দ্বীন আল্লাহর, রক্ষকও আল্লাহ

ইসলাম তো ঐ দ্বীন যা রাববুল আলামীনের পক্ষ হতে অবতীর্ণ। আল্লাহ যেমন একমাত্র মালিক তেমনি ইসলামও একমাত্র দ্বীন। যেহেতু আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রভু নেই তাই ইসলাম ছাড়া আর কোনো ধর্মও নেই। ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও বিশ্বাস থেকে আলাদা হয়ে ধর্ম কিংবা অধর্মের নামে যত মতবাদ তৈরি হয়েছে সবই ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্নতা। কুরআন মজীদে এ বাস্তবতা বারবার উল্লেখিত হয়েছে।

এখানে মনে রাখতে হবে যে, ইসলামই হচ্ছে সর্বপ্রাচীন ও চিরনবীন ধর্ম। প্রথম মানব হযরত আদম আ.-কে আল্লাহ তাআলা ইসলাম দিয়েই পাঠিয়েছিলেন এবং তাঁর সন্তানরাও সকলে ছিল এক উম্মাহ, এক জাতি। এরপর ধীরে ধীরে তাদের মাঝে বিভ্রান্তি ও বিচ্যুতি বিস্তার লাভ করে এবং আল্লাহর দ্বীনের একেকটি মৌলিক বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিতে বিভক্ত হয়েছে।

وَمَا كَانَ النَّاسُ إِلَّا أُمَّةً وَاحِدَةً فَاخْتَلَفُوا وَلَوْلَا كَلِمَةٌ سَبَقَتْ مِنْ رَبِّكَ لَقُضِيَ بَيْنَهُمْ فِيمَا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ

মানুষ ছিল একই উম্মাহ পরে তারা বিভক্ত হয়েছে। তোমার রবের পূর্ব সিদ্ধান্ত না থকলে তারা যে সব বিষয়ে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করছে সে সব বিষয়ে তাদের মাঝে ফয়সালা করে দেওয়া হত। -সূরা ইউনুস ১০:১৯
এরপর যুগে যুগে যত নবী-রাসূল এসেছেন তাঁদের সবার দ্বীন ছিল ইসলাম যার মূল শিক্ষা হচ্ছে তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। প্রত্যেক নবী তাঁর জাতিকে তাহীদের দিকে ডেকেছেন এবং রিসালাতে ঈমান এনে আল্লাহর বিধান শিরোধার্য করার আদেশ করেছেন। হযরত ইবরাহীম আ., যাঁর বিষয়ে সকল আহলে কিতাব একমত এবং নিজেদেরকে তারা যার অনুসারী দাবি করে থাকে তাঁর ধর্ম-পরিচয় কী ছিল? আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-

مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيفًا مُسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

ইবরাহীম না ইহুদী ছিল না নাসরানী; সে তো ছিল একনিষ্ঠ মুসলিম। আর সে মুশরিকদেরও অন্তুর্ভুক্ত ছিল না। -সূরা আলে ইমরান ৩:৬৭

এ ইসলামের পূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গতম রূপ নাযিল করা হয়েছে শেষ নবী ও শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর। আল্লাহ তাআলার ইরশাদ –

الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا

আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতও পূর্ণ করলাম। আর দ্বীন হিসাবে ইসলামকে তোমাদের জন্য মনোনীত করলাম। -সূরা মাইদা ৫:৩

আর এ কারণেই কিয়ামত পর্যন্ত ইসলাম ছাড়া আর কোনো ধর্মই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ইসলাম ছাড়া আর সকল ধর্ম আল্লাহর কাছে বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা হিসেবে গণ্য।

إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ وَمَا اخْتَلَفَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ إِلَّا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ وَمَنْ يَكْفُرْ بِآَيَاتِ اللَّهِ فَإِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ

নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন। যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছিল তারা পরষ্পর বিদ্বেষ বশত তাদের নিকট জ্ঞান আসার পর বিভেদ ঘটিয়েছিল আর কেউ আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করলে আল্লাহ তো হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর। -সূরা আন নিসা ৪:১৯

ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদ গ্রহণের অর্থই হল প্রভুর আনুগত্য বর্জন ও বিদ্রোহ। বলাবাহুল্য, এ বিদ্রোহ ও আনুগত্য বর্জনের কারণে আখিরাতে তাকে চরম ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার হতে হবে।

وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ

কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনো কবুল করা হবে না এবং আখিরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। -সূরা আলে ইমরান ৩:৮৫

এ এক বাস্তবতা, যা স্বীকার করা এবং স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে তা শিরোধার্য করাই হচ্ছে মুসলিম পরিচয়ের অন্যতম দাবি। এ বোধ ও বিশ্বাস ছাড়া মুসলিম নামটাই অর্থহীন হয়ে যায়। এ তো হল সাধারণ অবস্থার কথা, যখন ইসলাম ও অন্যান্য মতবাদের সাথে সংঘর্ষ না হয় কিংবা কোনো একটিকে বেছে নেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি না হয়। কিন্তু যখন এ ধরনের ক্ষেত্র ও পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন তো বিশ্বাসে ও উচ্চারণে অন্য সকল ইসলাম-বিদ্বেষী মতবাদ থেকে সম্পর্কহীনতার ঘোষণাও অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

ঈমান ও ইসলামের ক্ষেত্রে ‘রাজী রাহে রহমান ভী, রাজী রাহে শয়তান ভী’ -জাতীয় অবস্থান নিয়ে মুসলিম থাকা যায় না। আর সুস্পষ্ট বিরোধী অবস্থান নিয়ে মুসলিম থাকার তো প্রশ্নই আসে না। ঐ ব্যক্তি আদমশুমারীতে মুসলিম হতে পারে, তার পিতৃপ্রদত্ত নাম ‘মিজানুর রহমান’  (রহমানের নিক্তি) ‘মুতিউর রহমান’ (রহমানের অনুগত) এমনকি ‘হাবীবুর রহমান’ (রহমানের বন্ধু)ও হতে পারে, কিন্তু আল্লাহর বিধানে সে মুসলিম নয়। এ শ্রেণীর মানুষ রহমানের বান্দা নয়। রহমানের বান্দার পরিচয় ও বৈশিষ্ট্য স্বয়ং কুরআনেই বর্ণিত হয়েছে সুস্পষ্টভাবে। (দ্র. সূরা ফুরকান ২৫:৬৩-৭৬)

একইভাবে একথাও সম্পূর্ণভাবে মনে রাখতে হবে যে, ইসলাম কোনো লা-ওয়ারিশ ধর্ম নয়, যে কেউ যে কেনো ‘ব্যাখ্যা’ করতে পারে। ইসলামের সকল বিষয় সুস্পষ্ট। আকীদা ও আহকামে তথা বিশ্বাস ও কর্ম সকল ক্ষেত্রেই ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টতা। বিধান, বিশ্বাস, চিন্তা কোনো ক্ষেত্রেই ‘প্রগতিশীল’ ব্যাখ্যার নামে অপব্যাখ্যার মত অবিশ্বাসের প্রক্ষেপণ ইসলামে সম্ভব নয়। সম্ভব নয় বলেই তো দেড় হাজার বছরের দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পরও ইসলামের সকল শিক্ষা সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থায় এখনো বিদ্যমান। এ দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় ইসলামের শিক্ষাকে বিকৃত করার এবং বিভিন্ন যুগে একে ‘আধুনিক’ ও ‘প্রগতিশীল’ করার অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তাআলার অমোঘ ঘোষণা, ‘আমি এ ‘উপদেশ’ অবতীর্ণ করেছি, আমিই তা রক্ষা করব’-এর সামনে সকল উদ্যোগ ভূমিস্যাত ও ধুলিস্যাত হয়ে গেছে। ইসলাম ঐ চির নতুন, চির সজীব দ্বীন, যা সকল যুগে মৃত মানবতাকে দান করেছে জীবনের সজীবতা। যতদিন পর্যন্ত জীবন-মৃত্যুর এ চক্র থাকবে ততদিন ইসলামও থকবে আবে হায়াতের উৎসরূপে এবং জীবন-পথে আলোর মিনাররূপে। এ দ্বীন মানবরচিত কোনো ধর্ম বা সংস্কার নয় যা কালের ধুলোয় মলিনতাপ্রাপ্ত হয়। এ তো যুগ ও জগতের স্রষ্টা আল্লাহ রাববুল আলামীনের প্রোজ্জ্বল জ্ঞান থেকে অবতীর্ণ। যে জ্ঞান স্থান-কালের ছায়াপাত থেকে, সকল ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে এবং সব ধরনের ভুল-ভ্রান্তি ও দুর্বলতা থেকে চিরপবিত্র। সুতরাং এ দ্বীনের কোনো সংস্কার প্রচেষ্টার প্রয়োজন নেই। মানবের কর্তব্য, নিজ জীবন ও কর্মকে এ আসমানী মানদন্ডের দ্বারা সংশোধন করা। ‘প্রগতিশীল’ ব্যাখ্যার দ্বারা এ দ্বীনকে ‘যুগোপযোগী’ করার প্রয়োজন নেই; বরং যুগ ও সমাজের করণীয় এ দ্বীনের শাশ্বত আলোয় নিজেদের আলোকিত করা। তাহলেই সব সময় ও সমাজ হবে মানব-বাস-উপযোগী।

হায়! দুর্বল মানুষের কত স্পর্ধা -যে প্রভুর প্রাকৃতিক বিধানে সে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দী সে কিনা সে প্রভুরই কর্তব্য-অকর্তব্যের বিধানকে পরিবর্তন করতে চায়!?

أَوَلَمْ يَرَ الْإِنْسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِنْ نُطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُبِينٌ

মানুষ কি দেখে না যে, আমি তাকে সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে? অথচ পরে সে হয়ে পড়ে প্রকাশ্য বিতন্ডাকারী। (সূরা ইয়াসীন ৩৬:৭৭)

যে বিধান এসেছে তার বিশ্বাস ও সংশোধনের জন্য সে বিধানকেই সে করতে চায় ‘সংস্কার’! যে বিধান এসেছে তাকে পশুত্ব থেকে মানবতায় উত্তীর্ণ করার জন্য সে বিধানকেই সে বানাতে চায় ‘প্রগতিশীল’! আত্মবিস্মৃত মানবের এ এক অসার অহং যা কখনো পূরণ হবার নয়।

মুসলিম জনসাধারণ তাদের জীবনে ইসলামের শিক্ষা কতটুকু প্রয়োগ করছেন তা আলাদা বিষয়, কিন্তু কেউ যদি

আন্তরিকভাবে ইসলামের সঠিক ও অবিকৃত রূপটি দেখতে চান তার জন্য অবশ্যই তা উপস্থিত রয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার অস্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদিতার জুজু কিংবা ‘প্রগতিশীল’ ব্যাখ্যার কপটতা কোনো কিছু দ্বারাই এ শাশ্বত আলোর গতিরোধ করা যাবে না।

يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللَّهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللَّهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ

ওরা আল্লাহর নূর ফুৎকারে নেভাতে চায়, কিন্তু আল্লাহ তাঁর নূর পূর্ণরূপে উদ্ভাসিত করবেন, যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে। (সূরা সাফ্ফ ৬১:৮)

Leave a Comment

Your email address will not be published.