তাবলীগের মেহনত ও আলিমের সোহবত

কয়েক বছর আগে আমাদের সেনবাগ থানায় নোয়াখালি জেলার একটি  তাবলীগী ইজতিমা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাবলীগের ইজতিমা যেখানেই হোক, বিশ্ব ইজতিমার মতো তিন দিনের কর্মসূচি প্রায় একই ধরনের হয়ে থাকে। ইজতিমার আগের কয়েকটি মাশোয়ারায় আশপাশের মাদরাসাগুলোকেও দাওয়াত করা হয়েছিল। সেই সূত্রে ঐ মাশোয়ারাগুলিতে আমিও হাজির ছিলাম।
ফেনী জেলা তাবলীগ জামাতের অন্যতম মুরববী, বুযুর্গ আলেমে দ্বীন হযরত মাওলানা হানীফ সাহেবকে কাকরাইল থেকে রামগড় ও সেনবাগের ইজতিমাকে কামিয়াব করার জন্য যাবতীয় মেহনতের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। বিশ্ব ইজতিমায় যেমন বিভিন্ন তবকার মধ্যে বয়ান ও মেহনত হয়ে থাকে এই ইজতিমাতেও সেরকম মেহনত হয়।  ‘কদীম’ দের মাঝে বয়ানের বিষয়ে মাশোয়ারা হচ্ছিল।
একপর্যায়ে মাওলানা হানীফ সাহেব হুজুর সবাইকে প্রশ্ন বরলেন-‘কদীম’ বা পুরাতন কে?
আমরা সবাই চুপ করে রইলাম। তখন তিনি নিজেই বললেন, যদি তিন চিল্লা ওয়ালাকে কদীম বলা হয় তাহলে আমিও কদীমের মধ্যে পড়ি না। কারণ আমার এক সাথে তিন চিল্লা হয়নি। তিনি আরো বললেন, হযরতজী মাওলানা এনামুল হাসান সাহেবের   ইন্তেকালের পর থেকে বিশ্ব ইজতিমার আগে হযরত মাওলানা ইলিয়াস সাহেব রাহ.-এর একজন সাথী মিয়াজী মেহরাব সাহেব প্রায় এক মাস আগেই ঢাকায় আগমন করতেন এবং হযরতজীর অনুপস্থিতিতে মোনাজাতও তিনিই করতেন। বিশ্ব ইজতিমার আগের সব কটি মাশওয়ারায় তিনি আমীরে ফয়সাল থাকতেন। মাশওয়ারায় কদীমদের মাঝে বয়ানের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল।
মিয়াজী মেহরাব সাহেব তখন আহলে শুরার কাছে প্রশ্ন রাখলেন, ভাই! কদীম কৌন হ্যায়? অর্থাৎ তাবলীগে কদীম বা পুরাতন কে?
আহলে শুরাকে কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে থাকতে দেখে তিনি নিজেই উত্তর দিলেন, ভাই! ইহাঁ কদীম তো ওহ  হ্যায়, জিসকো পুরা দ্বীন কা সমঝ আ-গায়া হো, চাহে উসকা এ-ক চিল্লা ভী না হো। অর্থাৎ তাবলীগে কদীম বা পুরাতন ঐ ব্যক্তিকে বলা হবে, যার মধ্যে পুরা দ্বীনের সমঝ-বুঝ এসে গেছে। চাই তার এক চিল্লাও না থাক।

আমি মাওলানা হানীফ সাহেবের মুখ থেকে মিয়াজী মেহরাব সাহেবের মুখে ‘কদীম’ সম্পর্কিত এই ব্যাখ্যা শোনার পর খুব চমৎকৃত হয়েছিলাম। নিযামুদ্দীনের হযরত মাওলানা ইবরাহীম ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম একবার ‘খুরুজ’ শব্দের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেন-

এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়াই খুরুজ নয়। এটা তো জাহেরী খুরুজ। হাকীকী বা প্রকৃত খুরুজ হল শাহওয়াতের গোলামী থেকে বের হয়ে হেদায়েতের দিকে আসা। আর একথা তো বলাবাহুল্য যে, হেদায়েতের দিকে বের হওয়া তখনই হতে পারে যদি হেদায়েতওয়ালা যারা তাদের নিকটে যাওয়া এবং তাদের সোহবত-সান্নিধ্যের দ্বারা হেদায়েতের আলো গ্রহণ করা হয়।

হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর নির্দেশনা ছিল, হক্কানী আলেমদের কাছে গিয়ে দুআ চাওয়া ও কাজের কারগুযারী শোনানো। এতে হক্কানী আলেমদের সাথে তাআল্লুক হবে এবং কাজে বরকত হবে ইনশাআল্লাহ।

হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-এর যমানায় হক্কানী আলেমদের বিনা চিল্লায়ও মিম্বরে বয়ানের দরখাস্ত করা হত।

১৯৩৩ ঈসায়ীতে কনকনে শীতের মাঝে হযরত মাওলানা সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. কে দিল্লী জামে মসজিদে নিয়ে আসেন হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.। হযরত মাদানী রাহ. হেদায়েত দান করতে গিয়ে আবেগের সাথে বললেন, আপনারা যে কাজের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তার ফলে বাতেল খতম হয়ে যাবে। ভারতবর্ষ থেকে বৃটিশের শাসন-শোষণের অবসান হবে। লালকেল্লার ওপর যে ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা উড়ছে তা ভূপাতিত হবে। সেদিন হযরত মাদানীর একথা বলার সাথে সাথে আকস্মিকভাবে লাল কেল্লার পতাকাটি নিচে পড়ে যায়। দিল্লী জামে মসজিদ লোকে লোকারণ্য ছিল। এই অস্বাভাবিক কেরামতি কান্ড দেখে তারা সকলে জোরে না’রায়ে তাকবীর-আল্লাহু-আকবার ধ্বনি দিয়ে ওঠে। বৃটিশ রাজ পতাকা পড়ে যাওয়ার বিষয়টি তো আর হযরত মাদানী দেখেননি এবং বলতেও পারবেন না হয়তো। তাই তিনি জোরের সাথে ভৎর্সনা করে বললেন, আজকাল লোকেরা জোশ-জযবা সব না’রা লাগানোর মধ্যেই শেষ করে দেয়। একটি দ্বীনী আমলের কথা বলছি, তা মনোযোগ সহকারে শুনুন এবং বোঝার চেষ্টা করুন। (বৈচিত্রের মাঝে ঐক্যের সুর, পৃ. ৫৭৮; তাবলীগি তাহরীকের সূচনা ও মূলনীতি পৃ. ২৬, ২৭; সীরাতে শাইখুল ইসলাম মাওলানা নাজমুদ্দীন এসলাহীকৃত ২/৪০৭-৪০৮)

তাবলীগী ভাইদের উচিত হবে হক্কানী আলেমদের সাথে সম্পর্ক করা ও তাঁদের কাছে বেশি বেশি যাওয়া এবং তাদের হেদায়েত মোতাবেক দ্বীনের মেহনত করা।

মাওলানা হানীফ সাহেব হুজুর তিন চিল্লা ওয়ালা কদীম না হওয়া সত্ত্বেও কাকরাইল থেকে তাঁকে দুটি ইজতিমার মেহনতের দায়িত্ব দেওয়ায় বোঝা যাচ্ছে, পুরা দ্বীনের সমঝ-বুঝের সাথে সাথে তাবলীগের সাথে পুরো মোনাসাবাত রাখেন এমন হক্কানী আলেমকে কাকরাইলের মুরববীরাও কদীমই মনে করেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে দ্বীনের সমঝ-বুঝ নসীব করুন। আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published.