ইসলামে দাম্পত্য জীবন

দাম্পত্য জীবনের সুখ-শান্তিতে পরিমিতিবোধের ভূমিকা অনেক। বরং চিন্তা-চেতনা ও আচার-আচরণে মাত্রানুগামিতা ছাড়া মধুর দাম্পত্য জীবন গড়ে তোলা সম্ভবই নয়। স্বামীরও দরকার নিজ অবস্থান ও দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে  মাত্রাসচেতন হওয়া এবং স্ত্রীরও কর্তব্য নিজ মর্যাদা ও দায়-দায়িত্বের পরিমাণ অনুধাবন করা। অতঃপর সেই চেতনা অনুসারে জীবন নির্বাহ করলে এবং দ্বিপাক্ষিক আচরণে তার চর্চা করলে তবেই একটি শান্তিপূর্ণ সংসার গড়ে উঠতে পারে।

প্রথমেই দরকার সংসার-যাত্রায় স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের ধরন নির্ণয় করা। তাদের সম্পর্ক কি কর্তা-ভৃত্যা বা কর্ত্রী-ভৃত্য-জাতীয় যে, একজন কর্তৃত্ব করবে আর অন্যজন হবে তার আজ্ঞাবাহী? নাকি তারা সমান্তরাল দুই অধিপতির মত, যাদের একজন অন্যজনের উপর আধিপত্য বিস্তারের সংগ্রামে লিপ্ত থাকবে? না তাদের মধ্যে এমন সখ্য-সম্প্রীতির সম্পর্ক যে, একে অন্যের সম্পূরক হিসেবে সহযোগিতামূলক আচরণ করবে এবং অন্যের লাভ-লোকসানকে নিজের লাভ-লোকসান ও অন্যের সুখ-দুঃখে নিজেকে হিস্যাদার গণ্য করবে? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদেরকে কুরআন মাজীদের শরণাপন্ন হতে হবে। দেখতে হবে কুরআন মাজীদ এ সম্পর্ককে কোন ভাষায় ব্যক্ত করেছে। আরও তাকাতে হবে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনাচারের দিকে। আমাদের সম্মানিতা ও পুতঃ-পবিত্রা মায়েদের সাথে-যাঁদের প্রতি উৎসর্গিত হই আমরা নিজেরা ও আমাদের গর্ভধারিণী স্নেহময়ী মায়েরা- প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আচরণ থেকে আমরা কী রকম সম্পর্কের ধারণা পাই? কুরআন মাজীদ বলছে-

وَمِنْ آَيَاتِهِ أَنْ خَلَقَ لَكُمْ مِنْ أَنْفُسِكُمْ أَزْوَاجًا لِتَسْكُنُوا إِلَيْهَا وَجَعَلَ بَيْنَكُمْ مَوَدَّةً وَرَحْمَةً إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

এবং তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি হল তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের সংগিনীদেরকে যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে’। -সূরা রূম : ২১

আয়াতে আল্লাহ তাআলা ‘স্ত্রী’-এর জন্য শব্দ ব্যবহার করেছেন زوج   অর্থাৎ ‘জোড়া’, সংগিণী, সম, সংযুক্ত ইত্যাদি। বাংলার স্ত্রী, পত্নী, ভার্যা ইত্যাদি অপেক্ষা অত্যন্ত শোভন ও তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ। এবং মজার কথা হল স্বামীর জন্যও কুরআন-হাদীস ও আরবী ভাষায় এই একই শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কেবল পাশাপাশি ব্যবহারের ক্ষেত্রে লিংগনির্দেশের উদ্দেশ্যে স্ত্রীর জন্য ة   যোগে زوجة বলা হয়ে থাকে। না হয় সাধারণভাবে স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকের জন্য زوج -ই প্রচলিত।

মানব জাতিতে সর্বপ্রথম যিনি স্ত্রীর পদমর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন, সেই আদিমাতা হযরত হাওয়া আলাইহাস সালামের জন্য কুরআন মাজীদে এ শব্দই ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর সৃজন-রহস্যের প্রতি ইংগিত করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন

هُوَ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَاحِدَةٍ وَجَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا لِيَسْكُنَ إِلَيْهَا

তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন একই ব্যক্তি হতে এবং তারই থেকে  তার সংগিনী ‘‘ম্নত্থ স্থির করেছেন, যাতে সে তার কাছে গিয়ে প্রশান্তি লাভ করতে পারে।’ (আরাফ: ১৮৯)
অর্থাৎ আদিমানব হযরত আদম আলাইহিস সালাম জান্নাতে নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছিলেন। জান্নাতের অফুরন্ত নি‘আমত এবং সুখ-শান্তির অগাধ উপকরণ সত্ত্বেও কিসের যেন তার অভাব। কী এক অনির্বচনীয় শূণ্যতা যেন তাকে ঘিরে ধরছিল। চারদিকে কত আনন্দের সমারোহ, কিন্তু ভেতরের আমোদ কই? সব আছে’র মধ্যেও কী এক ‘নেই’-এর আকুলতাই কেন এত বাজে? কেন বাজে এবং কিসের জন্য বাজে তা যার জানার কথা তিনি ঠিকই জানেন। কিন্তু আগে বাজতে দিলেন এবং পরে দিলেন ব্যবস্থা, যাতে ব্যবস্থাটির যথাযথ মূল্য উপলব্ধি হয়। সুতরাং তিনি সৃষ্টি করলেন হযরত হাওয়া আলাইহাস সালামকে। নিঃসঙ্গ জীবনে সংগিনী দান করলেন। একাকিত্বের যাতনা ঘুচিয়ে দিলেন। উষর প্রাণে সঞ্জীবনের ব্যবস্থা হল। এবার স্বস্তিতে শান্তিতে স্ফূর্তিতে উচ্ছলতায় দেহমন ভরিয়ে তোল। দোঁহে মিলে পরমানন্দে বাস কর জান্নাতে। তুমি ও তোমার যাওজ। তোমার জোড়া ও তোমার সংগিনী।

বস্ত্তত এই ‘যাওজ’ শব্দই দাম্পত্য সম্পর্কের ধরণ নিরূপিত করে দেয়। এটা স্পষ্ট করে দেয় যে, স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের জোড়া। তাদের সম্পর্ক প্রভুত্বমূলক নয়, প্রতিযোগিতামূলক নয় এবং তারা পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। বরং তারা দু’য়ে মিলে পূর্ণ এক, তারা একে অন্যের সম্পূরক। তাদের সম্পর্ক সখ্যের সম্পর্ক। তারা পরস্পর সখা-সখী।

‘যাওজ’-এর মধ্যে নিহিত সে ‘সখ্য’-ই ব্যাখ্যাত হয়েছে আয়াতের পরবর্তী অংশে। বলা হয়েছে ‘যাতে তোমরা তাদের নিকট শান্তি পাও এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও মমতা সৃষ্টি করেছেন।

বলাবাহুল্য সম্পর্ক যেখানে কর্তৃত্বসুলভ সেখানে দেহের আরাম যতই হোক মনের শান্তি কখনও আশা করা যায় না। এমনিভাবে ভালোবাসা ও প্রেমপ্রীতির বিনিময়ও সেখানে হতে পারে না। আর প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্কের সাথে তো শান্তি ও প্রেমপ্রীতি যায়ই না। তা যায় কেবল সখ্যেরই সাথে, দুই নর-নারী যদি হয় সমস্তরের, সম্পর্কটা হয় সখ্যের, মৈত্রীর, সত্যিকারের ভালোবাসা সেখানেই সম্ভব আর সেটাই হতে পারে শান্তির ঠিকানা।

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর পুণ্যবতী স্ত্রীদের সাথে যে হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ করতেন তাও এই সখ্যেরই ধারণা দেয়। তিনি তাঁদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করতেন, তাঁদের অনুভব-অনুভূতির মূল্যায়ন করতেন, তাঁদের যুক্তিযুক্ত পরামর্শ গ্রহণ করতেন, গৃহস্থালির কাজে তাঁদের সাহায্য করতেন, তাঁদের মান-অভিমান ও তাঁদের সাথে খুনসুটিকে উপভোগ করতেন, তাঁদের সাথে গল্প করতেন ও হাস্যরসে যোগ দিতেন, এমনকি উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা.-এর সাথে দৌঁড় প্রতিযোগিতা পর্যন্ত দিয়েছিলেন। এসবই প্রমাণ করে স্ত্রী হিসেবে তাঁদেরকে কতটা সম্মানজনক স্থানে রেখেছিলেন। এবং তাঁরাও নিজেদেরকে তাঁর দাসী-চাকরানী নয়; বরং প্রাণের সখীই ভাবতেন। এটা ভিন্নকথা যে, আল্লাহ তাআলার মহান রাসূল হিসেবে এবং তাঁর অনুপম আখলাক-চরিত্র ও অনন্য সাধারণ আচার-ব্যবহারের কারণে তাঁরা ছিলেন তাঁর প্রতি উৎসর্গিতপ্রাণ; তাঁর অত্যুঙ্গ মহিমার সামনে নিজেদেরকে তাঁর দাসী-বাদী গণ্য করাকেও গৌরবজনক মনে করতেন। আজও তো দুনিয়ার মুসলিম নর-নারী নিজেদেরকে নবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর গোলাম-বাঁদী বলতেই গর্ববোধ করে।

এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ, কথা হচ্ছে একান্তই দাম্পত্য-সম্পর্ক নিয়ে। সেদিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা এ শিক্ষাই পাই যে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক হবে সখ্যসুলভ। জীবনের উৎকর্ষ সাধনে, সুখের সংসার নির্মাণে, বিস্তৃত কর্মজীবনে তারা হবে পরস্পর সহযোগী। কে বড়, কে ছোট সে প্রশ্ন অবান্তর; তারা দু’জনেই দু’জনার বড় আপনার।
আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) ‘তারা (স্ত্রীগণ) তোমাদের পরিচ্ছদ এবং তোমরা (স্ত্রীদের) তাদের পরিচ্ছদ’।-সূরা বাকারা : ১১৭

অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর একের প্রতি অন্যের প্রয়োজন ঠিক পোশাকেরই মত। পোশাক ছাড়া কোন মানুষ চলতে পারে না। পোশাক তার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। ঠিক তেমটি কোন পুরুষ স্ত্রী ছাড়া এবং কোন নারীও স্বামী ছাড়া চলতে পারে না। একের প্রতি অন্যের ঠেকাটা পোশাকেরই মত। পোশাক দ্বারা শরীরের হেফাজত হয়, লজ্জা নিবারণ হয়, শীত ও তাপ থেকে শরীর রক্ষা পায়, দৈহিক সৌন্দর্য বর্ধন হয়, ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে ও সামাজিক মান-মর্যাদা রক্ষা হয়। অনুরূপ স্বামী দ্বারা স্ত্রীর ও স্ত্রী দ্বারা স্বামীর চরিত্র হেফাজত হয়, সামাজিক লজ্জা-শরম নিবারণ হয়,  সময়ের হেফাজত হয়, স্বাস্থ্য রক্ষা পায় এবং পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের বিকাশ হয়। তারা একে অন্যের শোভা এবং আরও অনেক কিছু। কাজেই এখানে উত্তম-অধম ও বড় ছোটর কোন প্রশ্ন নেই। তারা দু’জন মিলে একটি জোড়া, একটি দম্পতি। তাতে দু’জনের দু’টি পদমর্যাদা। একটি স্বামিত্বের একটি স্ত্রীত্বের এবং এ হিসেবে দু’জনই সমমর্যাদার; কারও উপর কারও শ্রেষ্ঠত্ব নেই।

হাঁ যূথবদ্ধ জীবনে নেতার দরকার পড়ে। মানব ও মানবেতর সকল প্রাণীর মধ্যেই এটা এক স্বাভাবিক নিয়ম। নেতা ছাড়া কোন যৌথ কারবার চলে না। কোন দল-গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। কোন সমাজ ও রাষ্ট্রের অস্তিত্ব লাভ হয় না। সংঘবদ্ধ কোনও কিছুই কারও নেতৃত্ব ছাড়া এগুতে পারে না। তাই শাশ্বতকাল থেকেই পরিবার ও সমাজ নেতৃত্বকে মেনেই চলে আসছে।

কাউকে নেতা মানা হয় তার নেতৃত্বের গুণাবলী বিচারে। এটা বাড়তি গুণ, যা সকলের থাকে না। যার থাকে সে নেতা হিসেবে বরিত হয়, কিন্তু এর ভিত্তিতে সে সার্বিকভাবে শ্রেষ্ঠ হয়ে যায় না। মানুষ সার্বিক শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে তার মানবিকতার চর্চা দ্বারা। যে ব্যক্তি সত্য কথা বলে, সৎ জীবন যাপন করে, সত্য-সঠিক পথে চলে মানুষ হিসেবে সেই শ্রেষ্ঠ। এসব গুণের কারণে একজন লোক দলপতি না হয়েও শ্রেষ্ঠ হতে পারে, আবার এর অভাবে একজন দলপতিও অধম গণ্য হতে পারে।

মানবিকতা চর্চার চালিকাশক্তি হল তাকওয়া-আল্লাহভীতি। সুতরাং যার মধ্যে তাকওয়া আছে সব বিচারে সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ।
আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা)  ‘আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সে-ই বেশি মর্যাদাবান, যে বেশি তাকওয়ার অধিকারী’।-সূরা হুজুরাত : ১৩

কাজেই তাকওয়ার ভিত্তিতে একজন নেতা অপেক্ষা তার অধীন ব্যক্তি বেশি মর্যাদাবান হতে পারে এবং একজন নারী বহু পুরুষকে ডিঙিয়ে যেতে পারে। এর দুয়ার সকলের জন্য উন্মুক্ত।

সুতরাং নেতৃত্বকে মর্যাদার মাপকাঠী মনে করা ভুল। এই ভুল চিন্তাই মানুষের মধ্যে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার মোহ সৃষ্টি করে, যার পরিণতিতে নেতৃত্বই পতন ও অধঃপতনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বস্ত্তত নেতৃত্ব একটা দায়িত্ব, যেমন আনুগত্যও একটা দায়িত্ব। নেতার কাজ অধীনস্তের যথাযথ পরিচালনা করা আর অধীনস্তের কাজ নেতার বৈধ হুকুম মেনে চলা। উভয়ের আপন আপন কাজে যত্নবান থাকাটাই যথার্থ দায়িত্বশীলতা। এ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়ার দ্বারাই সব রকমের নির্মাণ ও উন্নয়ন সম্ভব হয়। পারিবারিক নির্মাণ-উন্নয়নও এর ব্যতিক্রম নয়।

মানব-দাম্পত্যে পুরুষকে নেতা বানানো হয়েছে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ,
(তরজমা)  ‘পুরুষগণ নারীদের তত্ত্বাবধায়ক’।-সূরা নিসা : ৩৪

এ দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত হয়েছে এক্ষেত্রে তার উপযুক্ততা বিবেচনায়। আল্লাহ তাআলা তাকেই এ কাজের উপযুক্ত করে বানিয়েছেন, যেমন নারীকেও তার সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য উপযুক্ত বানিয়েছেন। এ বিশ্ব সংসারের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য যার দ্বারা যে কাজ নেওয়া দরকার বিশ্বপতি তাকে তার যোগ্যতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। কার দ্বারা তিনি কী কাজ নেবেন সেটা তাঁর ইচ্ছা। এখানে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। প্রশ্ন তোলা বাতুলতা।

মানব-প্রজন্ম বিস্তারের জন্য আল্লাহ তাআলা নারীকে মা করে বানিয়েছেন। তাই গর্ভে সন্তান ধারণ ও শিশু-সন্তানের পরিচর্যার জন্য যে সুকুমার গুণাবলীর দরকার ছিল তা দিয়েই তিনি নারীকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার দেহমনকে এর উপযোগী করেই বানিয়েছেন। সেই সাথে মা যাতে তার আপন দায়িত্ব সুচারুরূপে পালনে যত্নবান থাকতে পারে সে জন্য তার নিজের ও সন্তানের সুরক্ষাসহ অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান প্রভৃতি প্রয়োজন সমাধার ভার থেকে তার মুক্ত থাকার দরকার ছিল। সুতরাং তাকে মুক্ত রেখে আল্লাহ তাআলা এ ভার অর্পণ করেছেন পুরুষের উপর আর এজন্য যে যোগ্যতা ক্ষমতা দরকার ছিল তা দিয়েই তিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন। এ সুবাদেই সে নারীর কর্তা ও তত্ত্বাবধায়ক। ইরশাদ হয়েছে,

الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللَّهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ

(তরজমা) অর্থাৎ পুরুষ নারীর তত্ত্বাবধায়ক এ কারণে যে, আল্লাহ তাদের কতককে (যোগ্যতা ও ক্ষমতায়) কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং এ কারণে যে, তারা তাদের অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে।-সূরা নিসা : ৩৪

স্বামী যখন নেতা ও তত্ত্বাবধায়ক, তখন স্ত্রীর কর্তব্য তার আনুগত্য করা। কিন্তু স্ত্রীদের অনেকেই এ ব্যাপারে সচেতন নয়। তারা সীমালঙ্ঘন করে, নিজ দায়িত্বের সীমানা ডিঙিয়ে স্বামীদের দায়িত্বে হস্তক্ষেপ করে। এটা একটা বাড়াবাড়ি ও মধ্যপন্থার লংঘন। প্রত্যেকের আপন সীমানার মধ্যে থাকাটাই মধ্যপন্থা এবং এতেই সকলের কল্যাণ। এর লংঘন সকলের জন্যই ক্ষতিকর। পরিবারগুলোতে যে অশান্তি বিরাজ করছে তার একটা কারণ এইও যে, স্ত্রীরা স্বামীর আনুগত্য করতে রাজি নয়, তারা চায় নেতৃত্ব তাদের হাতে থাকবে এবং স্বামীসহ সকলে তাদের হুকুমে চলবে এটা এক রকম কর্তৃত্ববাদিতা। কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা কখনও কল্যাণ বয়ে আনে না। যেই স্বামীকে তত্ত্বাবধায়ক বানানো হয়েছে, এ মানসিকতা তার জন্যও অশোভন ও পরিত্যাজ্য। সেখানে স্ত্রীর কাজ যখন স্বামীর আনুগত্য করা, তখন এ মানসিকতা তো তার পক্ষে কিছুতেই মানানসই নয়। সুতরাং স্ত্রীদেরকে সকলের শান্তি ও কল্যাণের খাতিরে অবশ্যই আপন সীমানার মধ্যে থাকতে হবে। তাকে স্বামীর আনুগত্য করতে হবে। এটা তার প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব। দায়িত্ব পালনে কোন ক্ষুদ্রতা নেই। এটা লজ্জার নয়; বরং দায়িত্বশিলতাতেই প্রকৃত গৌরব। সুতরাং আল্লাহ তাআলা পুণ্যবতী নারীদের প্রশংসা করে বলেন, (তরজমা) ‘অর্থাৎ পুণ্যবতী নারীগণ হয় আনুগত্যকারী এবং আল্লাহ (স্বামীদেরকে দায়িত্বশীল করার মাধ্যমে তাদের) যে হেফাজতের ব্যবস্থা করেছেন, সে জন্য তারা (স্বামীর) অনুপস্থিতিতে (নিজ সতীত্ব ও স্বামীর অন্যসব অধিকারের) হেফাজত করে।-সূরা নিসা : ৩৪

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (অর্থ) ‘শ্রেষ্ঠ নারী সেই, যার দিকে তাকালে সে তোমাকে আমোদিত করে, যাকে তুমি কোন আদেশ করলে সে তোমার আনুগত্য করে এবং তোমার অনুপস্থিতিতে অর্থ-সম্পদ ও তার নিজ সত্ত্বার দিক থেকে তোমাকে নিরাপত্তা দেয়।-মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ৮৫৩৭; মুসনাদে তায়ালিসী, হাদীস : ২৩২৫; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস : ৮৯৬১

প্রকাশ থাকে যে, আধুনিক নারীবাদ প্রগতির নামে নারীদের মধ্যে হীনম্মন্যতাবোধ সৃষ্টি করছে। ধারণা দেওয়া হচ্ছে পুরুষের নেতৃত্ব স্বীকার তাদের পক্ষে অবমাননাকর। কারও নের্তৃত্বস্বীকার যদি অবমাননাকর হয় তবে এটা পুরুষে নারীতে কেন পুরুষে পুরুষেও তো হতে পারে। আর এ বিবেচনায় জগত থেকে নের্তৃত্বের পাঠকে ঘুচিয়ে ফেলতে হবে, যার পরিণাম চরম নৈরাজ্য ও মানবতার কিয়ামত। সে পরিণাম থেকে রক্ষার জন্যই নের্তৃত্বের বন্দোবস্ত। কাজেই এর জন্য ঈর্ষাকাতর না হয়ে আপন পদমর্যাদার মূল্যায়ন করাই যথার্থ। ইরশাদ হয়েছে, (তরজমা) ‘যা দ্বারা আল্লাহ তোমাদের কারও উপর কারও শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন তোমরা তার লালসা করো না। পুরুষ যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য এবং নারী যা অর্জন করে তা তার প্রাপ্য অংশ। বরং তোমরা আল্লাহর কাছে তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ।-সূরা নিসা : ৩২

অর্থাৎ তিনি জানেন কাকে দিয়ে কি দায়িত্ব পালন করাতে হবে এবং সে হিসেবেই তিনি যোগ্যতা, ক্ষমতা ও অর্থ-সম্পদ বণ্টন করেছেন। কাজেই এ ব্যাপারে অন্যকে কি দেওয়া হয়েছে সেদিকে না তাকিয়ে তোমাকে যা দেওয়া হয়েছে তাতে সন্তুষ্ট থাক। বরং তোমরা প্রত্যেকে আপন আপন যোগ্যতা অনুযায়ী আপন পরিমন্ডলে নিজ দায়িত্ব পালনে রত থাক ও তার মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ প্রার্থনা কর। তাঁর অনুগ্রহ তথা আখিরাতের কল্যাণলাভে নারী-পুরুষের কোন ভেদাভেদ নেই। প্রত্যেকে তার কর্ম অনুযায়ী ফল পাবে।

অনুরূপ পুরুষেরও কর্তব্য তার তত্ত্বাবধানকার্যকে যথাযথভাবে আঞ্জাম দেওয়া। মনে রাখতে হবে এটা তার আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব। এটা অহংকারের বিষয় নয়; বরং পালন করার বিষয়। অধিকাংশ পুরুষ তাদের এ দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন নয়। তারা স্বামিত্বের অন্ধ অহমিকায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে। এভাবে নারীর প্রতি কেউ তো দৈহিক এবং অধিকাংশে মানসিক নির্যাতন চালায়।

স্বামীকে নেতা ও তত্ত্বাবধায়ক বানানোর অর্থ এ নয় যে, স্ত্রীর উপর সবকিছুতে নিজ কর্তৃত্ব খাটানোর চেষ্টা করবে এবং স্ত্রীকে তার হুকুমের দাসী বানিয়ে রাখবে। এটা স্ত্রীর পদমর্যাদার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। যাওজিয়াত ও দাম্পত্য সম্পর্কেরও পরিপন্থী। সেই সংগে স্বামিত্বের চরম বাড়াবাড়ি ও নের্তৃত্বের অপব্যবহার।

স্বামীকে অবশ্যই তার তত্ত্বাবধানকার্যে পরিমিতিবোধের পরিচয় দিতে হবে। এজন্য কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়-

এক. মানুষ হিসেবে স্ত্রীর মর্যাদা রক্ষা : মানুষমাত্রকেই আল্লাহ তাআলা মর্যাদাবান করেছেন। মনুষ্যত্বের সে মর্যাদায় নারী-পুরুষের কোন প্রভেদ নেই। আল্লাহ তাআলা সাধারণভাবেই বলেছেন, (তরজমা) ‘আমি আদম-সন্তানকে মর্যাদাবান করেছি।-সূরা বনী ইসরাঈল : ৭০

সুতরাং স্ত্রীর সাথে এমন কোন আচরণ করা যাবে না, যা তার মানবিক মর্যাদার পরিপন্থী।

দুই. স্ত্রীর সামাজিক মর্যাদা রক্ষা : আপন-আপন স্তরে সব মানুষের একটা সামাজিক মর্যাদা আছে। স্ত্রীও তার ব্যতিক্রম নয়। স্ত্রীর সে মর্যাদাকে অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। এমন সব আচরণ পরিত্যাজ্য, যা সমাজ-চোখে তাকে ছোট করতে পারে বা যা দ্বারা সে অন্যের সামনে নিজেকে অপমানিত বোধ করতে পারে।

তিন. তার মাতৃত্বের মর্যাদা দান : ইতোমধ্যে যদি সে মা হয়ে গিয়ে থাকে, তবে তার মাতৃত্বের মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন থাকা কর্তব্য। এবং এটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অধিকাংশ স্বামী এ বিষয়ে সচেতন নয়। স্বামী ও পিতা হিসেবে তারা নিজেদেরকে এতটা উর্ধ্বের মনে করে যে, অন্যের মান-মর্যাদার কোন তোয়াক্কা করে না। সন্তানটি যে তার একার নয়, স্ত্রীরও; বরং সন্তানের জন্ম ও লালন-পালনে তারও ভূমিকা আছে এবং বেশি পরিমাণেই আছে সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করা হয় না। এটা এক নির্মম অবিচার। তদপেক্ষাও কঠিন অবিচার হল সন্তানের সামনে তার মাকে তিরস্কার করা। এটা স্বামিত্বের চরম সীমালংঘন। ভুলত্রুটি যে কারও দ্বারাই ঘটতে পারে। সব ভুল স্ত্রীরই হবে এটা কোন কথা নয়। কর্তৃত্ববাদিতার অন্ধত্বে নিজের দোষটা সহজে চোখে পড়ে না। তাই অন্যকে শাসনের ক্ষেত্রে আমরা বড় বেপরোয়া। তাই অন্যকে তার প্রিয়জনদের সামনে শাসন করে কেবল তাকেই অপমানিত করি না, নিজেকেও ছোট করে ফেলি। এ ব্যাপারে স্বামীদের বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন।

চার. আবেগ-অনুভূতির মূল্যায়ন : স্বামী যেমন চায় স্ত্রী তার আবেগ-অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখাক। তেমনি স্ত্রীরও তা কাম্য। তারও আবেগ-অনুভূতি আছে। সেদিকে লক্ষ্য রাখা স্বামীর কর্তব্য। কিন্তু অধিকাংশ স্বামী এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করে। স্ত্রী যেন এক জড়বস্ত্ত। সে যখন একজন জলজ্যান্ত মানুষ, তখন ভাবাবেগ তো তারও সহজাত। সুন্দর ও শোভনের প্রতি অনুরাগ ও অসুন্দর-অশোভনের প্রতি বিরাগ তার থাকবেই। বসন্তের পেলব মধুর বাতাস স্বামীকে যদি আকুল করে তাকে কেন করবে না? কিংবা কোন অনাকাঙ্ক্ষিতের মুখোমুখিতায় সেও বা কেন বিমর্ষ হবে না? হর্ষ-বিপদ ও মান-অভিমান যদি তার নাই থাকে, তবে তার কাছে কোন কিছুর আশা করা কেন? যার কাছে কোন প্রাপ্তির আশা থাকবে তার মান-অভিমানকে সম্মান করতে হবে। এতে ভারসাম্য রক্ষা হয় এবং এতেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আশানুরূপ হয়।

প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথেও কি আমাদের মহিয়সী মায়েদের মান-অভিমানের পালা চলত না? হাদীসগ্রন্থসমূহে এরূপ একাধিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি কখনও তাকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতেন না। রসজ্ঞ  নবী তার ভেতর দাম্পত্যের মাধুর্যই খুঁজে পেতেন। তাই তো তার মুগ্ধ-মধুর অভিব্যক্তি শুনি-‘আয়েশা! কখন তুমি অভিমানে থাক আর কখন প্রসন্ন, আমি ঠিক বুঝতে পারি। জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে? বললেন, অভিমানকালে তুমি শপথ কর ‘ইবরাহীমের রবব’ বলে, আর প্রসন্নতার সময় ‘মুহাম্মাদের রবব’ বলে। আম্মাজান হয়ত খানিকটা লজ্জা পেলেন। বললেন, ‘ওই নামটুকুই যা উচ্চারণ করি না (না হয় তখনও আপনার সত্ত্বা আমার হৃদয়জুড়ে বিরাজমান থাকে)।

দোজাহানের সর্দার তো তাঁর প্রিয় স্ত্রীর সাথে দৌঁড় প্রতিযোগিতাও দিয়েছেন। হাবশীদের সামরিক কসরত দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। শৈশবে খেলার সংগীদের ডেকে খেলতে দিয়েছেন। আমাদের জানা-অজানা আরও কত ঘটনাই না আছে, যা আমাদেরকে বয়সভেদে স্ত্রীর রুচি-অভিরুচি, মন-মানসিকতা ও যাবতীয় বোধ-অনুভবকে সম্মান জানাতে শেখায়।

পাঁচ. মতামতের গুরুত্বদান : স্ত্রীর মতামতের ক্ষেত্রে দ্বিবিধ প্রান্তিকতা লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তিত্বহীন বা দুর্বলচিত্ত লোকেরা বাইরে দোর্দন্ড প্রতাপশালী হলেও যে কোনও কারণে স্ত্রীর কাছে মেরুদন্ডহীন। এ শ্রেণীর স্বামীরা স্ত্রীর মতামতকে আদালতী সিদ্ধান্তের মত শিরোধার্য করে নেয়। তার মত যুক্তিসিদ্ধ কি না কিংবা শরীআতের বিচারে তা গ্রহণযোগ্য কি না, তা গ্রহণ করলে অন্য কারও অধিকার র্খব হয় কি না বা তাতে দ্বীন-দুনিয়ার কোন ক্ষতি আছে কি না, এসব ভেবে দেখে না। এটা শৈথিল্যমূলক প্রান্তিকতা। এরূপ স্ত্রীপরবশতা বা স্ত্রী-অভিমতের নির্বিচার আনুগত্য কারও পক্ষেই মঙ্গলজনক হয় না। স্বামী-স্ত্রী নিজেরাও তাতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, সেই সাথে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন জ্ঞাতি-গোষ্ঠী এবং ব্যক্তির সামাজিক মান-মর্যাদার বিস্তার অনুযায়ী বিস্তৃত পরিমন্ডলে সে ক্ষতি সংক্রমিত হয়। সুতরাং এজাতীয় প্রান্তিকতা পরিত্যাজ্য।

অপরদিকে এক শ্রেণীর লোক স্ত্রীর মতামতকে গ্রাহ্যই করে না। স্ত্রীর যেন কোন মতামত থাকতে পারে না। সে এমনই কলের পুতুল যে, কোনও রকম স্বকীয়তা তার সাথে বেমানান এবং পরমতচারিতাই তার ভূষণ। অর্থাৎ তুমি যখন আমার স্ত্রী হয়ে এসেছ, এখন আমার মতের বাইরে তোমার নিজস্ব কোন মত থাকতে পারবে না। এটা নেতৃত্বের বাড়াবাড়ি ও স্বামিত্বের সীমালংঘন।

স্ত্রী যখন জোড়ার একজন ও স্বামীর সংগিনী, তখন মত প্রকাশের অধিকার তারও আছে। হাঁ নেতা স্বামী বিচার করে দেখবে সে মতের পেছনে যুক্তি কতটুকু। অতপর যুক্তিসিদ্ধ মনে হলে গ্রহণ করবে তা না হলে যুক্তি-প্রমাণ দিয়ে তার দুর্বলতা বুঝিয়ে দেবে। এটাই পরিমিতিবোধের দাবি। স্ত্রীর মতে একদমই কর্ণপাতই করবে না বা ছিঃছিক্কার করে তা উড়িয়ে দেবে-এটা নেতৃসুলভ, বিশেষত স্বামীসুলভ আচরণ নয় কিছুতেই। বরং সংসার যাত্রায় স্ত্রীর সাথে মতবিনিময় করা ও পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই দাম্পত্য ও পারিবারিক শান্তির পক্ষে বেশি সহায়ক।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বাইরের বিষয়েও স্ত্রীর যৌক্তিক পরামর্শকে মূল্য দিয়েছেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির পর যখন ইহরাম ভাঙ্গার পালা আসল, তখন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশ সত্ত্বেও তাঁর উৎসর্গিতপ্রাণ সাহাবীগণ মাথা কামাতে প্রস্ত্তত হচ্ছিলেন না (হয়ত তাদের আশা ছিল আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে ভিন্ন কোন আদেশ নাযিল হবে।) বোধ করি তাঁর নবুওয়াতী জীবনের কঠিনতম মুহূর্ত ছিল এটি। তাঁর হাতে গড়া মহান জামাত, যারা তাঁর হুকুমে সাগরে ঝাঁপ দিতেও প্রস্ত্তত থাকে, তারা কি না আজ তাঁর হুকুম মানতে অগ্রসর হচ্ছে না। এ রকম পরিস্থিতি তাঁর জীবনে এই প্রথম। তিনি পেরেশান হয়ে তাঁবুতে চলে গেলেন। আমাদের ধীমতি মা হযরত উম্মু সালামা রা. সব শুনে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! পেরেশান হবেন না। কাউকে কিছু না বলে আপনি গিয়ে আগে নিজের মাথা কামিয়ে ফেলুন। তিনি তাঁর পরামর্শের যুক্তি উপলব্ধি করলেন। পত্রপাঠ গিয়ে নিজের মাথা কামিয়ে ফেললেন। আর কে বসে থাকে! আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই যখন ইহরাম ভেঙ্গে ফেলেছেন, আর কে না ভেঙে পারে? অবিলম্বে সকলেই মাথা কামিয়ে ফেললেন। এভাবে উম্মুল মুমিনীনের পরামর্শ গ্রহণ দ্বারা এক কঠিন জটিলতার অবসান হয়ে গেল। বোঝা গেল, ক্ষেত্রবিশেষে স্ত্রীর পরামর্শ অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে ওঠে। তাই বিলকুল অগ্রাহ্যও নয় এবং নির্বিচারে গ্রহণও নয়; বরং পরিমিতিবোধের সাথেই স্ত্রীর অভিমতকে মূল্যায়ন করা চাই। দাম্পত্য সুখ সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি।

ছয়. ত্রুটিবিচারে মাত্রানিষ্ঠা : ভুল-ত্রুটি মানুষ মাত্রেরই হয়। যাদের সাথে ঘনিষ্ঠতা কম, তাদের ভুল-ত্রুটি নজরে আসে কম। দাম্পত্য-ঘনিষ্ঠতার কারণে স্বামী-স্ত্রীর চোখে পরস্পরের দোষ-ত্রুটি বেশিই চোখে পড়ে। তাই চিন্তার সংকীর্ণতাবশত অনেক দম্পতির চোখে তাদের পরস্পরকে অনেক বেশি মন্দ মনে হয়। ফলে একের প্রতি অন্যে শ্রদ্ধা হারায় এবং যে কোন ভুল-ত্রুটি নিয়ে তাদের মধ্যে নিত্যদিন কলহ লেগেই থাকে।

এর থেকে নিস্তারের উপায় কি?

নিস্তারের উপায় একটাই। পরিমিতিবোধসম্পন্ন হয়ে যাওয়া, দৃষ্টিতে মাত্রানিষ্ঠ হওয়া ও চিন্তায় ভারসাম্য রক্ষা করা। কোন দোষ চোখে পড়লে প্রথমেই চটে না গিয়ে প্রথমে দোষের মান ও পরিমাণ বিবেচনা করা চাই। তার সাথে নিজের প্রতিও দৃষ্টিপাত করা দরকার। ছোট বড় নানা দোষ আমার মধ্যেও কি নেই? আমার সব কাজই কি সুষ্ঠু-নিখুঁত হয়? লক্ষ্য করলে অজস্র ভুল-ত্রুটি নিজের মধ্যেই দেখতে পাব। এ অবস্থায় অন্যের দোষে ক্ষিপ্ত হওয়া কতটুকু শোভন?

হাঁ, সংশোধন নিজেরও দরকার, তারও দরকার। সেক্ষেত্রেও নরম-গরম যে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণে দোষের মাত্রা বিবেচনায় রাখতে হবে। সর্বাবস্থায়ই মনে রাখা চাই মমতার সাথে বোঝানোর মত কার্যকরী কোন ওষুধ নেই।

দোষ-ত্রুটির ক্ষেত্রে আরও একটা বিষয় লক্ষণীয়। সংগী বা সংগিনীর কোন দোষ নজরে আসলে তার গুণগুলো যেন দৃষ্টির আড়াল না হয়ে যায়। দোষের সাথে গুণের দিকেও যদি চোখ ফেরানো যায়, তবে বিবেচনার ভারসাম্য আসবে। তখন দোষকে তুচ্ছ মনে হবে। কেননা তুলনা করলে দেখা যাবে দোষের বিপরীতে গুণের পাল্লাই ভারী। বিশেষভাবে স্বামীর জন্য এ নীতি অবলম্বন অতীব জরুরি। নেতৃত্ব হাতে থাকায় সীমালংঘনের সম্ভাবনা তারই বেশি। তাই স্বামীকেই আদেশ করা হয়েছে,  (তরজমা) ‘তাদের সাথে জীবন-যাপন করবে ন্যায়নিষ্ঠভাবে। তোমরা যদি তাকে অপসন্দ কর, তবে এমন হতেই পারে যে, তোমরা কোন কিছুকে অপসন্দ করছ, অথচ আল্লাহ তার ভেতর প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন’।-সূরা নিসা : ১৯

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, (অর্থ) ‘কোন মুমিন ব্যক্তি যেন তার মুমিন স্ত্রীকে ঘৃণা না করে, তার কোন একটা চরিত্র তার অপসন্দ হলে আরেকটা ঠিকই মনঃপুত হবে।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪৬৯; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৮৩৬৩

অর্থাৎ তার মধ্যে অপসন্দনীয় কিছু দেখতে পেলে যেন দৃষ্টি প্রসারিত করে দেয়। তাহলে পসন্দনীয় বিষয়ও পেয়ে যাবে। ইংগিত করা হচ্ছে যে, সম্পূর্ণ নির্দোষ কোন মানুষ পাওয়া কঠিন। সে রকম খুঁজতে গেলে জীবনভর নিঃসঙ্গই থাকতে হবে এবং নিজেকেও বাতিল গণ্য করতে হবে। সুতরাং মাত্রাজ্ঞানের দাবি হল দোষের বিপরীতে গুণকেও দেখা, দোষের মান নির্ণয়ে ন্যায়নিষ্ঠ থাকা এবং তার সংশোধন প্রক্রিয়ায় ভারসাম্য রক্ষা করা।

Leave a Comment

Your email address will not be published.