিন্তা করবে স্বামীর নেতৃত্ব আল্লাহ তাআলার হুকুমের কাছে দায়বদ্ধ থাকায় তাকে যেমন সুষ্ঠু পরিচালনার-জবাবদিহি করতে হবে, তেমনি আমাকেও জবাবদিহি করতে হবে আমি তার পরিচালনাকে কতটুকু মান্য করেছি এবং কতটুকু তার অনুগত হয়ে থেকেছি। বস্ত্তত উভয়ের ক্ষেত্রেই মূল চেতনা আল্লাহর হুকুমের কাছে আত্মসমর্পিত থাকা। স্বামীর নেতৃত্ব যেমন কর্তৃত্ববাদিতার জন্য নয়, তার প্রতি আনুগত্যও নয় স্ত্রীর পক্ষে কোনরূপ ক্ষুদ্রতা। উভয়েই পরীক্ষার ভেতর আছে। আল্লাহ দেখছেন আপন-আপন অবস্থান থেকে কে কিরূপ কাজ করছে-

ثُمَّ تُرَدُّونَ إِلَى عَالِمِ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ فَيُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُونَ

অতপর যিনি অদৃশ্য ও দৃশ্যের পরিজ্ঞাতা তার নিকট তোমাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। তখন তিনি তোমাদেরকে জানাবেন তোমরা (ইহজগতে) যা কিছু করতে। (সূরা তাওবা : ৯৪)

সারকথা স্ত্রীদেরকে নিজ দায়িত্ব-কর্তব্যের সীমানা বুঝে নিতে হবে। নেতা হিসেবে সিদ্ধান্তদানের এখতিয়ার স্বামীর এই সত্য উপলব্ধি করাতেই মঙ্গল। সীমানা ডিঙিয়ে নিজে সিদ্ধান্ত দেওয়া ও স্বামীকে তা মেনে নিতে বাধ্য করতে যাওয়া কিছুতেই সংগত নয়। আর কেনই বা অহেতুক অন্যের দায়িত্ব নিয়ে টানাটানি করে মাথায় বাড়তি বোঝা চাপানো? আখিরাতে বিশ্বাসী একজন মুমিনের আপন জবাবদিহিতার সিলসিলা তো কম লম্বা নয়। (আল্লাহ তাআলা সে পরিস্থিতির সম্মুখীন করা ব্যতিরেকে বিনা হিসেবেই আমাদের ছাড় দিয়ে দিন-আমীন।) তার উপর সেই ফিরিস্তি আরও দীর্ঘ করা কেন? তারচে আপন সীমানার মধ্যে থেকে অর্পিত দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে কীভাবে আখিরাতের নাজাত লাভ করা যায় সেটাই হোক লক্ষ্যবস্ত্ত। সেজন্য স্বামীর আনুগত্যই সহজ পন্থা। তাতে দেহের আরাম, দিলের-স্বস্তি। কুরআন মাজীদ একজন নেককার নারীকে সে উৎসাহই দিয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

فَالصَّالِحَاتُ قَانِتَاتٌ حَافِظَاتٌ لِلْغَيْبِ بِمَا حَفِظَ اللَّهُ

নেককার নারী (স্বামীর) আনুগত্যকারিনী এবং (তার) অনুপস্থিতিতে (নিজ সতিত্ব ও স্বামীগৃহের) হেফাযতকারিনী, যেহেতু আল্লাহ (তার বৈষয়িক ব্যবস্থাপনার ভার স্বামীর উপর ন্যস্ত করে) তার হেফাযতের ব্যবস্থা করেছেন। (সূরা নিসা : ৩৪) রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজন ভালো স্ত্রীর পরিচয় দান করেন, স্বামী তাকে আদেশ করলে তা মান্য করে, স্বামী তার দিকে তাকালে সে তাকে আনন্দ দান করে, তাকে কোন বিষয়ে কসম দিলে তা রক্ষায় তাকে সহযোগিতা করে এবং সে অনুপস্থিত থাকলে নিজ সত্তা ও তার অর্থ-সম্পদের ব্যাপারে তার প্রতি কল্যাণকামিতার পরিচয় দেয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৮৫৭)

 

Leave a Comment

Your email address will not be published.