ঈদের নামায এর অতিরিক্ত তাকবীরের হাদীসগুলোর পর্যালোচনা

১. কাছীর ইবনে আব্দুল্লাহর হাদীস: তিনি তার পিতার সূত্রে দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ শরীফে এটি উদ্ধৃত হয়েছে। ইমাম বুখারী র. ও তিরমিযী র. এর মতে বার তাকবীরের হাদীসগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে ভাল। তিরমিযী এটিকে হাসান বলেছেন। কিন্তু কাছীর সম্পর্কে আবূ দাউদ র. বলেছেন, كان أحد الكذابين ( সে ছিল একজন মিথ্যুক)। ইমাম শাফেয়ী র. বলেছেন, এ ব্যক্তি চরম মিথ্যাবাদীদের একজন। ইমাম আহমদ, ইবনে মাঈন, আবূ যুরআ, আবূ হাতেম, নাসায়ী, দারাকুতনী, ইবনে সা’দ, ইবনে হিব্বান, ইবনুস সাকান, হাকেম ও ইবনে হাযম সকলে তাকে যঈফ (দুর্বল) অথবা মাতরূক (পরিত্যাগযোগ্য) আখ্যা দিয়েছেন। ইবনে আব্দুল বার বলেছেন, তার যঈফ হওয়ার ব্যাপারে সকলে একমত। মিযযী, যাহাবী ও ইবনে হাজার আসকালানীও তাকে যঈফ বলেছেন। লা-মাযহাবী আলেম তিরমিযী শরীফের ভাষ্যকার মোবারকপুরী ও আলবানী (ইবনে খুযায়মার টীকায়) সাহেবরাও এটি যঈফ বলেছেন।
২.আয়েশা রা. এর হাদীসটি আবূ দাউদ ও ইবনে মাজায় উদ্ধৃত হয়েছে। এর সনদে ইবনে লাহীআ আছেন। ইমাম বুখারী এই হাদীসকে যঈফ সাব্যস্ত করেছেন। (দ্র, ইলালে তিরমিযী আল কাবীর, পৃ, ৯৪) হাকেম আবূ আব্দুল্লাহও এটিকে যঈফ বলেছেন। দারাকুতনী ও তাহাবী র. একই ইঙ্গিত দিয়েছেন। ইবনে হাজার আসকালানী তালখীসুল হাবীর গ্রন্থে বলেছেন, ইবনে লাহীআ থেকে এর সনদে এজতেরাব ও এখতেলাফ রয়েছে। তদুপরি ইবনে লাহীআ যঈফ ।
৩. ইবনে উমর রা. এর হাদীসটি দারাকুতনী, তাহাবী ও বাযযারে আছে। এর সনদে ফারাজ ইবনে ফাদালা (فرج بن فضالة) আছেন। তিনি যঈফ। তার এ হাদীসকে বুখারী, আবূ হাতেম রাযী ও তিরমিযী প্রমুখ ভুল বর্ণনা আখ্যা দিয়েছেন। ফারাজের উস্তুাদ আব্দুল্লাহ ইবনে আমের আসলামীও দুর্বল। আহমাদ, ইবনে মাঈন, ইবনুল মাদীনী, আবূ যুরআ, আবূ হাতেম, বুখারী , আবু দাউদ ও দারাকুতনী র. তাকে যঈফ ও দুর্বল বলেছেন।
৪. আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. এর হাদীসটি আবূ দাউদ, ইবনে মাজাহ ইত্যাদি গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে। এর সনদে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান তাইফী আছেন। ইবনে মাঈন, আবূ হাতেম, নাসায়ী, দারাকুতনী, উকায়লী, ইবনুল জাওযী ও ইবনুল কাত্তান র. প্রমুখ তাকে যঈফ বা দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। হাকেম এই হাদীসের সনদকে ফাসেদ বা খারাপ বলেছেন। ইবনে হাজার অবশ্য ‘তালখীস’ গ্রন্থে বলেছেন, এই হাদীসকে আহমাদ, ইবনুল মাদীনী ও তিরমিযীর বর্ণনা অনুসারে বুখারী র. সহীহ বলেছেন। কিন্তু এ কথাটি ঠিক নয় । কারণ উকায়লী র. ইমাম আহমাদ থেকে উল্লেখ করেছেন যে, ليس في تكبير العيدين عن النبي صلى الله عليه وسلم حديث صحيح (উভয় ঈদের তাকবীর সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোন সহীহ হাদীস নেই)। সুতরাং এই হাদীসকে তিনি সহীহ বলেতে পারেননা। বুখারী র. এর কথা যদিও তিরমিযী র. উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সেই ‘সহীহ’ শাব্দিক অর্থে হবে। অর্থাৎ হাদীসটি ঠিক আছে; পারিভাষিক অর্থে নয়। কারণ বুখারী ও তিরমিযী দুজনের মতেই বার তাকবীর সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো হাদীস হল পূর্বে উল্লিখিত প্রথম হাদীসটি। আর সেটাকে তিরমিযী সহীহ বলেননি, হাসান বলেছেন। যা সহীহ থেকে নীচের স্তরের। আর অন্যান্য অধিকাংশ মুহাদ্দিসের মতানুসারে সেটিও চরম দুর্বল। সুতরাং সেই হাদীসের চেয়ে নি¤œস্তরের হাদীস পারিভাষিক অর্থে সহীহ হতে পারেনা। এই কারণে মুনযিরী র. মুখতাসার আবূ দাউদে বলেছেন,     وفي إسناده عبد الله الطائفي وفيه مقال
অর্থাৎ এর সনদে আব্দুল্লাহ তাইফী আছেন, যার ব্যাপারে সমালোচনা রয়েছে।
তাহাবী র. বলেছেন,   والطائفي ليس عندهم بالذي يحتج بروايته
অর্থাৎ  মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে তাইফীর বর্ণনা প্রমাণযোগ্য নয়। তাছাড়া বুখারী র. তার সম্পর্কে বলেছেন, فيه نظر )তার ব্যাপারে আপত্তি আছে(।  (দ্র, তাহযীবুত তাহযীব)
৫. হযরত আলী রা. এর হাদীসটির সূত্র বিচ্ছিন্ন। তদুপরি এর বর্ণনাকারী ইবরাহীম ইবনে আবী ইয়াহয়া চরম দুর্বল।
৬. হযরত জাবের রা. এর একটি হাদীস বায়হাকীতে উদ্ধৃত হয়েছে। এর সনদে আলী ইবনে আসেম আছেন। শো’বা র., ইবনুল মুবারক র., ইবনুল মাদীনী, ইবনে মাঈন, নাসায়ী, সাজী ও সালেহ জাযারা প্রমুখ তার কঠোর সমালোচনা করেছেন। ইয়াযীদ ইবনে হারূন র. বলেছেন, ما زلنا نعرفه بالكذب
অর্থাৎ আমরা সর্বদা তাকে মিথ্যুক বলেই জানি। এর বিপরীত জাবের রা. থেকে সহীহ সনদে আমরা ছয় তাকবীরের হাদীস উল্লেখ করেছি। সেটিও আলী ইবনে আসেমের ভ্রান্তির দলীল বৈ কি?
৭. আব্দুর রহমান ইবনে আওফের একটি হাদীস বাযযারে আছে। এর সনদে হাসান ইবনে হাম্মাদ বাজালী আছেন। তাকে বাযযার র.(দ্র, মাজমাউয যাওয়ায়েদের টীকা) ও শাওকানী (তিনি লা-মাযহাবী আলেম) বলেছেন  لين الحديث (অর্থাৎ তার হাদীস দুর্বল)। দারাকুতনীর মতেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীসরূপে এটা ঠিক নয়। তিনি বলেছেন, এটি মাওকূফ (সাহাবীর বক্তব্য বা কর্ম) হওয়াই সঠিক।
৮. হযরত ইবনে আব্বাস রা. এর একটি হাদীস তাবারানীর  আলমুজামুল কাবীরে উদ্ধৃত হয়েছে। এতে সুলায়মান ইবনে আরকাম আছেন, যিনি সকল মুহাদ্দিসের দৃষ্টিতে পরিত্যাগযোগ্য। এর আরেকটি সূত্রে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল আযীয তদীয় পিতা আব্দুল আযীয থেকে বর্ণনা করেছেন। মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল আযীয সম্পর্কে বুখারী র. বলেছেন,  منكر الحديث  ( তার হাদীস আপত্তিকর)। নাসায়ী  র. বলেছেন,  متروك الحديث  ( তার হাদীস বর্জনযোগ্য)। আর আবূ হাতেম রাযী বলেছেন,  ضعيف الحديث
)তার হাদীস দুর্বল(। অধিকন্তু তার পিতা আব্দুল আযীয সম্পর্কে ইবনুল কাত্তান র. বলেছেন,  তার অবস্থা অজানা।
৯. আবূ ওয়াকিদ লায়ছী রা. এর হাদীস তাহাবী ও তাবারানী উদ্ধৃত করেছেন। এটি সম্পর্কে আবূ হাতেম রাযী বলেছেন,  هذا حديث باطل بهذا الإسناد
অর্থাৎ এইসূত্রে হাদীসটি বাতিল। (দ্র, আত তালখীসুলহাবীর)
পরিশেষে লা-মাযহাবী বন্ধুদেরকে একটি কথা বলতে চাই। মুসলমানদের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টি করা ভাল কাজ নয়। বিরোধপূর্ণ মাসআলায় সালাফ ও পূর্বসূরিগণের পথ অনুসরণ করাই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক। আমাদের পূর্বসূরিগণ দ্বিমত করেছেন কিন্তু কাদা ছোড়াছুড়ি করেননি। ইমাম আহমাদ র. বার তাকবীরকে পছন্দ করতেন। কিন্তু সাথে তিনি একথাও বলেছেন,
وقد اختلف أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم في التكبير وكله جائز
অর্থাৎ ঈদের তাকবীর নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবীগণের মধ্যে দ্বিমত ছিল। সব পন্থাই জায়েয।
ইমাম ইবনে রজব হাম্বলীর. তাঁর ফাতহুল বারী গ্রন্থে ইমাম আহমাদের এই বক্তব্য সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লেখেন,
وهذا نص منه على أنه يجوز التكبير على كل صفة رويت عن الصحابة من غير كراهة ، وإن كانَ الافضل عنده سبعاً في الأولى وخمساً في الثانية .ورجح هذا  ابن عبد البر ، وجعله من الاختلاف المباح ، كأنواع الأذان والتشهدات ونحوها . )فتح الباري ٥/٢١٤)
অর্থাৎ এটা তাঁর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ঘোষণা যে, ঈদের তাকবীর সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম থেকে যেসব বিবরণ বর্ণিত হয়েছে, এর সবই জায়েয, কোনটিই মাকরূহ নয়। যদিও তার মতে উত্তম হলো, প্রথম রাকাতে সাত তাকবীর ও দ্বিতীয় রাকাতে পাঁচ তাকবীর। ইবনে আব্দুল  বার র.ও সকল পদ্ধতি জায়েয হওয়ার এ মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে বিদ্যমান দ্বিমতকে বৈধ মতানৈক্য আখ্যা দিয়েছেন। যেমন, আযান ও তাশাহহুদ ইত্যাদির একাধিক পদ্ধতি সম্পর্কে দ্বিমত । (দ্র, ফাতহুল বারী, ৫খ, ২১৪পৃ; আলইসতিযকার,২খ, ৩৯৭ পৃ)

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তায়মিয়া র. লিখেছেন, এ ব্যাপারে আমাদের নীতি – আর এটাই বিশুদ্ধ নীতি Ñ এই যে, ইবাদতের পদ্ধতি বিষয়ে যে পদ্ধতি সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য হাদীস রয়েছে তা মাকরূহ হবে না। বরং তা হবে শরীয়তসম্মত। সালাতুল খাওফের বিভিন্ন পদ্ধতি, আযানের দুই নিয়ম, তারজী’ যুক্ত ও তারজী’ বিহীন, ইকামতের দুই নিয়ম, বাক্যগুলো দুবার করে বলা বা একবার করে, তাশাহহুদ, ছানা, আউযু এর বিভিন্ন পাঠ, কুরআনের বিভিন্ন কেরাত, এসবই উক্ত নীতির অন্তর্ভুক্ত। একইভাবে ঈদের নামাযের অতিরিক্ত তাকবীর সংখ্যা, জানাযা নামাযের বিভিন্ন নিয়ম, সাহু সিজদার একাধিক নিয়ম, কুনুত পাঠ- রুকুর আগে বা পরে, রাব্বানা লাকাল হামদ ‘ওয়া’সহ বা ‘ওয়া’ ছাড়া এসবই শরীয়তসম্মত। কোন পদ্ধতি কখনো উত্তম হতে পারে। কিন্তু অন্যটি মাকরূহ কখনো নয়। (দ্র, মাজমূউল ফাতাওয়া, ২৪খ, ২৪২-২৪৩পৃ)
ইবনে রুশদ মালেকী র. তার বিদায়াতুল মুজতাহিদ গ্রন্থে বলেছেন, ঈদের তাকবীর সংখ্যার ব্যাপারে কোন সহীহ মারফূ হাদীস প্রমাণিত নেই। এরপর তিনি ইমাম আহমাদের এই বক্তব্য উল্লেখ করেছেন, দুই ঈদের তাকবীর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কোন সহীহ হাদীস নেই। এরপর ইবনে রুশদ বলেন, একারণে ফকীহগণ বিভিন্ন সাহাবীর আমলকে দলিল বানিয়েছেন। আর এক্ষেত্রে দ্বিমত হচ্ছে কোন পদ্ধতি উত্তম তা নিয়ে। অন্যথায় যে কোন পদ্ধতি অবলম্বন করা হোক, সকলের নিকট তা জায়েয।

Leave a Comment

Your email address will not be published.