জানাযার নামায পড়ার পদ্ধতি

জানাযার নামায:

বর্তমান সময়ে জানাযার নামায পড়া নিয়ে সমাজে বিভ্রান্তি  পরিলক্ষিত হয়। এর ই উপর ভিত্তি করে সহীহ হাদীসের আলোকে ফুকাহা কেরামের মত অনুসারে জানাযার নামায নিয়ে ভিভ্যান্তি দুর করার জন্য দলিল সহ কিছু তথ্য তুলে ধরা হলো।

হযরত ইমাম আবু হানীফা রহ. এর মত হচ্ছে, জানাযার নামাযে  সূরা ফাতেহা পড়া সুন্নত নয়। বরং
প্রথম তাকবীর বলে সানা পড়বে,
দ্বিতীয় তাকবীর বলে দুরূদ শরীফ পড়বে,
তৃতীয় তাকবীর বলে দুআ পড়বে  এবং
চতুর্থ তাকবীর বলে সালাম ফিরাবে
হ্যাঁ, সানা হিসেবে (অর্থাৎ সানার পরিবর্তে) সূরা  ফাতেহা ও পড়তে  পারে,  কেরাত  হিসেবে নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীদের  আমল দ্বারাই একথা প্রমাণিত।
এমতের পক্ষে দলিলগুলো নিচে প্রদত্ত হল:

১. হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন,
سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ –صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ ্র إِذَا صَلَّيْتُمْ عَلَى الْمَيِّتِ فَأَخْلِصُوا لَهُ الدُّعَاءَ গ্ধ
অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যখন তোমরা জানাযার নামায পড়বে, তখন তার জন্যে একনিষ্ঠভাবে দুআ কর।
(আবূ দাউদ শরীফ, ২খ, ৪৫৬পৃ)

২. নাফে র. থেকে বর্ণিত,
أن ابن عمر كان لا يقرأ في الصلاة على الميت .
হযরত আব্দুল্লাহ  ইবনে উমর রা. জানাযার নামাযে  কেরাত পড়তেননা।
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫২২ )

৩. হযরত আবু সাঈদ রা. বলেন,
أنه سأل أبا هريرة كيف تصلي على الجنائز فقال أبو هريرة أنا لعمر الله أخبرك أتبعها مع أهلها فإذا وضعوها كبرت وحمدت الله وصليت على نبيه صلى الله عليه و سلم ثم أقول
তিনি হযরত আবু হুরায়রা রা.কে  জিজ্ঞেস করেছেন, আপনি কিভাবে জানাযার নামায পড়েন? হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আল্লাহর কসম , আমি তোমাকে অবশ্যই তা জানাব। মৃতব্যক্তির পরিবারের সাথে আমি যাই। যখন (নামাযের  জন্যে) তারা তার লাশ রাখে,  তখন আমি  তাকবীর বলি ও আল্লাহর হামদ পাঠ করি, তার নবীর উপর দরূদ পড়ি অতঃপর (নিন্মোক্ত দুআটি) পড়ি ……….
اَللّهُمَّ عَبْدُكَ وَابْنُ عَبْدِكَ وَابْنُ اَمَتِكَ، كَانَ يَشْهَدُ اَنْ لا اِلهَ اِلا اَنْتَ وَاَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُكَ وَرَسُوْلُكَ، وَاَنْتَ اَعْلَمُ بِهِ، اَللّهُمَّ اِنْ كَانَ مُحْسِنًا فَزِدْ فِيْ اِحْسَانِهِ وَاِنْ كَانَ مُسِيْئًا فَتَجَاوَزْ عَنْهُ، اَللّهُمَّ لا تَحْرِمْنَا اَجْرَهُ وَلا تَفْتِنَّا بَعْدَهُ
(মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক,হাদীস নং৬৪২৫)

৪. আবুল মিনহাল  র.বলেন,
سألت أبا العالية عن القراءة في الصلاة على الجنازة بفاتحة الكتاب فقال ما كنت أحسب أن فاتحة الكتاب تقرأ إلا في صلاة فيها ركوع وسجود .
আমি আবুল আলিয়াকে জানাযার নামাযে  সূরা ফাতেহা  পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, আমি মনে করি, সূরা ফাতেহা  শুধু সে নামাযেই পড়া যাবে যেখানে রুকু ও সিজদা রয়েছে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং১১৫২৪ )

৫. আবু বুরদা র.  থেকে বর্ণিত,
قال له رجل أقرأ على الجنازة بفاتحة الكتاب قال لا تقرأ .
এক লোক তাকে বলল, আমি জানাযার নামাযে  সূরা ফাতেহা  পড়ি। তিনি তাকে বললেন, তুমি (তা) পড়োনা।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫২৬।

৬. হাজ্জাজ র. বলেন,
سألت عطاء عن القراءة على الجنازة فقال ما سمعنا بهذا إلا حديثا.
আমি আতাকে জানাযার নামাযের  কেরাত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, আমরা একটি হাদীস ছাড়া এমন কিছু শুনিনি।
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫২৭ )

৭. শাবী র.বলেন,
ليس في الجنازة قراءة .
জানাাযার নামাযে  কোন কেরাত নেই।
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং১১৫২৮ )

৮. ইবনে তাউস তার পিতা ও আতা  থেকে বর্ণনা করেন,
أنهما كانا ينكران القراءة على الجنازة .
তারা দুজন জানাযার নামাযে  কেরাত অপছন্দ করতেন।
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫২৯)

৯. বাক্র ইবনে আব্দুল্লাহ র. বলেন,
لا أعلم فيها قراءة .
জানাযার নামাযে কোন কেরাত আছে বলে আমি জানিনা।
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫৩০ )

১০. মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন,
سألت سالما فقلت القراءة على الجنازة فقال لا قراءة على الجنازة .
আমি সালেমকে জিজ্ঞেস করলাম: জানাযার নামাযে  সূরা ফাতেহা (পড়তে হবে)? তিনি বললেন, জানাযায় কোন কেরাত নেই।
(মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫৩২)

১১. ইবনে সীরীন রহ. থেকে বর্ণিত,
كان لا يقرا في شيء من التكبيرات وكان يقول ৃৃ.
তিনি জানাযার তাকবীরগুলোতে কোন  কেরাত পড়তেননা। বরং পড়তেন,
اَللّهُمَّ اغْفِرْ لِلْمُؤْمِنِيْنَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْمُسْلِمِيْنَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَاَلِّفْ بَيْنَ قُلُوْبِهِمْ وَاجْعَلْ قُلُوْبَهُمْ عَلَى قُلُوْبِ اَخْيَارِهِمْ، اَللّهُمَّ ارْفَعْ دَرَجَتَهُ فِيْ الْمُهْتَدِيْنَ وَاخْلُفْهُ فِيْ تَرِكَتِهِ فِيْ الْغَابِرِيْنَ، اَللّهُمَّ لا تَحْرِمْنَا اَجْرَهُ وَلا تُضِلَّنَا بَعْدَهُ.
(মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক,হাদীস নং৬৪৩২)

১২. আইয়ুব র. থেকে বর্ণিত,
عن محمد أنه كان لا يقرأ على الميت .
মুহাম্মদ (ইবনে সীরীন) রহ. মৃতের জন্যে (জানাযার নামাযে) কেরাত পড়তেননা।
-মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা, হাদীস নং ১১৫২৩।

১৩. হাম্মাদ র. বলেন,
عن إبراهيم قال سألته أيقرا على الميت إذا صلى عليه قال لا
আমি ইবরাহীম রহ.কে জিজ্ঞেস করলাম, যখন মৃতব্যক্তির জন্যে জানাাযার নামায  পড়া হয় তখন কি কোন কেরাত পড়া হবে? তিনি বললেন, না।
(মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস নং৬৪৩৩)

১৪. হযরত শাবী বলেন,
التكبيرة الاولى على الميت ثناء على الله والثانية صلاة على النبي صلى الله عليه و سلم والثالثة دعاء للميت والرابعة تسليم
জানাযার নামাযে  প্রথম তাকবীর আল্লাহর প্রশংসা, দ্বিতীয় তাকবীর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দুরূদ পড়া, তৃতীয় তাকবীর মৃতের জন্যে দুআ করা এবং চতুর্থ তাকবীর হচ্ছে সালাম ফিরানো।
(মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক,হাদীস নং ৬৪৩৪)

১৫. হযরত ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত ,
أن النبي صلى الله عليه و سلم لم يوقت فيها قولا ولا قراءة
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে (জানাযার নামাযে )  কোন কথা বা দুআ নির্দিষ্ট করেননি। (মুগনী)

১৬. মানসূর বলেন,
قلت لإبراهيم على الميت شيء موقت قال لا أعلمه
আমি ইবরাহীম রহ.কে জিজ্ঞেস করলাম, জানাযার নামাযে  নির্দিষ্ট কিছু পড়তে হবে? তিনি বললেন, আমার জানা নেই।
(মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক, হাদীস নং ৬৪৩৫)

১৭. সাঈদ ইবনুল মুসায়্যাব র. বলেন,
ما نعلم في الصلاة على الميت من قراءة ولا دعاء شيئا معلوما
জানাযার নামাযে  নির্দিষ্ট কোন কেরাত ও দুআ আছে বলে আমার জানা নেই।
(মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক,হাদীস নং ৬৪৩৬)

ফিকহে মালেকীর প্রসিদ্ধ কিতাব আলমুদাওয়ানাতুল কুবরা-য় সাহাবায়ে কেরাম  ও তাবেয়ীনের উপরোক্ত আমলের কথাই বর্ণিত হয়েছে:

قال ابن وهب عن رجال من أهل العلم عن عمر بن الخطاب وعلي بن أبي طالب وعبد الله بن عمر وفضالة بن عبيد وأبي هريرة وجابر بن عبد الله وواثلة بن الأسقع والقاسم بن محمد وسالم بن عبد الله وابن المسيب وربيعة وعطاء بن أبي رباح ويحيى بن سعيد: أنهم لم يكونوا يقرءون في الصلاة على الميت. قال ابن وهب وقال مالك: ليس ذلك بمعمول به ببلدنا إنما هو الدعاء، أدركت أهل بلدنا على ذلك.

অর্থ: ইবনে ওয়াহব র. হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব, আলী ইবনে আবু তালিব, আবদুল্লাহ ইবনে উমর, ফাযালা ইবনে ওবায়দ, আবু হুরায়রা, জাবের ইবনে আবদুল্লাহ, ওয়াসিলা ইবনে আসকা রাযিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ সাহাবী ও কাসেম ইবনে মুহাম্মদ, সালেম ইবনে আবদুল্লাহ, ইবনুল মুসায়্যাব, রবীয়া, আতা ইবনে আবী রাবাহ ও ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ র. প্রমুখ তাবেয়ী সম্পর্কে বর্ণনা করেন, তাঁরা জানাযার নামাযে কেরাত পড়তেন না। ইবনে ওয়াহব বলেন, মালেক র. বলেছেন, আমাদের শহরে (অর্থাৎ মদীনায়) এর উপর (অর্থাৎ জানাযার নামাযে কেরাত পড়ার উপর) আমল করা হয়না। জানাযা তো দোয়ারই নাম। আমি আমাদের শহরের অধিবাসীদেরকে এর উপরই পেয়েছি। (দ্র, খ: ১ পৃ:২৬৭)

কোন কোন হাদীসে দেখা যায়, সাহাবী ও তাবেয়ীদের কেউ কেউ জানাযার নামাযের  প্রত্যেক তাকবীরের পরই সূরা ফাতেহা  পড়তেন এবং দুআ করতেন। এথেকেও বুঝা যায়, তারা সূরা ফাতেহা  কেরাত হিসেবে নয়, বরং হামদ হিসেবেই পড়েছেন।
যেমন: মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকের বর্ণনা –
عن أبي هريرة وأبي الدرداء وأنس بن مالك وبن عباس أنهم كانوا يقرؤون بأم القرآن ويدعون ويستغفرون بعد كل تكبيرة من الثلاث ثم يكبرون الرابعة فينصرفون ولا يقرؤون.
হযরত আবু হুরায়রা , আবুদ্দারদা, আনাস ইবনে মালিক ও ইবনে আব্বাস রাযিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত, তারা প্রথম তিন তাকবীরের পর সূরা ফাতেহা  পড়তেন, দুআ করতেন ও ইসতিগফার করতেন। এরপর চতুর্থ তাকবীর বলতেন। এবং কোন কেরাত না  পড়েই নামায  শেষ করতেন।
(হাদীস নং ৬৪৩৭)
وعن الحسن كان يقرأ في التكبيرات كلها بأم القرآن
হযরত হাসান )বসরী) র. থেকে বর্ণিত, তিনি প্রত্যেক তাকবীরের পরই সূরা ফাতেহা  পড়তেন। (হাদীস নং ৬৪৩০)
তিরমিযী শরীফে হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আছে,
إنه من السنة أو من تمام السنة
অর্থাৎ সূরা ফাতেহা  পড়া সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত অথবা সুন্নতের পরিপূর্ণতা। এটি যদিও বাহ্যত আমাদের হানাফী মাযহাবের বিপরীত মনে হয়, কিন্তু হযরত ইবনে আব্বাসের উপরোক্ত হাদীসগুলোর সাথে মিলালে দেখা যাবে, ইবনে আব্বাস রা.ও তা কেরাত হিসেবে নয়, বরং হামদ ও দোয়া হিসেবেই পড়তেন।

অর্থাৎ সহীহ হাদীসের আলোকে কথা প্রমানিত যে, কেরাত হিসেবে জানাজার নামাজে সুরা ফতেহা সাহাবীরা পড়তেন না। সাহাবীদের মধ্যে কেউ কেউ পড়লেও তা হামদ ও দুআ হিসেবে পড়তেন।

মহান আল্লাহ আমাদের হকে উপরে প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফিক দেন।
আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published.