ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম -২

সেকুলারিজম মুসলমানদের মধ্যে

মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে মুস্তফা কামাল পাশা আতাতুর্ক (জন্ম : ১৮৮১, মৃত্যু : ১৯৩৮)। ১৯ শতকের শুরুতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে একেবারে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে।

মুসলমানদের সর্বশেষ দারুল খিলাফা তুরস্কে বসে ঐ লোকটি এ কাজ করেছিল। তার ক্ষমতার মেয়াদকাল ছিল ১৯২৩-১৯৩৮ পর্যন্ত। তখনকার সময়ে সেকুলারিজমটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ঐ ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিকে পুঁজি করে কত কি সংঘটিত করেছে তা ভাবলেও গা শিউরে উঠে। সে বিষয়ে একটু পরে আরো কিছু কথা হবে ইনশাআল্লাহ।

আল্লামা ইবনে খালদুন সিয়াসাতকে তিন ভাগ করেছেন

১। সিয়াসাতে তাবয়ী (السياسة الطبعية) সেটা হল فوضي অর্থাৎ যার যার মন মতে চলবে কেউ কারো কর্তৃত্ব মানবে না।

২। (السياسة الملكية) অর্থাৎ এমন একটা ব্যবস্থাপনা থাকবে যে অনুযায়ী মানুষ জাগতিক বিষয়গুলো একটি কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে পরিচালনা করবে। বর্তমানের ধর্মনিরপেক্ষতা তেমনি একটি নীতি।

৩। আল-খিলাফাহ যেটা মানুষের পার্থিব-অপার্থিব ও ইহ-পরলৌকিক উভয় কল্যাণ নিশ্চিত করে। এরকম একটা নেযামের নাম খিলাফত।

আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষ লোকেরা দুই ধরনের।

১. ধর্মবিদ্বেষী ও ধর্মদ্রোহী লোকজন। অনেক কট্টর বামপন্থী এ শ্রেণীর আওতাভুক্ত।

২. আরেক শ্রেণী আছে যারা জায়গা বুঝে কথা বলে। আত্মরক্ষার জন্য যারা ভদ্র সাজে। ভদ্র বলতে যারা একটু রাখঢাক করতে চায়। এরা বলে ধর্মনিরপেক্ষতা মানেই ধর্মহীনতা নয়। এরা ধর্মনিরপেক্ষতাও রাখবে আবার ধর্ম ওয়ালাদের নারাজও করবে না। এদের উদাহরণ হল।

رحمن بهى راضى رہے اور شيطان بهى بے زار نہ ہو۔

আল্লাহও রাজি থাকুক, কিন্তু শয়তানও অসন্তুষ্ট না হোক।

এরা মানুষকে বলে বেড়ায় যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়; বরং এর উদ্দেশ্য হল, রাষ্ট্র কোনো বিশেষ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে না; ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার ইত্যাদি। এ লোকগুলো একদিক থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার আসল সংজ্ঞাকে গোপন করে, অন্যদিকে নিজেদের আসল মতলবকে গোপন রেখে ধর্মপ্রাণ ও ধর্মবিরোধী উভয় গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট রাখতে চায়।

আমরা আজকে বিশ্লেষণ করব যে, ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে ধর্মহীনতা নাকি ধর্মহীনতা নয়। কার কথাটা ঠিক? ধর্মনিরপেক্ষদের দেখলাম যে, তারা বিভিন্ন ধরনের কথা বলে। এটা তো এই দেশীয় বক্তব্য। অথচ সেক্যুলারিজম তো এদেশে শুরু হয়নি। এ দেশের আগেই এ নীতি প্রচার পেয়েছে। আমরা পড়া-শোনা কম করি তাই অন্যরা আমাদেরকে ধোঁকা দিতে সক্ষম হয়।

উপরোক্ত দু’টি পক্ষই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা রাখতে বদ্ধপরিকর। অথচ যে দুই যুগের বেশি সময় সংবিধানে এ জিনিসটি ছিল না তখন কি এদেশে শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় সহাবস্থান ছিল না। ঐ সময়ের মধ্যে তো আওয়ামী লীগও ৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। তারা কি দেশে ধর্মীয় সৌহার্দ্য বজায় রাখতে কোনো সমস্যায় পড়েছিল। দুটির উত্তরই ‘না’। তাহলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংবিধানে ফিরিয়ে আনার পিছনে নিশ্চয়ই আরো অনেক উদ্দেশ্য লুকায়িত, যা বুঝতে হলে আপনাকে দৃষ্টি দিতে হবে, মুসলমানদের খেলাফত পরবর্তী অবস্থার দিকে। চোখ ফেরাতে হবে একসময়ের তুরস্ক, ইরাক, মিসর ও সিরিয়ায়।

আমি আগেই বলেছি যে, আদালতে ৫ম সংশোধনী বাতিল হয়েছে বলা হলেও আসলে এর অনেক কিছুই বাতিল হয়নি। এমনকি অনেক মৌলিক বিষয়ও নয়, যেমন ৫ম সংশোধনী দ্বারা ৪র্থ সংশোধনীকে বাতিল করা হয়েছিল। তৎকালীন মুজিব সরকার ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে একটি রাজনৈতিক দল বানিয়েছিল। সেটা হল বাকশাল। আর সকল পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে সরকার নিজের মালিকানায় চারটি পত্রিকা চালু রেখেছে। রাজনৈতিক দল বা জনগণ ছাড়াও সরকারী কর্মকর্তাদেরও আবশ্যিকভাবে বাকশালে যোগ দেয়াকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। জিয়াউর রহমান ৫ম সংশোধনীতে ঐ সব বাতিল করে আবার বহুদলীয় গণতন্ত্র এনেছেন এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু সম্মানিত আদালত যখন ৫ম সংশোধনী বাতিল করেন তখন তিনি এ অংশটুকু বহাল রেখে দিয়েছেন।

যদি পুরো ৫ম সংশোধনী বাতিল করা হত তাহলে ৪র্থ সংশোধনী ফিরে আসত এবং দেশে পুনরায় একদলীয় বাকশালি শাসন চালু হত। মানুষ হরতাল, অবরোধ থেকে রেহাই পেত আর বর্তমান সরকারী দল অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পেয়ে দ্রুত দেশকে উন্নত করে ফেলতে পারত। নির্বাচন কমিশনকে বদনাম হতে হত না বিরোধী দলবিহীন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন করে। যাহোক, ঐ সংশোধনী বাতিলের অন্যতম উদ্দেশ্যই হয়তো ছিল ‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসে’র স্থলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বসানো।

প্রসঙ্গের টানে আরেকটি কথা বলি, ১৫ তম সংশোধনীর মাধ্যমে বাহাত্তর সালের সংবিধানে ফেরত যাওয়ায় রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিগুলোর মধ্যে ‘সমাজতন্ত্র’ও ফিরে এসেছে। কিন্তু সকলেই জানে যে, বাংলাদেশ এখন সম্পূর্ণ পুঁজিবাদী একটি রাষ্ট্র। বাহাত্তর সালে সংবিধানে যখন সমাজতন্ত্র ছিল তখন তো বিশ্বের বড় বড় দুটি রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্র চালু ছিল, এখন সেগুলো ধনতন্ত্রের স্বর্গরাজ্য। অথচ আমরা এখন ফিরিয়ে এনেছি ‘সমাজতন্ত্র’। কিন্তু চলছি পুঁজিবাদী নীতিতে। এটা নিয়ে কোন বিশ্লেষণ নেই, ঝগড়া-ঝাটিও নেই। সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর কয়েকজন তো এখন জোট সরকারেই আছে, মন্ত্রীও আছে। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের প্রধান এখন মন্ত্রী। মেনন সাহেবরাও মন্ত্রী। জাসদের সেক্রেটারী সংসদ সদস্য। মেনন সাহেব, বাদল সাহেব, ইনু সাহেবরা কি কখনো সংসদে এ কথা উঠিয়েছেন যে, সংবিধানে এখন তো সমাজতন্ত্র আছে। সুতরাং দেশের পুরো অথনীতি সমাজতন্ত্র অনুযায়ী হতে হবে। খোদ আওয়ামী মন্ত্রী বা নেতাদের মধ্যেও সম্পূর্ণ কমিউনিস্ট মানসিকতার যারা আছেন তারাও তো এমন কথা বলেননি। তেমনি বাইরের বড় বড় বুদ্ধিজীবি, গণমাধ্যম ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ যারা তারাও তো সরকারের কাছে এই দাবি তোলেননি। কেন? কেউ তো আদালতে রিটই করে দিতে পারত? সংবিধানের মৌলিক নীতি হল সমাজতন্ত্র তোমরা চলছ ক্যাপিটালিজমে, অর্থাৎ ধনতন্ত্র, পুঁজিবাদী নীতিতে।

এত মোক্ষম সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সমাজতন্ত্রীরা কেন এই দাবি উঠায় না। এর চেয়ে বড় মোক্ষম সুযোগ আর কোথায়? আসলে না আদালতের এ নিয়ে কোন মাথাব্যাথা আছে, না তাদের। তারা বরং ধর্মনিরপেক্ষতা পেয়েই আপাতত অন্য বিষয়ে ছাড় দিতে প্রস্ত্তত। আসল বিষয় হল সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের শুরুতে আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস বড়ই বেমানান। আর ধর্মনিরপেক্ষতাটা রাখা অনেক কিছুর জন্যই প্রয়োজনীয়। এ প্রয়োজনেই সংবিধানের সংশোধনী এসেছে।

‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ নীতিকে ছুঁড়ে ফেলে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ প্রতিস্থাপন। না হয় আদালত যখন বাছাই করে করেই বাতিল করলেন ও রাখলেন তখন তিনি এ অংশটুকুও তো রেখে দিতে পারতেন।

1 Comment

  1. Pingback: ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম-৪ | ইসলাম বার্তা

Leave a Comment

Your email address will not be published.