খোঁটা দেওয়ার কুফল-২

পূর্ববর্তী অংশ:
খোঁটা দেওয়ার কুফল-১

খোঁটা দ্বারা কেবল দান-খয়রাত ও পরোপকারের ছওয়াবই নষ্ট হয় না; বরং এটা একটা কঠিন পাপও বটে। কেননা এর দ্বারা উপকৃত ব্যক্তির অন্তরে আঘাত দেওয়া হয়। মানুষের মনে আঘাত দেওয়া কবীরা গুনাহ। সুতরাং খোঁটা দেওয়া ইসলাম ও ঈমানের সংগে সংগতিপূর্ণ নয়।
কেননা মুসলিম বলাই হয় তাকে, যার হাত ও মুখ থেকে সকল মুসলিম নিরাপদ থাকে (সহীহ বুখারী, হাদীস ১০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪১)।
আর মু’মিন সেই, যার ক্ষতি থেকে সকল মানুষ নিরাপদ থাকে (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১২৫৬১ )।
এজন্যেই খোঁটা দেওয়াকে কুরআন মাজীদে কাফের-বেঈমানের কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইরশাদ হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُبْطِلُوْا صَدَقٰتِكُمْ بِالْمَنِّ وَ الْاَذٰی ۙ كَالَّذِیْ یُنْفِقُ مَالَهٗ رِئَآءَ النَّاسِ وَ لَا یُؤْمِنُ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ ؕ فَمَثَلُهٗ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَیْهِ تُرَابٌ فَاَصَابَهٗ وَابِلٌ فَتَرَكَهٗ صَلْدًا ؕ لَا یَقْدِرُوْنَ عَلٰی شَیْءٍ مِّمَّا كَسَبُوْا ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهْدِی الْقَوْمَ الْكٰفِرِیْنَ.

অর্থ : ‘হে মু’মিনগণ! খোঁটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে নিজেদের দান-সদকাকে সেই ব্যক্তির মত নষ্ট করো না, যে নিজের সম্পদ ব্যয় করে মানুষকে দেখানোর জন্য এবং আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাষ রাখে না। সুতরাং তার দৃষ্টান্ত এরকম, যেমন এক মসৃণ পাথরের উপরে মাটি জমে আছে, অতঃপর তাতে প্রবল বৃষ্টি পড়ে এবং তা সেই মাটিকে ধুয়ে নিয়ে যায় এবং সেটিকে পুনরায় মসৃণ পাথর বানিয়ে দেয়। এরূপ লোক যা উপার্জন করে, তার কিছুমাত্র তারা হস্তগত করতে পারে না। আর আল্লাহ এরূপ কাফেরদেরকে হেদায়াতপ্রাপ্ত করেন না।’ -সূরা বাকারা (২) : ২৬৪

অর্থাৎ খোঁটা দেওয়া কাফেরদেরই বৈশিষ্ট্য। তারা যেহেতু আখিরাতে বিশ্বাস করে না, তাই ছওয়াবেরও কোনও আশা থাকে না। আশা থাকে কেবল নগদপ্রাপ্তি। হয় সে ব্যক্তি তাকে আরও বেশি দেবে, নয় তার অনুরূপ উপকার তারও করবে। অন্ততপক্ষে তার গুণগান করে তো বেড়াবেই। যখন এর কোনওটা পায় না, তখন মনে করে- বৃথাই টাকা-পয়সা নষ্ট করল। এভাবে সে হতাশার শিকার হয় আর নিমকহারাম, অকৃতজ্ঞ ইত্যাদি বলে গালাগাল করে। এখন মু’মিন-ব্যক্তিও যদি খোঁটা দিয়ে বসে, তবে তা কাফেরসুলভ আচরণই হল। এর দ্বারা প্রমাণ হবে- দান বা উপকার করার সময় আল্লাহর সন্তুষ্টি তার উদ্দেশ্য ছিল না। যেমন কাফের ব্যক্তির সেরকম উদ্দেশ্য থাকে না। আর যে দান-খয়রাত আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য হয় না, তার পরিণাম সম্পর্কে হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

হাশরের দিন আল্লাহ তা‘আলা এরূপ ব্যক্তিকে বলবেন- তোমাকে আমি যে অর্থ-সম্পদ দিয়েছিলাম, তা দ্বারা তুমি আমার জন্য কী করেছ? সে বলবে, হে আল্লাহ! আমি তা তোমার পথে ব্যয় করেছি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমি তো এজন্য করেছিলে যে, লোকে তোমাকে দাতা বলবে। তা বলাও হয়েছে। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে দান করেছিলে তা পেয়ে গেছ। আজ আমার কাছে তোমার কোনও বদলা নেই। অতঃপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” (মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২৫২৮)

অথবা প্রমাণ হবে- উপকার করার সময় আল্লাহর সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য থাকলেও পরবর্তী সময়ে সেই উদ্দেশ্যের উপর সুদৃঢ় থাকতে পারেনি। নজর চলে গেছে নগদপ্রাপ্তির দিকে। ফলে যেই ছওয়াব তার পাওয়ার ছিল, তা তো বরবাদ করে ফেলেছেই, উপরন্তু আমলনামায় কবীরা গুনাহ যোগ করেছে। কেননা নগদ-বদলা না পাওয়ার কারণে সে তাকে খোঁটা দিয়েছে, অকৃতজ্ঞ বলেছে। এভাবে তার মনে কঠিন আঘাত দিয়েছে।

যে ব্যক্তি কারও উপকার নেয়, সে এমনিতেই মানসিকভাবে দুর্বল থাকে। তার উপর যদি খোঁটা দেওয়া হয়, তবে তা তার অন্তরে রীতিমত রক্তক্ষরণ ঘটায়। সেই রক্তক্ষরণের বিপরীতে তার দান-খয়রাত ও উপকার কোনও ধর্তব্যেই আসে না। বরং আঘাতের উৎপত্তি যেহেতু ওই উপকার থেকে, তাই উপকারটাও উপকৃত ব্যক্তির পক্ষে হয়ে যায় এক পাষাণ ভার। যেন এই উপকার না করাই তার পক্ষে ভালো ছিল। তাই তো ইরশাদ হয়েছে-

قَوْلٌ مَّعْرُوْفٌ وَّ مَغْفِرَةٌ خَیْرٌ مِّنْ صَدَقَةٍ یَّتْبَعُهَاۤ اَذًی ؕ وَ اللّٰهُ غَنِیٌّ حَلِیْمٌ.

অর্থ : ‘উত্তম কথা বলে দেওয়া ও ক্ষমা করা সেই দান-সদকা অপেক্ষা শ্রেয়, যার পর কোনও কষ্ট দেওয়া হয়। আল্লাহ অতি বেনিয়ায ও সহনশীল।’
-সূরা বাকারা (২) : ২৬৩

অর্থাৎ কেউ যদি কারও কাছে কোনও সাহায্য চায় এবং সে কোনও কারণে তা করতে না পারে, তবে তার উচিত নম্র ও ভদ্র ভাষায় তাকে জবাব দিয়ে দেওয়া। আর যদি অনুচিত পীড়াপীড়ি করে, সেজন্য তাকে ক্ষমা করা। আর এভাবে নম্রকথা বলে বিদায় করা ও ক্ষমা করা সেই দান অপেক্ষা বহু শ্রেয়, যে দানের পর খোঁটা দেওয়া হয় কিংবা অপমান করে কষ্ট দেওয়া হয়।

খোঁটা দেওয়া যে কত গর্হিত এবং আল্লাহ তা‘আলার কাছে কত ঘৃণ্য, হযরত আবূ যর (রাযি.)-এর একটি হাদীস দ্বারা তা অনুমান করা যায়। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَ لَا يَنْظُرُ اِلَيْهِمْ وَ لَا يُزَكِّيْهِمْ وَ لَهُمْ عَذَابٌ اَلِيْمٌ، قَالَ اَبُوْ ذَرٍّ فَقَرَأَهَا رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ ثَلَاثُ مِرَارٍ، قَالَ اَبُوْ ذَرٍّ : خَابُوْا وَ خَسِرُوْا، مَنْ هُمْ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ : اَلْمُسْبِلُ وَ الْمَنَّانُ وَ الْمُنْفِقُ سِلْعَتَه بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ.

‘তিন ব্যক্তি এমন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা যাদের সংগে কথা বলবেন না, তাদের দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না, তাদেরকে পরিশুদ্ধ করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। আবূ যর (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ কথাটি তিন-তিনবার বললেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তারা কারা, তারা তো সর্বস্বান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেল? তিনি বললেন, (ক) যে ব্যক্তি পরিধেয় কাপড় টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে রাখে; (খ) যে ব্যক্তি উপকার করার পর খোঁটা দেয় এবং (গ) যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য চালায়।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৬

খোঁটা দেওয়া যে কত গুরুতর অপরাধ, এ হাদীস দ্বারা তা আঁচ করা যায়। বস্তুত খোঁটাদানকারী নিজেকে মহানুভবতার উচ্চস্তর থেকে হীনতার গভীর খাদে নামিয়ে আনে। যে পরোপকার করে, সে তা আল্লাহর খলীফা হিসেবেই করে। সৃষ্টির উপর তার হাত যেন আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের হাত। এরূপ হাত সম্পর্কে হাদীস বলছে-

اَلْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِّنْ اليَدِ السُّفْلٰى

উপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪২৭

অর্থাৎ দাতার হাত গ্রহিতার হাত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। খোঁটা দ্বারা দান-উপকারের এই মহিমা নষ্ট হয়। কারণ বিনিময়ের আশাবাদী হওয়ার কারণে সে আর আল্লাহর প্রতিনিধি থাকে না। বাহ্যদৃষ্টিতে সে উপকারকারী হলেও প্রকৃতপক্ষে সে উপকারলাভের ভিখারী। সে উপকার করেছিল স্বার্থচিন্তায় তাড়িত হয়ে। কিংবা উপকার করার পর এখন সেই তাড়না বোধ করছে। সে তার উপকারকে ছলনার স্তরে নামিয়ে এনেছে। শিকারী যেমন সশ্যদানা ছিটিয়ে পাখি বা মাছ শিকার করে, তেমনি সেও উপকারের দানা ছিটিয়ে পার্থিব স্বার্থ হাসিল করতে চায়। তার হাত আর উপরের হাত থাকল না। নিচের হাত হয়ে গেল।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published.