অন্যের সাথে ঐ আচরণ করি যা পেলে আমি খুশী হই-২

আদাবুল মুআশারা রক্ষা করা নফল আমলের চেয়ে উত্তম:
আদাবুল মুআশারা
রক্ষা করা নফল আমল ও নফল ইবাদত যেমন, নফল নামায নফল রোযা ইত্যাদির চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এর দলীল হল,
একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে দু’জন মহিলার কথা আলোচনা করা হল। একজন রাতভর ইবাদত করে আর দিনের বেলা রোযা রাখে। কিন্তু প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, সে জাহান্নামে যাবে।
আরেকজন এত বেশী নফল নামায পড়ে না, এত বেশী নফল রোযা রাখে না। শুধু দ্বীনের ফরজ – ওয়াজিবগুলো আদায় করে। দিনভর রোযা রাখার এবং রাতভর নামায পড়ার সুযোগ তার হয় না। কিন্তু সে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় না। রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, সে জান্নাতে যাবে।

তাহলে বোঝা গেল, নফল ইবাদতের চেয়ে অন্য মানুষকে কষ্ট না দেয়া বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে জান্নাতে যাওয়া, জাহান্নাম থেকে বাঁচা বেশী সহজ হবে।

আদাবুল মুআশারা গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার আরেক কারণ হল, শরীয়তের এই মূলনীতি যে, দ্বীনের কোনো বিষয় যখন সাধারণভাবে অবহেলিত হয়ে পড়ে তখন চর্চা ও আলোচনার মাধ্যমে এর প্রচার-প্রসার বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়। যা সকলে জানে ও মানে, তার চেয়ে যা মানুষ ছেড়ে দিয়েছে, যাকে মানুষ এখন দ্বীনের অংশ মনে করে না তা প্রতিষ্ঠা করা, আমল করা, ঐ বিষয়টির শিক্ষা গ্রহণ করা এবং শিক্ষা দান করা শরীয়তের দৃষ্টিতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখন এ বিষয়টির উপর গুরুত্ব দেয়া না হলে ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ইসলামের একটি বিধানকে বাঁচিয়ে রাখা অনেক নফল ইবাদতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর আদাবুল মুআশারা তো একটি বিধানমাত্র নয়, একটি বিভাগ। দ্বীনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তৃত শাখা। এ সকল কারণে আলোকে আলিমগণ বলেন, হুসনে আখলাক ও হুসনুল ‘ইশরা তথা সুন্দর স্বভাব-চরিত্র ও সুন্দর ব্যবহার ইসলামের দৃষ্টিতে অনেক বেশী গুরুতবপূর্ণ।

আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম যা বলেছেন, তিনি নিজে ছিলেন তার সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি নামাযের কথা বলেছেন আর তার নামায ছিল সবচেয়ে সুন্দর। তিনি রোযার কথা বলেছেন আর তার রোযা ছিল সবচেয়ে সুন্দর। তিনি হজ্বের কথা বলেছেন তার হজ্বই ছিল সবচেয়ে সুন্দর। তিনি দান সদকার কথা বলেছেন দান সাদাকার ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে অগ্রগামী। তিনি সুন্দর আচরণের কথা বলেছেন, আপনি হাদীসের গ্রন্থ পাঠ করুন, ইতিহাসের গ্রন্থ পাঠ করুন, দেখবেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণই ছিল সবচেয়ে সুন্দর। এর দলীল হল, তার নিকটজনদের সাক্ষ্য যারা তার সাথে জীবন অতিবাহিত করেছেন। তার ভেতর বাহির যাদের সামনে ছিল, তাদের সাক্ষ্য এবং আল্লাহর সাক্ষ্য।
আল্লাহ রাববুল আলামীন তার রাসূল সম্পর্কে বলেন,

إِنَّكَ لَعَلى خُلُقٍ عَظِيْمٍ
নিশ্চয় আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা.- কে জিজ্ঞাসা করা হল, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্বভাব-চরিত্র কেমন ছিল? তিনি বললেন, ‘তার চরিত্র ছিল কুরআন।’ তিনি ছিলেন কুরআনের বাসত্মব রূপ।

হযরত আনাস রা.-কে তার আম্মা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এই বলে রেখে গিয়েছিলেন যে, এই আমার ছেলে। সে আপনার কাছে থাকুক। আপনার কাছে থেকে সে দ্বীন শিখবে। আর ছোটখাট কাজ করে দেবে। হযরত আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল ছিলেন সবচেয়ে সুন্দর আখলাকের অধিকারী। আমি দশ বছর তার কাছে ছিলাম। তিনি আমাকে একদিনও উফ শব্দটি পর্যন্ত বলেননি

ছোট মানুষ কত ভুলই তো করেছেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল সম্পর্কে তার সাক্ষ্য, একদিনও তিনি আমাকে উফ শব্দটি পর্যন্ত বলেননি। হাদীস শরীফে আরো আছে, তিনি কখনো তার কোনো খাদেমকে, কোনো স্ত্রীকে প্রহার করেননি।

সহীহ মুসলিমে হযরত মিকদাদ রা. থেকে দীর্ঘ এক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে । তারা কয়েকজন ব্যক্তি রাসূললুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসেছিলেন। রাতে মসজিদে অবস্থান করতেন। তো রাতে যখন আল্লাহর রাসূল মসজিদে আসতেন তখন এমনভাবে সালাম দিতেন যাতে কোনো ঘুমন্ত মানুষের ঘুম না ভাঙ্গে এবং জাগ্রত মানুষ শুনতে পারে।

وكان يسلم تسليما لايوقظ نائما ويسمع اليقظان

মানুষের ঘুমের দিকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কত লক্ষ্য করতেন! আমরা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে একটু চিন্তা করে দেখি, আমরা কি অন্যদের ঘুমের বেলায় ততটা লক্ষ্য রাখি? কত সময় এমন হয়, একজন মানুষ ঘুমিয়ে আছে, আমি ঠাস করে দরজা খুললাম। ড্রয়ার খুলে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে থাকলাম। আর ঐ বেচারার ঘুম ভেঙ্গে গেল। অথচ আমাদের একটু অনুভূতিও হল না। আমরা মনে করছি, এই তো স্বাভাবিক। দরজা খুলতে তো আওয়াজ  হবেই। এই আওয়াজে যদি কারো ঘুম ভেঙ্গে যায় তাতে আমার কী করার আছে? অথচ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম দিচ্ছেন এমন অনুচ্চ স্বরে যে, কারো ঘুম না ভাঙ্গে, কষ্ট না হয়। কখনো এমন হয় যে, একটি কক্ষে পাঁচজন মানুষ থাকেন। তিনজন ঘুমিয়ে আছেন আর দুইজন উচ্চস্বরে গল্প করছেন, হাসাহাসি করছেন। এ অনুভূতি তাদের নেই যে, আমার সঙ্গীদের কষ্ট হচ্ছে। কখনো জোরে মোবাইল বাজিয়ে তিলাওয়াত শোনা হচ্ছে, যে তেলাওয়াতের আওয়াজে পাশের ঘুমন্ত লোকটির ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। অথচ তিনি নির্বিকার। তিনি তো তিলাওয়াত শুনছেন! এ তিলাওয়াত শোনায় কী সওয়াব হবে?

আমরা ঘরে বাইরে যখন কিছু মানুষ একসাথে থাকি তখন একে অন্যের আরামের দিকে লক্ষ্য রাখা খুব দরকার। নতুবা কষ্টের কারণে মন অপ্রসন্ন থাকবে, বিরক্তির সৃষ্টি হবে। বলা বাহুল্য, এদের মাঝে কখনো বন্ধুত্ব হবে না। কারণ বন্ধুত্ব তখনই হয় যখন মন প্রসন্ন থাকে, মনে কষ্ট না থাকে। আরবের এক কবি বলেছেন-

فإني رأيت الحب في الصدر و الأذى /  إذا اجتمعا لم يلبث الحب يذهب

মনের মধ্যে ভালবাসা এবং কষ্ট যখন একত্র হয় তখন কষ্ট থাকে, ভালবাসা চলে যায়। ‘এমন হয় না যে, ভালবাসা থাকে, কষ্ট চলে যায়; বরং সব সময় ভালবাসাই চলে যায়।

তো আদাবুল মুআশারার মূল কথা হচ্ছে, মানুষকে শান্তি দেওয়া, কষ্ট না দেওয়া।  আমার আচরণে কেউ যেন বিরক্ত না হয়। অপ্রসন্ন না হয়।  আমার প্রতি কারো মনে যেন ঘৃণা না জাগে। আলিমগণ আদাবুল মোয়াশারা বিষয়ে যা লিখেছেন, তার মূল কথা এটাই।

একবার আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জুমার খোতবা দিচ্ছিলেন। এক লোক সবার ঘাড় ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে সামনে আসছিল। আল্লাহর  রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘বস! তুমি মানুষকে কষ্ট দিলে।’ ঘাড়ের উপর দিয়ে আসার দ্বারা কি শারীরিক কষ্ট হয়? হয় না। তবে অন্তরে বিরক্তির সৃষ্টি হয়। এই বিরক্তিকর কাজ সম্পর্কেই বলছেন, فقد أذيت তুমি কষ্ট দিলে

তো আদাবুল মোয়াশারা সংক্রান্ত আয়াত-হাদীস এবং এ বিষয়ে আলিমগণের অভিজ্ঞতালব্ধ আলোচনা যদি মনযোগ সহকারে পাঠ করা হয় তাহলে ইনাশাআল্লাহ আস্তে আস্তে চেতনা জাগবে এবং আমল করা সহজ হবে।
আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিন।
আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published.