আল্লাহর জন্য জীবন মরণ:
অনেক দিন পর আজ আপনাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হচ্ছে। হয়ত পূর্বে এত দীর্ঘ ব্যবধান আর কখনো হয়নি। সফর-আসফার ও বিভিন্ন অপারগতার কারণে সাক্ষাতের সুযোগ হয়ে উঠেনি। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ কোনো অবস্থাতেই মুমিনের ক্ষতি নেই, যদি আল্লাহ তাআলা নিজ দয়ায় পূর্ণ ঈমান দান করেন। সঠিক ফিকির ও আমল দান করেন। মানুষ যে অবস্থাতে থাকে সে অবস্থানুযায়ী যদি আমল করে, তাহলে এ সবই দ্বীনের অংশে পরিণত হয়।
কুরবানী করার সময় আমরা যে একটি আয়াত পড়ি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতও হল, কুরবানী করার সময় এ আয়াতটি পড়া-
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ.
‘‘নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য’’
-সূরা আনআম ৬ : ১৬২
অতি তাৎপর্যপূর্ণ আয়াত এটি। আল্লাহ তাআলা এ আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ আদেশ দিয়েছেন, ‘আপনি বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য।’ তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার সময় এ আয়াতকে পড়া সুন্নাত বলেছেন।
ইখলাসের বরকত
আসলে এ আয়াতে বলা হয়েছে, মুমিনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর জন্য হওয়া উচিত, চাই সে যে অবস্থায়ই থাকুক। ইবাদতের ক্ষেত্রে তো এ আয়াত সুস্পষ্ট। সকল ইবাদত আল্লাহর জন্য হওয়া জরুরি। ইখলাসের অর্থও এটাই যে, মানুষের প্রতিটি ইবাদতের উদ্দেশ্য হল আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করা। যা সকল ইবাদতের প্রাণ। সুতরাং কারো ইবাদতে যদি ইখলাস থাকে, তাহলে তা যত ছোটই হোক আল্লাহ তাআলার নিকট অনেক পূণ্য ও প্রতিদানযোগ্য হয়। আর যদি বড় বড় ইবাদতেও ইখলাস না থাকে তবে তা একেবারেই মূল্যহীন।
ইখলাসের গুরুত্বের বিষয়ে একটি ঘটনা
আরবীতে কুরবানীর অর্থ হল, এমন বস্তু যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা হয়। আর ইখলাসের মাধ্যমেই আল্লাহর নৈকট্য অর্জিত হয়। সুতরাং যদি কেউ ছোট কোনো বস্ত্তও কুরবানী করে, আর তাতে ইখলাস থাকে তাহলে তা আল্লাহর নিকট মাকবুল ও গ্রহণযোগ্য হবে। আর যদি বড় বড় পশু কুরবানী করে, কিন্তু তাতে ইখলাস না থাকে, তাহলে এ কুরবানীর কোনোই মূল্য নেই।
সর্বপ্রথম হযরত আদম আলাইহিস সালামের দুই পুত্র কুরবানী করেন। একজনের নাম হাবিল, অপরজনের নাম কাবিল। কাবিল সুস্থ্য ও সবল একটি দুম্বা কুরবানী করেন। হাবিলের কোনো দুম্বা ছিল না। তখনকার সময় এ অনুমতিও ছিল, কুরবানী যদি নফল হয় আর পশু না থাকে তাহলে গম কুরবানী দেয়া যাবে। সে সময়ের নিয়ম ছিল আল্লাহ তাআলা যেই কুরবানী গ্রহণ করতেন, আসমান থেকে আগুন এসে তা জ্বালিয়ে দিত। আর আগুন না আসার অর্থ ছিল, কুরবানী কবুল হয়নি। হাবিল আর কাবিলের কুরবানীর মধ্যে হাবিলের কুরবানীকে আগুন এসে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। কাবিলের দুম্বাটি সেভাবেই পড়ে রইল। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
قَرَّبَا قُرْبَانًا فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنَ الْآخَرِ.
‘‘ [হাবিল আর কাবিল] তারা দু’জন কুরবানী করেছিল। তাদের একজনের কুরবানী কবুল হয়েছে। অপরজনের কুরবানী কবুল হয়নি।’’
-সূরা মায়িদা ৫ : ২৭
তখন কাবিল, যার কুরবানী কবুল হয়নি সে হাবিলকে বলল, আমি তোমাকে হত্যা করব। ঘটনা দীর্ঘ। বলার উদ্দেশ্য হল, বাহ্যিক দৃষ্টিতে কাবিলের কুরবানী ছিল অনেক দামি। আর হাবিলের কুরবানী খুবই সাধারণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও হাবিলের সাধারণ কুরবানী কবুল হল। বুঝা গেল ইখলাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
জীবনে প্রতিটি কাজই আল্লাহর জন্য হওয়া উচিত
স্মরণ রাখা দরকার, ইবদাতের মধ্যে ইখলাস আবশ্যক। যেমন কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي
‘‘আমার নামায, আমার কুরবানী’’
কিন্তু সামনে যে আশ্চর্য কথা বলা হয়েছে তা হল,
وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ.
‘‘আমার জীবন ও আমার মরণ সারা জাহানের রব আল্লাহর জন্য।’’
অর্থাৎ ইবাদত ব্যতিত জীবনের সাথে সম্পৃক্ত অন্য সকল কাজও রাববুল আলামীনের জন্য হওয়া উচিত। খাওয়া, পান করা, ঘুমানো, জাগ্রত হওয়া, উপার্জন করা, হাসা ও কথা বলা সবই আল্লাহর জন্য হওয়া উচিত। যদিও বাহ্যত মনে হয় এ সকল কাজ নিজের জন্য। কিন্তু যদি মানুষ ইচ্ছা করে, নিয়তকে শুধরে নিয়ে এ সকল কাজও আল্লাহর জন্য করতে পারে। সব কাজ যখন আল্লাহর জন্য হবে, সেগুলোও নেক আমলে পরিণত হবে এবং সেগুলোর জন্য পূণ্য ও প্রতিদান দেওয়া হবে।
নফসের হক
উদাহরণ স্বরূপ, মানুষ ক্ষুধার কারণে আহার করে। বাহ্যত তা তো খাদ্য গ্রহণ, প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ। তখন যদি একটু সময়ের জন্য কেউ ভাবে, আল্লাহ তাআলা আমার উপর আমার নফসের কিছু হক রেখেছেন। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
إن لنفسك عليك حقاً.
‘‘তোমার উপর তোমার নফসেরও হক রয়েছে।’’
নফসের হক হল, তাকে উপযোগী খাদ্য দেওয়া। কারণ এ নফস আমার মালিকানাধীন নয়। এটাও তাঁরই দান। আমার নিকট আমানতমাত্র। খাদ্যও তাকে এ নিয়তে দিতে হবে, যেন এর মাধ্যমে ইবাদতের শক্তি হয়। কোনো ব্যক্তির যদি ক্ষুধা লাগে, আর খাদ্য তার নিকট থাকার পরও না খেয়ে ক্ষুধার্ত থাকে। এ অবস্থায় ক্ষুধার কারণে তার মৃত্যু হয় তাহলে স্মরণ রাখবেন, সে গুনাহগার হবে। এ মৃত্যু একটি নিকৃষ্ট মৃত্যু বলে বিবেচিত হবে।
এ জীবন আল্লাহর আমানত
এর মাধ্যমে অনশনেরও হুকুম জানা গেল। অনেকে না খাওয়ার সংকল্প করে বসে। কারণ তারা নিজের জীবনকে তাদের মালিকানাধীন মনে করে। তাই যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই চলে। মানুষের মধ্যে এ ব্যাধিও আছে, যদি অনশন করা অবস্থায় কেউ মৃত্যুবরণ করে, তারা তাকে শহীদ বলতে থাকে- দাবী আদায়ের জন্য সে জীবন দিয়েছে। এটা মনেও হয় না সে হারাম মৃত্যু বরণ করেছে। কারণ, আল্লাহ তাআলার হুকুম ছিল, আমি এ জীবন তোমাকে দান করেছি আমানতের ভিত্তিতে, তার উপর তোমার কিছু হক রয়েছে। আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-
يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ.
‘‘হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্ত্ত থেকে আহার কর ও সৎকর্ম কর; তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আমি সবিশেষ অবগত।’’- সূরা মুমিনূন ২৩ : ৫১
এ প্রাণ আমি তোমাদেরকে এ জন্যই দান করেছি, যেন তোমরা তাকে ভাল ভাল আহার করাও এবং পাশাপাশি উত্তম থেকে উত্তম আমল কর। এ প্রাণ তোমাদেরকে এজন্য দেওয়া হয়নি, ক্ষুধার্ত রেখে তাকে ধ্বংস করবে। সুতরাং মানুষের এ চিমত্মা, আমার জীবন আমার মালিকানাধীন, সম্পূর্ণ ভুল। তাই আহার গ্রহণের সময় যদি এ নিয়ত করা হয়, আল্লাহর দেওয়া হুকুম পালনের জন্য আমি আহার করছি, তবে এ আমল আল্লাহর জন্য হবে এবং এ আমলের জন্য পূণ্য ও সাওয়াব হবে। খাওয়ার সময় এ নিয়তও করে নিন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আহার করতেন। বিরোধীরা আপত্তি তুলল, এ আবার কেমন নবী আমাদের মত আহার করে! আমাদের মত বাজারে চলাফেরা করে! কারণ, তারা মনে করত, আসমান থেকে কোনো ফিরিশতা নবী হয়ে আসবেন। যার পানাহারের প্রয়োজন হবে না। অথচ মানুষের নিকট নবী পাঠানো হয় যেন তারা বুঝতে পারে নবীগণ ভিন্ন কোন মাখলূক নন। তারা তোমাদেরই একজন। যত ধরনের চাহিদা ও ইচ্ছা তোমাদের আছে সব কিছুই তাদেরও আছে এবং তারা পানাহারও করেন। সুতরাং এ দৃষ্টিকোণ থেকে পানাহার করা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত।
খানা খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়ার কারণ
খানা খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়া উচিত। বিসমিল্লাহ পড়ার হুকুম এ জন্য নয় যে, বিসমিল্লাহ একটি মন্ত্র। বরং আমাদের মনোযোগ এ দিকে আকর্ষণ করার জন্য, যে আহার আমি গ্রহণ করছি তা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই গ্রহণ করছি। এ খাবার তাঁরই দান। তাঁরই আদেশ। তাঁর নবীর সুন্নাত। খাওয়া শেষে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া করব। দোয়া পড়ব।
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَطْعَمَنَا وَسَقَانَا…
তাহলে এ পানাহার আল্লাহ তাআলার জন্য হবে। তেমনই ঘুমের আমল। ঘুম বাহ্যিকভাবে প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ। তবে ঘুম যদি এ নিয়তে হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
إن لعينك عليك حقاً.
‘‘নিশ্চয়ই তোমার উপর তোমার চোখের হক রয়েছে।’’ (তবারানী আওসাত, হাদীস: ৭৬৩৩)
তাহলে এ ঘুমও আল্লাহ তাআলার জন্য হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই যে সরকারী এক মেশিন দান করেছেন। জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যমত্ম আমাদের সঙ্গ দিচ্ছে। তার না সার্ভিসের প্রয়োজন হচ্ছে, না তেলের প্রয়োজন হচ্ছে। সুতরাং এর হক হল তাকে একটু বিশ্রাম দেওয়া। এমনিভাবে পরিশ্রমের বাহ্যিক উদ্দেশ্য হল টাকা উপার্জন করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যদি নিয়ত করা হয়, আল্লাহ তাআলা আমার নফস ও আমার পরিবারের যে হকগুলো আমার উপর আবশ্যক করেছেন, তা সুচারুরূপে আদায় করার জন্য উপার্জন করারও প্রয়োজন আছে। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অন্যান্য ফরযের পর বড় ফরয হল হালাল উপার্জন করা। সুতরাং এ নিয়তের কারণে কাজকর্ম ও ব্যবসা-বাণিজ্যেও পূণ্য ও সাওয়াব হবে। মোটকথা, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যমত্ম জীবনের এমন কোনো কাজ নেই যেগুলোর নিয়তকে শুধরে নিলে আল্লাহর জন্য হয় না।
পরবর্তী অংশ:
আল্লাহর জন্য জীবন মরণ-২