ইসলামে বিদআতের উৎপত্তি যেভাবে-১

বিদআত

বিদআতের উৎপত্তি যেভাবে, ইসলামে মধ্যমপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব:

মাত্রাজ্ঞানের অভাব থেকেই উম্মতের মধ্যে নানা রকম রসম-রেওয়াজ ও বিদ‘আতের সৃষ্টি হয়েছে। কুফর ও শিরকের পর বিদআতই ইসলামে সর্বাপেক্ষা নিন্দনীয় জিনিস। এর উদ্ভাবক ও অনুসারী নিজের জন্য ছওয়াবের পরিবর্তে লানত ও অভিশাপই কুড়িয়ে থাকে। হাদীস মতে জাহান্নামই বিদ‘আতের শেষ ঠিকানা। সব বিদ‘আত গোমরাহী আর সব গোমরাহীর ঠাঁই জাহান্নামে। এহেন নিকৃষ্ট জিনিসের জন্ম হয় বাড়াবাড়ি থেকেই।
কেবল মুবাহ ও বৈধ স্তরের জিনিসকে এক শ্রেণীর মানুষ খেয়াল-খুশী ও ভাবাবেগের বশবর্তীতে সুন্নত-ওয়াজিবের মত গুরুত্ব দিয়ে বসে। তারা সেই গুরুত্বের সাথে নিজেরাও তা পালন করে এবং অন্যদেরকেও পালন করতে উৎসাহিত ও ক্ষেত্র-বিশেষে বাধ্য পর্যন্ত করে। ফলে যা মূলত দ্বীনের অংশ নয় তা দ্বীনের একটি অংশরূপে পরিচিতি পায় কিংবা যা দ্বীনের যেই স্তরের নয় সেই স্তরের একটি কাজরূপে ধরে নেওয়া হয়। এভাবে পূর্ণাঙ্গ দ্বীনের ভেতর নবসংযোজন রূপে বিদআতের অনুপ্রবেশ ঘটে।
সুতরাং প্রচলিত মীলাদ, ১২ই রবীউল আউওয়ালে ঈদে মীলাদুন নবী উৎযাপন, মৃত ব্যক্তির জন্য চল্লিশা, হযরত আব্দুল কাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির মৃত্যু দিবস (ফাতেহায়ে ইয়াযদহম) পালন, বুযুর্গানে দ্বীনের কবরে ওরশ ইত্যাদি মৌলিক বৈধ বিষয়সমূহে এক শ্রেণীর মানুষ মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে এগুলোকে দ্বীনের অংশ বানিয়ে ফেলেছে। তাদের দৃষ্টিতে এসব কাজ ফরয-ওয়াজিব অপেক্ষা কম কিছু নয়। এহেন বাড়াবাড়ির কারণে এসব কাজ তার মূল বৈধতা হারিয়ে বিদ‘আত ও নিষিদ্ধ কাজে পর্যবসিত হয়েছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্পষ্ট ঘোষণা ‘কেউ আমাদের দ্বীনে যদি এমন কোন নতুন বিষয়ের উদ্ভাবন করে, যা এ দ্বীনের অংশ নয়, তবে তা প্রত্যাখ্যাত হবে।’ (সহীহ বুখারী, হাদীস : ২৬৯৭)
বলাবাহুল্য এ জাতীয় বাড়াবাড়ি দ্বারা প্রকারান্তরে দ্বীনের ভেতর নতুন উদ্ভাবনই ঘটানো হয়। যা কেবলই বৈধ, তাকে ওয়াজিব ও জরুরি সাব্যস্ত করার দ্বারা দ্বীনে নতুন এক ওয়াজিবেরই কি জন্মদান করা হয় না?

প্রচলিত মীলাদের প্রতি লক্ষ করুন না, এতে যে দরূদ শরীফ পড়া হয়, মৌলিকভাবে তা একটি বৈধ কাজই তো; বরং তা অতি বড় পুণ্য ও বরকতের কাজ। কিন্তু শরীআত এর জন্য নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি দান করেনি এবং সাধারণ অবস্থায় তা পড়াও ওয়াজিব করেনি। বিষয়টা কেবলই ঐচ্ছিক। যে পড়বে সে প্রভূত ছওয়াবের অধিকারী হবে, না পড়লে কোন গুনাহ হবে না। কিন্তু প্রচলিত মীলাদে দরূদ শরীফ পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-নীতি তৈরি করে নেওয়া হয়েছে। সে নিয়মে না পড়লে যেন দরূদ শরীফই পড়া হয় না এবং তা যেন মহাঅপরাধ।
প্রচলিত নিয়মের সেই মীলাদ এখন এমনই এক বাধ্যতামূলক কাজ হয়ে গেছে যে, কেউ তা না করলে সে এর প্রবক্তাদের দৃষ্টিতে দ্বীন থেকে খারিজ হয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুশমন হয়ে যায়। যে কারণে তাকে কেবল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপই নয় আরও নানাভাবে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

এমনিভাবে মৃত ব্যক্তির জন্য যে চল্লিশা করা হয়, তাতে মূলত যে কাজটি করা হয়, অর্থাৎ মানুষজনকে খাওয়ানো, মৌলিকভাবে তাও একটি বৈধ ও ছওয়াবের কাজ। কিন্তু মৃত ব্যক্তির কল্যাণার্থে এভাবে খানা খাওয়ানো বা কাঙালীভোজ দেওয়া কোন ফরয-ওয়াজিব কাজ নয় কিছুতেই। এটা সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক বিষয়। কিন্তু বিষয়টাকে এ স্তরে রাখা হয়নি; বরং এটাকে সামাজিকভাবে এমন আবশ্যকীয় কাজে পরিণত করা হয়েছে যে, কেউ পালন না করলে সে নিন্দা-সমালোচনার পাত্র হয়ে যায়। যেন সে শরীআতের মস্ত বড় এক হুকুম অমান্য করেছে। এহেন বাড়াবাড়িই মৌলিক এ বৈধ কাজটিকে নিষিদ্ধ বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত করেছে।

মোটকথা এ রকম আরও যেসব কাজ মৌলিকভাবে বৈধ হওয়া সত্ত্বেও এখন তা বিদ‘আত ও নিষিদ্ধ হয়ে গেছে এবং কুরআন-সুন্নাহর মূলনীতি অনুযায়ী তা গুনাহের কাজে পরিণত হয়েছে, তার এ অবস্থান্তরের জন্য মানুষের বাড়াবাড়িই দায়ী। বৈধ কাজকে তার আপন স্থান থেকে সরিযে কার্যত আবশ্যিকতার স্তরে পৌঁছানোর বাড়াবাড়িতেই তা অবৈধতায় পর্যবসিত হয়েছে। আজ মুসলিম সমাজে যত বিদ‘আত প্রচলিত মূলত এ জাতীয় বাড়াবাড়ি থেকেই তার উৎপত্তি।

পরবর্তী অংশ =

ইসলামে বিদআতের উৎপত্তি যেভাবে-২

পরিমিতবোধ ও মধ্যমপন্থা এর উপর লেখকের আরো লিখা সমূহ=

আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতকে মধ্যমপন্থী উম্মত বানিয়েছেন-১

1 Comment

  1. Pingback: ইসলামে বিদআতের উৎপত্তি যেভাবে-২ | ইসলাম বার্তা

Leave a Comment

Your email address will not be published.