তাওয়াক্কুল ইলাল্লাহ -১

‘তাওহীদ’ শব্দের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত এবং সম্ভবত এর মৌলিক অর্থও আমাদের অজানা নয়। তাওহীদের মৌলিক অর্থ জানার ও বোঝার পর আমাদের বিশ্বাস ও কর্মে এবং সমগ্র ব্যবহারিক জীবনে আকীদায়ে তাওহীদের কী প্রভাব পরিলক্ষিত হওয়া দরকার সে সম্পর্কেও সচেতন হওয়া কর্তব্য। ইসলামের এ মৌলিক আকীদার সুফল ও প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা অর্জন করে সে আলোকে নিজের বিশ্বাস ও কর্মের পরীক্ষা নেওয়া এবং বাস্তব ও প্রায়োগিক জীবনে এ প্রভাবগুলো আনার চেষ্টা করা কর্তব্য। এতে আকীদায়ে তাওহীদের যে বীজ আমাদের হৃদয়ভূমিতে রয়েছে তা অঙ্কুরিত হবে এবং পত্র-পল্লবে বিকশিত হয়ে আমাদের সমগ্র জীবনে ছায়া বিস্তার করবে। এ দিক থেকে তাওহীদ-প্রসঙ্গ অনেক ব্যাপক এবং এর ক্ষেত্রও অনেক বিস্তৃত।

ঈমান ও তাওহীদের বিশ্বাস যখন মজবুত হয় তখন অন্তরের অবস্থায় পরিবর্তন আসে এবং বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য আল্লাহপাক দান করেন। তেমনি বাহ্যিক কাজকর্মেও পরিবর্তন আসে এবং বিশেষ বিশেষ গুণ আল্লাহ পাক দান করে থাকেন।

আজ যে বিষয়টি আলোচনা করব তা হচ্ছে তাওহীদের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ও সুফল ‘তাওয়াক্কুল আলাল্লাহ’
তাওয়াক্কুল’ আরবী শব্দ। এর অর্থ, ভরসা করা। অর্থাৎ, দুনিয়া-আখেরাতের সকল কাজে, সকল মকসুদ হাসিল করার জন্য এবং সকল বিপদ-মুসীবত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একমাত্র আল্লাহ পাকের উপর ভরসা রাখা। এটা ইসলামের শিক্ষা। ঈমানের শিক্ষা। বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম সাঈদ ইবনে যুবাইর রাহ. বলেন-

التوكل على الله ـ عز وجل ـ جماع الإيمان

অর্থাৎ আল্লাহর উপর ভরসা করা এমন গুণ যা অনেক ঈমানী গুণের ধারক। (আযযুহদ, হান্নাদ ইবনুস সারী ১/৩০৪)

এ শিক্ষার অনেক সুফল এমন আছে যা দুনিয়ার জীবনেই পাওয়া যায়। আল্লাহ পাক যে আমাদের কুরআন-সুন্নাহর বিধান দান করেছেন এ শুধু আখেরাতের সফলতার জন্য নয়, দুনিয়া-আখেরাত উভয় জাহানের সফলতার জন্য। তাই কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা ও বিধান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে দেখা যাবে, দুনিয়াতে যত অশান্তি, যত অনাচার তার মূলে রয়েছে কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়া। আল্লাহ পাকের বন্দেগী ও আনুগত্য ত্যাগ করা। আমরা যদি আল্লাহ পাকের আনুগত্যের দিকে ফিরে আসি এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামের শিক্ষাকে অবলম্বন করি তাহলে আখেরাতের জীবন তো সফল হবেই আমাদের দুনিয়ার জীবনও সুন্দর ও শান্তিময় হবে। এটা ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

তবে ইসলামের শিক্ষা অনুসরণের ক্ষেত্রে দুনিয়ার উপকারিতা লাভ করা মুখ্য উদ্দেশ্য হবে না। আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি পাওয়া এবং আখেরাতের কামিয়াবী অর্জন করা।

কুরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় তাওয়াক্কুল-প্রসঙ্গ আছে। হাদীস শরীফেও আছে। তাওয়াক্কুল কী, এর উপকারিতা কী, দুনিয়ার উপায়-উপকরণ অবলম্বনের সাথে তা সাংঘর্ষিক কি না এ ধরনের অনেক বিষয়ের সমাধান কুরআন-সুন্নাহয় আছে।

সূরায়ে যুমারে আল্লাহ তাআলার ইরশাদ

وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ

(তরমজা) অর্থাৎ আপনি যদি মক্কার মুশরিকদের জিজ্ঞাসা করেন আসমান ও জমিন কে সৃষ্টি করেছেন? অবশ্যই তারা বলবে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। (সূরা যুমার : ৩৭)

তারা তো বিভিন্ন দেবদেবীর উপাসনা করে, কারো কাছে জ্ঞান চায় কারো কাছে স্বাস্থ্য চায়, কারো কাছে রিযিক চায়, কারো কাছে সন্তানসন্ততি চায়, কারো কাছে আয় উপার্জন চায়, কারো কাছে বালামুসিবত থেকে আশ্রয় চায় এভাবে অনেক খোদা, অনেক মাবুদ, একেক প্রয়োজনের জন্য একেক মাবুদ বানিয়ে রেখেছে।
কিন্তু যখন জিজ্ঞাসা করবেন, ‘আসমান-যমীন কে সৃষ্টি করেছেন
উত্তরে একথাই বলবে যে, আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন
অর্থাৎ তাদেরও বিশ্বাস ছিল, আসমান যমীনের সৃষ্টিতে এই সকল দেব-দেবীর কোনো হিস্যা নেই এবং আসমান-যমীনে মানুষের জীবনধারণের যত উপকরণ এগুলোও আল্লাহ ছাড়া আর কেউ সৃষ্টি করেননি। আল্লাহই সকল কিছুর স্রষ্টা। তাহলে এত দেব-দেবীর পূজা তারা কেন করত? তারা মনে করত কিছু কিছু কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষমতা এই সকল দেব-দেবীর আছে, যদিও সে ক্ষমতা স্বয়ংসম্পূর্ণ না, আল্লাহ প্রদত্ত! এজন্য তারা তালবিয়ায় ‘লা শারীকা লাক’ (‘তোমার কোনো শরীক নেই’) বাক্যের সাথে নিজেদের পক্ষ থেকে এ বাক্যটি জুড়ে নিয়েছিল- ‘ইল্লা শারীকান হুয়া লাক্ তামলিকুহূ ওয়ামা মালাক্’ অর্থাৎ, তবে এমন শরীক আছে যার মালিক অবশ্য তুমি আর ওদের যা কিছু ক্ষমতা-কর্তৃত্ব সেগুলোরও মালিক তুমি (নাউযুবিল্লাহ)। এ ছিল তাদের শিরকের ধরন। তারা নাস্তিক ছিল না, মুশরিক ছিল।

সামনে আল্লাহ পাক তাদের এ বিভ্রান্তি সমূলে উৎপাটন করে তাঁর রাসূলকে বলছেন,
‘‘হে রাসূল, আপনি তাদের প্রশ্ন করুন, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের কাছে প্রার্থনা কর, বল তো, আল্লাহ যদি আমার ব্যাপারে কোনো অকল্যাণের ইচ্ছা করেন তোমাদের এই দেবদেবী কি আমাকে ঐ অকল্যাণ থেকে রক্ষা করতে পারবে? তেমনি আল্লাহ যদি আমার ব্যাপারে কোনো কল্যাণের ফায়সালা করেন সমস্ত দেবদেবী মিলেও কি তা প্রতিরোধ করতে পারবে?’’
অর্থাৎ আমি তো এই সমস্ত মূর্তি ও দেব-দেবীর সবচেয়ে বড় শত্রু। এদের বিরুদ্ধেই তো আমার দাওয়াত। এরা কি পারবে আমার কোনো ক্ষতি করতে কিংবা পারবে কোনো উপকার করতে? পারবে না। আমার কল্যাণ-অকল্যাণ সবই হবে একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছায়। এদের ইচ্ছায় নয়। তাহলে তোমাদেরও কোনো কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষমতা এদের নেই। যখন নেই তখন হে রাসূল আপনি বলুন, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট আর আল্লাহর উপরেই প্রত্যেক ভরসাকারীর ভরসা করা উচিত।

কার উপর তাওয়াক্কুল করবো?

মানুষকে দুনিয়ার জীবনে ভরসা করতে হয়। কোথাও না কোথাও তাকে আত্মসমর্পন করতেই হয়। সব দুঃখ বেদনা কোথাও না কোথাও বলতেই হয়। সেই স্থানটা কোনটা? যারা ঈমান থেকে বঞ্চিত, ঈমানের শিক্ষা থেকে মাহরূম, তারা সেই স্থান এমন ব্যক্তি বা বস্ত্তকে বানিয়ে নেয় বাস্তবে যাদের কল্যাণ-অকল্যাণের কোনোই ক্ষমতা নেই। পক্ষান্তরে আল্লাহ যাদেরকে ঈমান দান করেছেন, তাওহীদের আলোয় আলোকিত করেছেন তারা তাদের সকল বেদনা, সকল প্রার্থনা এমন একজনের কাছে পেশ করে যিনি বাস্তবেই মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক। আর যিনি সৃষ্টির প্রতি পরম দয়ালু।

ইরশাদ হয়েছে

وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ

‘ভরসা কর পরাক্রমশালী করুণাময়ের উপর।’ (সূরা শুআরা : ২১৭)

আরো ইরশাদ –

وَتَوَكَّلْ عَلَى الْحَيِّ الَّذِي لَا يَمُوتُ

ভরসা কর চিরঞ্জীবের উপর, যার মৃত্যু নেই। (সূরা ফুরকান : ৫৮)

তো সূরা যুমারের এ আয়াতে পরিষ্কার হয়ে গেল, তাওয়াক্কুলের হাকীকত কী, বা কাকে বলে তাওয়াক্কুল। তাওয়াক্কুল হচ্ছে ভরসা করা, জীবনের সকল বিষয়ে, কল্যাণ লাভের ক্ষেত্রেও, অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাবার ক্ষেত্রেও। আর তা এমন সত্ত্বার উপরই হতে পারে যিনি সকল বস্ত্তর স্রষ্টা। বস্ত্তর গুণ ও বৈশিষ্ট্যের স্রষ্টা। যিনি গোটা জাহানের পালনকর্তা এবং যিনি দুনিয়া-আখিরাতের সকল কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক, এমন সত্ত্বার উপরই ভরসা করা যায়। তাঁর পরিবর্তে মানুষ যদি অন্য কারো উপর ভরসা করে তাহলে তা হবে তাওয়াক্কুলের পরিপন্থী।

তাওয়াক্কুলহীনতার বিভিন্ন পর্যায়:

এখানে একটি বিষয় ভালোভাবে বুঝে নেওয়া দরকার। তা এই যে, ভালোর যেমন স্তরভেদ আছে তেমনি মন্দেরও আছে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপর ভরসা করারও বিভিন্ন স্তর ও পর্যায় আছে। ভরসা করা অন্তরের কাজ। এটা আল্লাহর প্রতিই থাকতে হবে। একারণে অন্য কারো উপর ভরসা করলে তা নিঃসন্দেহে তাওয়াক্কুল পরিপন্থী ও মাসিয়াত। এখন যদি এর সাথে শিরকী কোনো আকীদা যুক্ত হয় যেমন গায়রুল্লাহকে অলৌকিক ক্ষমতার মালিক মনে করে তার উপর ভরসা করে তাহলে তা সরাসরি শিরক। আর যদি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বিশ্বাস করে নয়; বরং পার্থিব অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতার কারণে ভরসা করে তবে তা সরাসরি শিরকে আকবর না হলেও মা’ছিয়াত ও তাওয়াক্কুল বিরোধী। এটা প্রকৃতপক্ষে পার্থিব উপায়-উপকরণের উপর ভরসা, যা নিষেধ। ভরসা একমাত্র আল্লাহর উপরই করতে হবে।

 

পরবর্তী অংশ:
তাওয়াক্কুল ইলাল্লাহ -২

Leave a Comment

Your email address will not be published.