ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম-৫

পূর্বের অংশ সমূহ=
ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম-১
ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম-২
ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম-৩
ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম-৪

শরীয়তে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই

ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে কিছু নেই। ইসলামের মূল ভিত্তি হল আল্লাহর কালাম কুরআন মজীদ। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

وان احكم بينهم بما انزل الله

আর তাদের মাঝে আপনি ফয়সালা করুন ঐ আইন দ্বারা, যা আপনার প্রতি আল্লাহ তাআলা নাযিল করেছেন।-সূরা মায়েদা : ৪৯

অন্যত্র আছে-

ومن لم يحكم بما انزل الله فاولئك هم الظالمون، … فاولئك هم الكافرون،… فاولئك هم الفاسقون

যারা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী ফয়সালা করে না তারা জালিম … তারা কাফির … তারা ফাসিক।-সূরা মায়েদা : ৪৪, ৪৫ ও ৪৭। এ তিনটি আয়াতে সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর বিধান ভিন্ন ফয়সালাকারীকে জালিম, কাফির ও মুনাফিক বলা হয়েছে। এ আয়াতগুলো পড়ুন এবং কারাফীর কথার গলদ ব্যাখ্যাকারী সেক্যুলার মুহাক্কিকদের (!) বক্তব্য শুনুন, জবাব আপনিই দিতে পারবেন।

সেক্যুলারিজমের বক্তব্য হচ্ছে, আইন-আদালত, বিচারকার্য এসব চলবে রাষ্ট্রীয় নীতি ও জনগণের চাহিদা অনুযায়ী। রাষ্ট্র যেভাবে আইন করে সেভাবে চলবে। ধর্মের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। ঐ কোনো কোনো সেক্যুলারপন্থী তথাকথিত আলেমের বক্তব্য হল, খলীফারা যে আইনে আদালত ও রাষ্ট্র চালিয়েছেন তা তাদের নিজস্ব বিষয়। এটি ইসলামের কিছু নয়। আপনি উপরোক্ত আয়াত এবং এ সংক্রান্ত আরো যত আয়াত আছে সেগুলো দেখুন। এগুলোতে কি বলা হয়েছে, ঐ সকল হুকুম-আহকাম খলীফাদের পর্যন্ত সীমিত? পরবর্তীদের জন্য তা পালনীয় নয়? দেখুন, সেক্যুলারিজম এমন কোনো বিষয় নয় যে, তার অসারতা সম্পর্কে জবাব দিতে হলে মাটি খুড়ে বের করে দলিল দিতে হবে। বরং শরীয়তের বিষয়গুলো হল

ليلها كنهارها

অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, স্পষ্ট ও প্রকাশ্য। এখানে অস্পষ্টতা বা অন্ধকারের স্থান নেই। ইবাদত-বন্দেগী থেকে শুরু করে আইন-আদালত, রাষ্ট্রনীতি সব কিছুই কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা সুপ্রমাণিত। কিন্তু এখন ভাবটা এমন যে, নামায, রোযা ইত্যাদি মানুষকে তাদের ধর্ম মতো করতে দাও। (আসলে এটিও কথার কথা, না হয় আপনি কি নামায ঠিকমতো আদায় করতে পারছেন, জুমআর খুতবায় খতীব সাহেবেরা কি কুরআন-হাদীসের কথা স্বাধীনভাবে বলতে পারছেন, দুআ-মুনাজাতও কি তারা তাদের মতো করে করতে পারছেন? উত্তর আপনাদের জানা আছে।) আর রাষ্ট্র ও আদালত পরিচালিত হবে মানবরচিত আইনে। সুতরাং কুরআনের বিধানের সাথে সামঞ্জস্য থাকুক বা না থাকুক তিনি মীরাছের হিস্যা তার মতো করে বণ্টন করে দিতে পারবেন। এর জন্য মুসলিম স্কলারের ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। বিচারক নিজেই লিবারেল ও স্বাধীন। ফতওয়া সম্পর্কে ধারণা থাকুক বা না থাকুক, এমনকি ফতোয়ার সঠিক সংজ্ঞাও যদি জানা না থাকে তিনি ফতোয়া অবৈধ বলে দিতে পারবেন এবং বলতে পারবেন যে, ফতওয়া দিতে পারবে শুধু উচ্চ আদালতের বিচারক। ফতওয়া দেওয়ার আইনগত কর্তৃপক্ষ হল কোর্ট।

সেক্যুলারিজমটা এমনই। অন্য ধর্মের ব্যাপারে এর তেমন মাথাব্যাথা নেই। তাদের বিরোধিতারও দরকার নেই। কারণ অন্য ধর্মওয়ালারা এ নিয়ে কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি করে না। ইন্ডিয়ার উগ্রপন্থী বিজেপি কি কখনো দাবি উঠিয়েছে যে, গীতা, মহাভারত অনুযায়ী রাষ্ট্র চালাতে হবে? খ্রীষ্টানরাও একথা বলেনি। কারণ তাদের নিকট ইসলামের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতিগুলোই নেই। এই অতুলনীয় ও সুমহান নীতি কেবল ইসলামেরই রয়েছে। সেক্যুলারিজম এসেছেই ইসলামকে প্রতিহত করার জন্য, স্রষ্টার আইনের বদলে নিজেদের মনমতো করে মানুষকে শাসন করার জন্য।

কিছু মোটা কথা

আপনি পুরো কুরআন মজীদ, বিশেষ করে মাদানী সূরাগুলো মনোযোগ দিয়ে অর্থসহ পড়ুন এবং লক্ষ্য করুন তাতে নামায, রোযা, হজ্ব ইত্যাদির বাইরে অন্যান্য বিষয়ের আরো কত আয়াত রয়েছে। হাদীসগ্রন্থগুলোতে ইবাদাত অধ্যায়গুলোর তুলনায় পরিবারনীতি, সমাজনীতি, বিচারনীতি, লেনদেন পদ্ধতি, কৃষি-সেচ ইত্যাদি অধ্যায়গুলোর হাদীস সংখ্যার তুলনামূলক হিসাব করুন তাহলে দেখবেন দ্বিতীয় অংশের হাদীসের সংখ্যা কত বেশি। সেক্যুলারিজম মানতে হলে আপনাকে ঐসব কিছুই এখন রহিত হয়ে গেছে-ঘোষণা করতে হবে। (নাউযুবিল্লাহ)

যে ব্যক্তি ইসলামী নীতিমালা ও আদর্শে বিশ্বাসী তাকে যদি কোনো সেক্যুলার রাষ্ট্রের বিচারক বা কাযী নিযুক্ত করা হয় তার ধর্ম কি তাকে শরীয়তের বাইরে গিয়ে কোনো বিচার করার সুযোগ দিবে? তখন তো তিনি অসংখ্য আয়াত ও হাদীসের জেরার মুখে পড়বেন। তিনি কি বলতে পারবেন যে, এই আয়াত ঐ সন পর্যন্ত, ঐ প্রজন্মের জন্য ছিল? এ রকম করলে সবই ছেড়ে দিতে হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়কের একটি অপরিহার্য দায়িত্ব হল হুদূদ-কিসাস কার্যকর করা। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সেক্যুলার হওয়ার কারণে তাকে কিতাবুল হুদূদের হাদীসগুলোতে, সূরা নূরের আয়াতসমূহে টীকা লাগিয়ে দিতে হবে যে, এগুলো প্রথম যুগের সাথে সম্পৃক্ত। পরবর্তীদের জন্য তা প্রযোজ্য নয়। তাই সেক্যুলারিজম নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ার কোনো সুযোগ নেই। দৃঢ়তার সাথে বুঝতে হবে যে, এটা সম্পূর্ণ লা দ্বীনী ও Anti Islam নীতি।

বিখ্যাত মুহাদ্দিস আবু যুরআ রাহ.কে খলীফা ওলিদ ইবনে আবদুল মালিক জিজ্ঞাসা করেছিল যে, أيحاسب الخليفة খলীফারা যে রাষ্ট্র পরিচালনা করে তাদের কি হিসাব দিতে হবে? পাকড়াও হবে?

আবু যুরআ রাহ. বলেছিলেন, অবশ্যই হিসাব নেওয়া হবে এবং দলিল হিসেবে তিনি কুরআন মজীদের এই আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন-

يَا دَاوُودُ إِنَّا جَعَلْنَاكَ خَلِيفَةً فِي الْأَرْضِ فَاحْكُمْ بَيْنَ النَّاسِ بِالْحَقِّ وَلَا تَتَّبِعِ الْهَوَى فَيُضِلَّكَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ إِنَّ الَّذِينَ يَضِلُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ بِمَا نَسُوا يَوْمَ الْحِسَابِ

অর্থ : হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, অতএব তুমি লোকদের মধ্যে সুবিচার কর এবং খেয়ালখুশির অনুসরণ করো না। কেননা এটি তোমাকে আল্লাহর পথ হতে বিচ্যুত করবে। যারা আল্লাহর পথ হতে ভ্রষ্ট হয় তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। কারণ তারা বিচারদিবসকে বিস্মৃত হয়ে আছে।-সূরা ছোয়াদ : ২৬

ইবনে কাসীর রাহ. এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ঠিক একই কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন-

هذه وصية من الله عز وجل لولاة الأمور أن يحكموا بين الناس بالعدل

অর্থ : এটা আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে শাসকদের প্রতি নির্দেশনা যে, তারা যেন লোকদের মধ্যে সুবিচার করে।

বিচার একমাত্র আল্লাহর আইনেই হওয়া বাধ্যতামূলক। ধর্মনিরপেক্ষতা বা নিরপেক্ষ ভাব-ভঙ্গি বলতে কিছু নেই।

শেষকথা

দুতিন ঘণ্টার আলোচনায় ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষতিকর সকল দিক বলা সম্ভব নয়। আর ইলসামের রাষ্ট্রনীতি, বিচারনীতি ও ইবাদাতের বাইরের অন্যান্য বিষয়াবলির বিশালতা সম্পর্কে তো আপনারা অবগত আছেন।

আমি শুধু সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছি এবং সেক্যুলার ব্যক্তিবর্গের কথা ও লেখা থেকে প্রমাণ করেছি যে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতা সমার্থবোধক। এবং এর সবচেয়ে হালকা ব্যাখ্যাদাতারও দাবি হল, রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। যা সুস্পষ্ট কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী বক্তব্য। এবং প্রায় ৯০% মুসলমানের বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়ন গণতন্ত্র, মানবাধিকার পরিপন্থী কাজ। আর দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ও মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে স্থান দেওয়া এবং এটিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্য হিসেবে উল্লেখ করা বাস্তবতা বিবর্জিত হঠকারিতা ও সীমিত সংখ্যক লোকের মতকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার নামান্তর। যারা এমনটি করছে তারা কিন্তু প্রকারান্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সংকীর্ণ করছে।

আল্লাহ তাআলা স্বীয় অনুগ্রহে আমাদেরকে সঠিক ইসলামের উপর পরিচালিত করুন। সকল ভ্রান্ত ধারণা ও বিশ্বাস থেকে দূরে রাখুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published.