তাকওয়ার দুই স্তর, মুত্তাকীর দুই শ্রেণী-২

পূর্বের অংশ:
তাকওয়ার দুই স্তর, মুত্তাকীর দুই শ্রেণী-১

আল্লাহ পাকের কি আনন্দিত হওয়ার কোনো দরকার আছে? এই বান্দা যদি তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে তাতে কি আল্লাহ পাকের কোনো লাভ আছে? তাতে কি আল্লাহ পাকের বড়ত্ব ও মহত্ত্ব বেড়ে যাবে? আল্লাহ পাকের রাজত্ব বেড়ে যাবে? কিছুই হবে না।   এটা হল আল্লাহ পাকের রহম ও করমের প্রকাশ, তাঁর দয়া ও করুণার প্রকাশ যে, তাঁর কোনো বান্দা তওবা করে ফিরে এলে তিনি খুশি হন। সহীহ মুসলিমের আরেক হাদীসে আছে –

إن الله عز وجل يبسط يده بالليل ليتوب مسيء النهار ويبسط يده بالنهار ليتوب مسيء الليل حتى تطلع الشمس من مغربها

আল্লাহ পাক রাতের বেলা তাঁর হাত প্রসারিত করেন যেন দিনের অপরাধী তাঁর দিকে ফিরে আসে। আবার দিনের বেলা তাঁর হাত প্রসারিত করেন যেন রাতের অপরাধী তাঁর দিকে ফিরে আসে। এবং এভাবে সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হওয়া- অর্থাৎ কিয়ামতের আগ পর্যন্ত আল্লাহ পাক তাঁর গোনাহগার বান্দাদের জন্য তাঁর দয়া ও করুণা প্রসারিত রাখেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৫৯

তো মুত্তাকী ও পরহেযগার বান্দা তারাই যাদের অন্তরে শয়তান যখন কোনো কুমন্ত্রণা দেয় তখন তারা আল্লাহকে স্মরণ করে এবং গোনাহ থেকে বিরত থাকে। কিংবা কখনো গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে।

পক্ষান্তরে যারা শয়তানের ভাই-বেরাদার তাদের অবস্থা কী? তাদের অবস্থা হল-

وَإِخْوَانُهُمْ يَمُدُّونَهُمْ فِي الْغَيِّ ثُمَّ لَا يُقْصِرُونَ

শয়তান তাদেরকে গোমরাহীর পথে মদদ দিতে থাকে এবং এগিয়ে নিতে থাকে। আর এবিষয়ে কোন ত্রুটি করে না। ফলে ওরা চূড়ান্ত গোমরাহীতে গিয়ে নিপতিত হয়। এরপর সে অবস্থায়ই তাদের মৃত্যু হয়। আর আল্লাহ তাআলার সামনে তারা শয়তানের ভাই হিসাবেই উপস্থিত হয়। তো আল্লাহ পাকের কোনো বান্দা যদি তাঁর সামনে তাঁর সবচে’ বড় অবাধ্য-শয়তানের দোসর হিসাবে উপস্থিত হয় তার পরিণাম কী হবে?! তার পরিণাম তো অত্যন্ত ভয়াবহ। এজন্য গোনাহর চিন্তা মনে এলেই আল্লাহর আশ্রয় নেয়া উচিত। আর কখনো গোনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করা উচিত। সঙ্গে সঙ্গে ভাবা উচিত যে, আমি ভুল পথে আছি। এই পথ আমাকে দুনিয়াতে লাঞ্ছিত করবে। এই পথ আমাকে আখেরাতে ধ্বংস করবে। এই পথ আমার সুনাম-সুখ্যাতি মান-মর্যাদা সব ধুলোয় মিশিয়ে দেবে। এইভাবে চিন্তা করা উচিত। যখন মানুষ এইভাবে চিন্তা করে তখন তার ফিরে আসা সহজ হয়ে যায়।

তওবা কাকে বলে? আলিমগণ কুরআন-সুন্নাহর আলোকে তওবার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে যে, কারো যখন গোনাহ হয়ে যাবে সঙ্গে সঙ্গে সেই গোনাহ পরিত্যাগ করবে। সেই গোনাহর জন্যে অনুতপ্ত হবে এবং ভবিষ্যতে না করার সংকল্প করবে। আর সেই গোনাহর ক্ষতিপূরণের কোনো বিধান যদি শরীয়তে থাকে তাহলে তা পালন করবে। যেমন কারো নামায কাযা হয়ে গেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে অনেকদিন নামায পরিত্যাগ করেছে। তাহলে তাকে সেই নামাযগুলোও কাযা করতে হবে। এমনিভাবে কেউ যদি কারো কাছ থেকে অন্যায়ভাবে সম্পদ নিয়ে থাকে। ছিনতাই বা আত্মসাৎ করে থাকে, তাহলে তার তওবা শুধু এটুকুই নয় যে, সে অনুতপ্ত হবে এবং ভবিষ্যতে না করার সংকল্প করবে; বরং তাকে সেই লুণ্ঠিত বা আত্মসাৎকৃত সম্পদও ফিরিয়ে দিতে হবে।
সুতরাং তওবা পূর্ণ হয় তিন কাজের দ্বারা :
এক. অনুতপ্ত হওয়া।
দুই. গোনাহ ছেড়ে দেওয়া ও ভবিষ্যতে না করার সংকল্প করা।
তিন. ক্ষতিপূরণের যে বিধান ইসলামী শরীয়তে আছে তা পালন করা।
এই তিন কাজ যখন হয় তখন তওবা পূর্ণ হয়। তখন আল্লাহ পাক ঐ বান্দাকে কবুল করেন।

কুরআন মাজীদের ফরমান, আল্লাহ পাক বান্দার তওবা খুব কবুল করেন। বারবার কবুল করেন। আল্লাহ পাকের এক পবিত্র নাম ‘আততাওয়াব’। অর্থাৎ আল্লাহ পাক বান্দার দিকে বারবার রহমতের দৃষ্টি দেন। বারবার তওবা কবুল করেন। কুরআন মাজীদে এসেছে إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ ‘আততাওয়াব’ নামের সাথে আনা হয়েছে ‘আর রাহীম’ নাম। অর্থাৎ আল্লাহ পাক তাঁর দয়া ও করুণার কারণে বান্দার তওবা বারবার কবুল করেন

তো এই আয়াতে আল্লাহ পাক আমাদের জন্যে, আমাদের বাস্তব জীবনের জন্যে এক গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি দান করেছেন। গোনাহকে সামান্য মনে না করা। অন্তরে গোনাহর ভাব সৃষ্টি হওয়ামাত্র সাবধান হওয়া। আর কখনো গোনাহ হয়ে গেলে হতাশ না হওয়া। আল্লাহ পাকের রহমত থেকে তো ঐ ব্যক্তি হতাশ হয়, যে আল্লাহ পাকের রহমতকে ছোট মনে করে। আল্লাহ পাক এক হাদীসে কুদসীতে তার মাগফিরাতের প্রশস্ততা বর্ণনা করেছেন। আনাস ইবনে মালিক রা. বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, আল্লাহ বলেন-

يا ابن آدم إنك ما دعوتني ورجوتني غفرت لك على ما كان فيك ولا أبالي، يا ابن آدم لو بلغت ذنوبك عنان السماء ثم استغفرتني غفرت لك ولا أبالي، يا ابن آدم إنك لو أتيتني بقراب الأرض خطايا ثم لقيتني لا تشرك بي شيئا لأتيك بقرابها مغفرة

হে আদমসন্তান! তোমার পক্ষ হতে যা-ই প্রকাশ পাক, যে পর্যন্ত তুমি আমাকে ডাকতে থাকবে এবং আমার কাছে আশা করতে থাকবে আমি তোমাকে ক্ষমা করতে থাকব এবং আমি কোনো পরোয়া করব না। তোমার গোনাহ যদি আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়, (পৃথিবীর সকল শূন্যতা ভরাট করে) আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এরপর তুমি ইসতিগফার কর। তো আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব এবং কোনো পরোয়াই করব না। হে আদমসন্তান! তুমি যদি আমার কাছে আস পৃথিবী-ভরা ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে আর আস কোনো কিছুকে আমার সাথে শরীক না করে তাহলে আমি তোমার সাথে সাক্ষাৎ করব পৃথিবী-ভরা মাগফিরাত নিয়ে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৪০

আল্লাহ পাক এত বেনিয়ায, এত অমুখাপেক্ষী যে, বান্দাকে ক্ষমা করার জন্যে কোনো কিছুর পরোয়া করার দরকার পড়ে না। ‘এত বড় গোনাহগার এত বড় পাপী! কীভাবে আপনি তাকে ক্ষমা করলেন’- এমন প্রশ্ন করার কেউ নেই। সেজন্যে আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি তোমাকে মাফ করে দেব এবং কোনো পরোয়াই করব না।

তো যে মালিক এভাবে বান্দাকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত সেই মালিকের কাছ থেকে কেন আমি ক্ষমা নেব না? কেন তাঁর কাছে ছুটে যাব না?

আগের যুগের একজন মানুষের ঘটনা আছে যে নিরানববইজন মানুষকে খুন করেছিল। এরপর একসময় তার মধ্যে অনুতাপ এল যে, আমি এত মানুষ হত্যা করে ফেললাম! আমি এত খারাপ! এত পাপী!? তখন সে এক দরবেশের কাছে গিয়ে বলল, আমি তো একে একে নিরানববইজন মানুষকে হত্যা করেছি, আমার কি মুক্তির কোনো পথ আছে? দরবেশ আলেম ছিলেন না। তিনি হয়তো চিন্তা করলেন, যেখানে একজন মানুষকে হত্যা করলেই জাহান্নাম অবধারিত সেখানে নিরানববই হত্যা! বললেন, ‘না তোমার মুক্তির কোন উপায় নেই।’ সেই লোক উত্তেজিত হয়ে দরবেশকেও হত্যা করল এবং তার মাধ্যমে একশ পূর্ণ করল। এরপরও তার মনে যন্ত্রণা, আসলেই কি আমার মুক্তির কোনো উপায় নেই?! আবার গেল একজনের কাছে। তিনি ছিলেন সে সময়ের একজন আলেম। তাকে গিয়ে বলল,‘আমার কি মুক্তির কোনো পথ আছে?’ তিনি বললেন, ‘কেন থাকবে না? অবশ্যই আছে। তোমার জন্যে তওবার সুযোগ আছে। তুমি গোনাহ করেছ। অনেক বড় অপরাধ করেছ। তাই বলে নিরাশ হবে কেন? আল্লাহ পাকের ক্ষমা, আল্লাহ পাকের দয়া তো তোমার গোনাহর চেয়েও বড়। সুতরাং তুমি নিরাশ হয়ো না। এক কাজ কর, যে এলাকায় তুমি আছ সেটা ভালো না। ওখানের পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে তুমি গোনায় জড়িয়ে যাচ্ছ। তুমি অমুক এলাকায় চলে যাও। ওখানে কিছু ভালো মানুষ আছে। তাদের সাথে মিশে ওখানেই আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে থাক। হতে পারে আল্লাহ পাক তোমার ইবাদত বন্দেগীর ওসীলায় তোমাকে মাফ করবেন, তোমার তওবা কবুল করবেন।’ এ কথা শোনার পর যেন তার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। সে তখন মুক্তির আশায় ঐ এলাকার দিকে রওয়ানা হল। কিন্তু আল্লাহর হুকুম- ঐ এলাকায় পৌঁছার আগেই তার জীবনের শেষ মুহূর্ত উপস্থিত। তার মৃত্যু হয়ে গেল। এখন দুই দল ফিরিশতা এসে গেল তার রূহ নিয়ে যাওয়ার জন্য। জান্নাতের ফিরিশতা এবং জাহান্নামের ফিরিশতা। জাহান্নামের ফিরিশতারা বলছে, এই লোক অনেক বড় পাপী। একশ মানুষের খুনি। আমরা তাকে জাহান্নামে নিয়ে যাব। আর জান্নাতের ফিরিশতারা বলছে, সে তো তওবা করেছে। সুতরাং আমরা তাকে জান্নাতে নিয়ে যাব। এভাবে যখন ফিরিশতারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না তখন তারা আল্লাহ তাআলার কাছে গেল। আল্লাহ তায়ালা তো সব জানেন। তিনি বললেন, তোমরা তার মৃত্যুর জায়গা ও দুই এলাকার দূরত্ব মেপে দেখ। যে এলাকার দিকে সে যাচ্ছিল যদি সেটা নিকটে হয় তাহলে তাকে জান্নাতে নিয়ে যাও। কারণ সে ভালোর দিকে বেশি অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। আর যদি যে এলাকা থেকে এসেছে সেটা নিকটে হয় তাহলে ধরে নাও সে ভালোর দিকে বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। ফিরিশতারা উভয় দিকের জায়গা মেপে দেখল। এক রেওয়ায়েতে আছে, সে ভাল মানুষদের এলাকার কাছাকাছি যেতে পারেনি। কিন্তু আল্লাহ তাআলা ঐ যমীনকে বললেন- তুমি নিকটে আস। আর পেছনের পথকে বলেছেন- তুমি দীর্ঘ হয়ে যাও। ফলে সে ঐ ভালো অঞ্চলের নিকটবর্তী প্রমাণিত হল এবং জান্নাতের ফিরিশতারা তাকে জান্নাতে নিয়ে গেল।

এই হল আল্লাহ পাকের রহম ও করমের অবস্থা। আল্লাহ পাকের দয়া ও করুণার দৃষ্টান্ত। সুতরাং যিনি এত রহমান, এত রাহীম, যিনি তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করার জন্যে এত আগ্রহী তার আশ্রয় কেন আমরা গ্রহণ করব না? তাঁর অবাধ্যতা কেন বর্জন করব না? কেন আমরা পবিত্র জীবন গ্রহণ করব না?

তো কুরআনে পাকে আল্লাহ তাআলা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় বান্দাকে তওবার দিকে ডেকেছেন। আল্লাহর দিকে ফিরে আসার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। সেজন্যে আমাদের কর্তব্য, গোনাহ হয়ে গেলেই তওবা করা। সেই রহমান ও রাহীম আল্লাহর কাছে ফিরে আসা এবং তাঁর আশ্রয় গ্রহণ করা।

আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। সবাইকে কবুল করুন। সবাইকে তাঁর নৈকট্যশীল ও প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন।
আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published.