কুরআন বুঝে পড়তে সচেষ্ট পাঠকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

কুরআন পড়া

বর্তমানে আমাদের অনেকেই কুরআন বুঝে পড়ার চেষ্ঠা করছি। এবং এইটা প্রত্যেক মুসলমানের উচিত। কিন্তু কুরআন বুঝে পড়ার ক্ষেত্রে কতগুলো প্রতিবদ্ধকতা রয়েছে। তা, কুরআন বুঝে পড়তে সচেষ্ট পাঠকদের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিচে আলোচনা করা হলো:

ক. কুরআনের ভাষা আরবী। তাই অনারবদের জন্য কুরআন বুঝতে হলে আরবী ভাষা জানতে হবে এবং কুরআনের বাণী ও মর্ম উপলব্ধির জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয়াশয়ে পূর্ণ ব্যুৎপত্তি গত জ্ঞান অর্জন করতে হবে। যেহেতু সর্বসাধারণের জন্য কুরআনের ভাষার প্রয়োজনীয় শাস্ত্রাদিতে পূর্ণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করা মোটেও সহজসাধ্য নয়; তাই তাদেরকে নির্ভযোগ্য তরজমা, টীকা ও তাফসীরের সহযোগিতাই নিতে হবে।

খ. কুরআন আসমানী কিতাব। কুরআনের ভাষা ও তথ্যের অলৌকিকতা ও এর বর্ণনাশৈলী ইত্যাদির কারনে তা অন্য ভাষায় অনুবাদ করা অত্যন্ত কঠিন ও দুঃসাধ্য কাজ। আবার একাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুবাদকের আমানতদারীর সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা। তাই অনুবাদ পাঠ করার ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম লক্ষনীয় হল- অনুবাদক সর্বজন স্বীকৃত নীতিমালার আলোকে কুরআন অনুবাদের যোগ্যতম ব্যক্তি কি না? এক্ষেত্রে তার আমানতদারী স্বীকৃত কি না? মোটকথা পড়ার জন্য কুরআনের অনুবাদগ্রন্হ নির্বাচন আস্হাভাজন আলেমে দীনের পরামর্শ অনুযায়ী হওয়া জরুরী।

গ. কুরআন আল্লাহর তা‘আলার কালাম। তাই কেবল অনুবাদের মাধ্যমে পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় এর পরিপূর্ণ ভাব প্রকাশ করা সম্ভব না।  তদ্রুপ সাধারণ পাঠকের পক্ষে শুধু অনুবাদ থেকে আয়াতের সঠিক মর্ম উপলব্ধি করাও অনেক ক্ষেত্রে কঠিন। তাই নির্ভরযোগ্য অনুবাদের পাশাপাশি কোন একটি সংক্ষিপ্ত তাফসীরের কিতাব সঙ্গে  রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রেও কিতাব নির্বাচন নির্ভরযোগ্য আলেমের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে।

ঘ. কুরআনের মৌলিক বিষয়বস্তুর সিংহভাগই হল উপদেশমূলক নির্দেশনা ও বিবরণ। অপর অংশে রয়েছে আহ্কাম তথা শরীয়তের বিধি-বিধান। বিধি-বিধান সংক্রান্ত আলোচনার কিছু অংশ (যথা, এমন বিধান যা ‘ছরিহ’ -সুস্পষ্ট এবং যাতে ইজতিহাদের প্রয়োজন ও সুযোগ কোনটিই নেই) সর্বসাধারণের জন্য সহজবোধ্য হলেও একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যেহেতু মূলনীতি আকারে সংক্ষিপ্ত ভাষায় বিবৃত হয়েছে। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও প্রায়োগিক রূপ হাদীস শরীফের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। তাই এ অংশটি হচ্ছে ইজতিহাদ ও গবেষণার বিষয়। তরজমা ও তাফসীরের কিতাব অধ্যয়ন করাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়।

উদ্ধৃত সূরা ক্বামারে আল্লাহ তা‘আলা সকলের জন্য কুরআন বুঝা ও তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করাকে সহজ বলেছেন – কথাটির অর্থ হল কুরআনের উপদেশমূলক সহজবোধ্য অংশটুকু। আর যে অংশটুকু ইজতিহাদ ও ব্যাপক গবেষণার দাবিদার সে অংশের বিধান হল-

فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
‘তোমরা যদি না জান তাহলে এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও’। (সূরা নাহল-৪৩, সূরা আম্বিয়া-৭)
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ) এ আয়াত প্রসঙ্গে বলেন- “এ বিষয়ে সার কথা এই যে, কুরআন ও হাদীসের কিছু বিষয় জাহের তথা সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। আর কিছু বিষয় খফি তথা প্রচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট। কুরআন ও হাদীসকে সহজ বলা হয়েছে প্রথমোক্ত বিষয়ের প্রতি লক্ষ করে। ইজতিহাদ করতে হলে কুরআন ও হাদীসের প্রচ্ছন্ন ও অস্পষ্ট বিষয়গুলোর মর্ম উদঘাটন করতে হবে। এর এ কাজ সবার জন্য সম্ভব নয়”।

অর্থাৎ কুরআনের কিছু কিছু বিষয় এমন যা আরবী ভাষায় পূর্ণ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও সাধারণের জন্য বুঝা মোটেও সহজ নয়। তিনি এর দুটি উদাহরণ পেশ করেন-

১. হযরত জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ রা. বর্ণনা করেন- আমরা এক সফরে ছিলাম। তখন একসাথীর মাথায় একটি পাথর পড়ল এবং তাতে ক্ষত হয়ে গেল। এমতাবস্থায় তার গোসল ফরজ হয়। তিনি সাথীদের জিজ্ঞেস করলেন- আমার কি গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম করার সুযোগ আছে? তাঁরা বললেন, না। অপারগ হয়ে তিনি গোসল করেন এবং মাথার ক্ষতে পানি লাগার কারণে তিনি মারা যান। সফর থেকে ফেরার পর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি রেগে বললেন- ‘না জেনে কথা বলে তারা তাকে মেরে ফেলেছে। আল্লাহ তাদের নাশ করুন। তারা যেহেতু এ বিষয়ের বিধান জানে না তবে কেন জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়নি?!?  অজ্ঞতার সমাধান তো জিজ্ঞেস করার মধ্যেই। তার জন্য তো তায়াম্মুম করে নেয়াটাই যথেষ্ট ছিল। (সুনানে আবুদাউদ হা. ৩৩৬ সুনানে ইবনে মাযা হা. ৫৭২ মুসতাদরাকে হাকিম হা. ৫৮৭)

পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে  ‘তোমরা অপবিত্র হলে গোসল করে পবিত্র হও’। মূলত সফরসঙ্গী সাহাবীগণ বুঝে ছিলেন যে,  এ আয়াতটি সর্বাবস্থার জন্য। ওজর থাক বা না থাক,  গোসল করতেই হবে।

আর কুরআনের অপর আয়াতটি-  যেখানে বলা হয়েছে “আর তোমরা যদি অসুস্থ হও … তবে পাক মাটি দ্বারা তায়াম্মুম করে নাও”(সূরামায়েদা-৬)

শুধু অজুর বিকল্প,  গোসলের বিকল্প নয়। এই ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে তাঁরা তাকে গোসল করার ফতুয়া দিয়েছিলেন। তাঁদের এ ফতুয়ার উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ জন্য নিন্দা করেননি যে, ইজতিহাদ করা দোষণীয় কাজ। বরং রাসূলের এ নিন্দাবাদের কারণ হল তাঁরা ইজতিহাদের যোগ্যতা রাখতেন না। কাজেই যে কাজের প্রতিভা তাদের নেই সে কাজ করতে গেলেন কেন? এতে প্রমাণিত হয়- যে মুজতাহিদ নয় তার ইজতিহাদ বৈধ নয়। বরং সে ইজতিহাদ করলেও তা গ্রহণ করা হবে না।

২. হযরত আদী ইবনে হাতিম রা. বর্ণনা করেন যখন এ আয়াত অবতির্ণ হল-

وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ –
‘তোমরা পানাহার কর যতক্ষণ না কাল রেখা থেকে শুভ্র রেখা পরিস্কার দেখা যায়’ (সূরাবাকারা-১৮৭)
তখন তিনি একটি সাদা সুতা ও একটি কাল সুতা তার বালিশের নিচে রেখে দেন। রাতে উঠে দেখেন সুতাদুটি একটি অপরটি থেকে পৃথক দেখা যায় না। অর্থাৎ সদা কালো রঙের কোন পার্থক্য ধরা পরে না। ভোর হলে নবীজীকে এসে ঘটনার বিবরণ শুনালেন। তিনি শুনে রসিকতা করে বলেন- তোমার বালিশ তো দেখছি তাহলে অনেক বড়! এর নিচে দিগন্তজোড়ে বিস্তৃত বিশাল আকাশ সংকুলান হয়ে যায়। আয়াতে সাদা কালো রেখা দ্বারা রাত দিনের কথা বুঝানো হয়েছে। দিনকে সাদা আর রাতকে কালো বলা হয়েছে। (সহী বুখারী হা. ৪৫০৯ সহী মুসলিম হা. ১০৯২) সহী বুখারীর অপর বর্ণনা (হা. ১৯১৭) থেকে জানা যায় এরূপ ঘটনা আরো অনেকের বেলায়ই ঘটেছিল।
দেখুন! এ সাহাবী আরবী ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও ইজতিহাদী প্রতিভা না থাকার কারণে কুরআনের এ আয়াতের সঠিক মর্ম বুঝতে অক্ষম হয়েছেন। আরও লক্ষ করুন! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ইজতিহাদকে রসিকতার মাধ্যমে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

উপরোক্ত দুটি ঘটনার সাথে যুক্ত সাহাবীরা সকলেই ছিলেন আরবীভাষী। তথাপি কুরআনের উপরোক্ত দুটি আয়াতের উদ্দিষ্ট মর্ম উদ্ধার করতে পারেননি।

১. এতে সুস্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয় যে, কুরআন মাজীদকে সাধারণের জন্য সহজ করা হয়েছে ঠিক; তবে কিছু কিছু অংশ এমন রয়েছে যা বুঝা সকলের জন্য সহজসাধ্য নয়।
২. তাই এ অংশ বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করে। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-‘ অজ্ঞতার সমাধান হল জিজ্ঞেস করে জেনে নেয়া’। (‘আল ইকতিছাদ ফি বাহ্সিত্তকলীদি ওয়াল ইজতিহাদ- থেকে সামান্য পরিবর্তিত)

তাই সর্বসাধারণ পাঠকরা কুরআনের উপদেশমূলক ও সহজবোধ্য বিষয়গুলো অনুবাদ ও টীকার সাহায্যে পড়বে, অনুধাবন করার চেষ্টা করবে এবং তাতে গভীর চিন্তা-ফিকির করবে। তবে যেসকল আয়াত অপেক্ষাকৃত জটিল ও ইজতিহাদের দাবিদার সে সকল বিষয়ে তাফসীর শাস্ত্রের মূলনীতির আলোকে উন্নীত যোগ্য তাফসীর বিশারদের কৃত ব্যাখ্যার অনুসরণ করবে । এক্ষেত্রে কেবল অভিধান বা ভাষা জ্ঞানকেই যথেষ্ট মনে করা বা মনগড়া ব্যাখ্যার অশ্রয় নেয়া চরম  অন্যায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

” من قال في كتاب الله عز و جل برأيه فأصاب فقد أخطأ ”
‘যে ব্যক্তি কুরআনের ক্ষেত্রে কেবল নিজ মতের ভিত্তিতে কথা বলে এবং তাতে সঠিক কথাও বলে, তবুও সে ভুল করে’। (সুনানে আবুদাউদ-৩৬৫২)

ঙ. সাধারণ পাঠকদের উচিত, কুরআন মাজীদের যে সূরাগুলো আমরা দৈনন্দিন বিভিন্ন সময় বা নামাযে তিলাওয়াত করি যথা- সূরা ফাতিহা, সূরা ইয়াসীন, সূরা রহমান, আয়াতুল কুরসি, ত্রিশতম পাড়া, ইত্যাদি সূরাসমূহের তিলাওয়াতের পাশাপাশি তার তরজমা ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর পাঠ করা।

এ বিষয়ে অন্যান্য লিখা সমূহ=
কুরআন নিয়ে চিন্তা ভাবনা ও তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে হবে
কুরআন তিলাওয়াত করতে হবে ভাব-গাম্ভীর্যমিশ্রিত কণ্ঠে আবেগ ও অনুভূতির সাথে

Leave a Comment

Your email address will not be published.