নবীজীর নামে কটূক্তি ও মুরতাদের শাস্তি কুরআন ও হাদীসের আলোকে একটি সরল উপস্থাপনা

আল্লাহ তাআলা মানুষের সৃষ্টিকর্তা। ইসলাম তাঁর মনোনীত একমাত্র দ্বীন। মানুষের জন্য তিনি এই দ্বীন নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ-ছাড়া অন্য কোনো দ্বীন বা ধর্ম মানুষের কাছ থেকে তিনি গ্রহণ করবেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন,

 

وَمَنْيَبْتَغِغَيْرَالْإِسْلَامِدِينًافَلَنْيُقْبَلَمِنْهُوَهُوَفِيالْآَخِرَةِمِنَالْخَاسِرِينَ

 

যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দ্বীনের অনুসরণ করবে, তার পক্ষ থেকে তা কখনোই গ্রহণ করা হবে না। আর পরকালে সে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। (আলে ইমরান ৩ : ৮৫)

 

যারা ইসলাম ব্যতীত অন্য কিছুর অনুসারী, তাদেরকে ইসলামের প্রতি আহবান করা হবে, কিন্তু ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন-

 

لَاإِكْرَاهَفِيالدِّينِقَدْتَبَيَّنَالرُّشْدُمِنَالْغَيِّ

 

দ্বীন (গ্রহণ)-এর বিষয়ে কোনো জবরদস্তি নেই। হেদায়েতের পথ গোমরাহী থেকে পৃথকরূপে স্পষ্ট হয়ে গেছে। (বাকারা ২ : ২৫৬)

 

আর যারা আল্লাহর আহবানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছে, তারা পরিপূর্ণরূপে ইসলাম অনুসরণে বাধ্য। তারা তো ইসলাম গ্রহণ করেছেই আল্লাহর ইবাদতের জন্য, তাঁর বিধান মানার জন্য। ইরশাদ হয়েছে-

 

يَاأَيُّهَاالَّذِينَآَمَنُواادْخُلُوافِيالسِّلْمِكَافَّةًوَلَاتَتَّبِعُواخُطُوَاتِالشَّيْطَانِإِنَّهُلَكُمْعَدُوٌّمُبِينٌ

 

তোমরা যারা ঈমান এনেছ, তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (বাকারা ২ : ২০৮)

 

অন্য আয়াতে এসেছে-

 

وَإِذْنَتَقْنَاالْجَبَلَفَوْقَهُمْكَأَنَّهُظُلَّةٌوَظَنُّواأَنَّهُوَاقِعٌبِهِمْخُذُوامَاآَتَيْنَاكُمْبِقُوَّةٍوَاذْكُرُوامَافِيهِلَعَلَّكُمْتَتَّقُونَ

 

এবং স্মরণ কর, যখন আমি পাহাড়কে তাদের উপর এভাবে তুলে ধরলাম, যেন একটি শামিয়ানা, আর তারা ভেবে নিয়েছিল, এটি তাদের উপর পতিত হবে, (তখন আমি হুকুম দিয়েছিলাম) আমি তোমাদেরকে যে কিতাব দিয়েছি, তা মজবুতভাবে আকড়ে ধর এবং তাতে বর্ণিত বিষয়সমুহ স্মরণ রাখ। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার। (আরাফ ৭ : ১৭১)

 

মুসলমান ইসলামের অনুশাসন মানতে বাধ্য বলেই গুনাহ করলে দুনিয়া ও আখেরাতে বিভিন্ন শাস্তি তার উপর আপতিত হয়। দুনিয়াতে কোনো গুনাহের শাস্তি বন্দিত্ব, কোনোটার শাস্তি বেত্রাঘাত, হস্তকর্তন ও মৃত্যুদন্ড ইত্যাদি। সবচে বড় গুনাহ হল মুসলিম থেকে অমুসলিম হয়ে যাওয়া। একেই বলে মুরতাদ হওয়া। মুরতাদ শব্দের শাব্দিক অর্থ বিমুখ হয়েছে বা ফিরে গিয়েছে এমন। এর মূল মর্ম  হল, ইসলাম ত্যাগ করা, ইসলামের কোনো মৌলিক আকিদা বা বিধানকে মানতে অস্বীকার করা, কিংবা তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা অথবা ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ের অবমাননা করা, যা অন্তরের ভক্তিশূন্যতা ও শ্রদ্ধাহীনতার আলামত বহন করে। এককথায় ঈমান বিনষ্টকারী যে কোনো কুফরী-শিরকী আকিদা বা বিশ্বাস পোষণ করা, অথবা এ জাতীয় কোনো কথা বা কাজে লিপ্ত হওয়ার নামই হল ইরতিদাদ বা মুরতাদ হওয়া।

 

যে সকল কারণে ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যায় এর বিভিন্ন কারণের মধ্য হতে নিম্নে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো।

 

১. আল্লাহ তাআলার শানে বেয়াদবি করা।

 

২. ইসলামের শিআর তথা প্রতীকসমূহের অবমাননা করা। এগুলো নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা বা কৌতুক করা।

 

ইসলামের মৌলিক শিআর হল; কুরআন মাজীদ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ; বিভিন্ন ইবাদত যথা-নামায, রোযা, হজ্ব-যাকাত, দোয়া-দরূদ; বিভিন্ন ফযীলতপূর্ণ স্থান যথা-মসজিদে নববী, কাবা শরীফ, মসজিদে আকসা এবং পৃথিবীর সকল মসজিদ ইত্যাদি। এগুলোর অবমাননা যেমন, মসজিদকে গোয়ালঘর বলা, কোরআন মাজীদকে আবর্জনায় ছুঁড়ে ফেলা, নবীজীকে যুদ্ধবাজ বলা, তাঁর নামের অবমাননা করা ইত্যাদি।

 

৩. ইসলামের কোনো বিধান, ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কিত সাধারণ কোনো বিষয়, নবীজীর কোনো সুন্নত, এমনকি প্রমাণিত কোনো মুস্তাহাব আমল ইত্যাদির প্রতি অবজ্ঞাসূচক বাক্য ব্যবহার করা অথবা অবজ্ঞা-প্রকাশক কোনো আচরণ করা। যেমন কুকুরের মাথায় টুপি পরানো, বোরকাকে বেশ্যার পোশাক বলা ইত্যাদি।

 

৪. জরুরিয়াতে দ্বীন তথা সর্বজনবিদিত অকাট্য দ্বীনী বিষয়সমূহের কোনো একটি অস্বীকার করা, অপছন্দ করা, বা তার অপব্যাখ্যা করা, অথবা তার উপর আপত্তি তোলা কিংবা তা সংস্কারযোগ্য বলে মনে করা। যেমন খতমে নবুওত অস্বীকার করা, চুরির শাস্তির উপর আপত্তি করা ইত্যাদি।

 

৫. ইসলাম ত্যাগ করে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করা কিংবা কোনো ধর্মই না মানা। যেমন আল্লাহকে বিশ্বাস না করা, প্রকৃতিবাদী হওয়া, খৃস্টান বা তাদের ভাষায় ঈসায়ী মুসলমান হওয়া ইত্যাদি।

 

৬. এমন কোনো কাজ করা বা বিশ্বাস পোষণ করা, যা আল্লাহ তাআলার তাওহীদ পরিপন্থী। যেমন কোনো প্রতিকৃতির সামনে মাথা নত করা, মাজার তওয়াফ করা, উপায়-উপকরণের উর্ধ্বের বিষয়ে আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কাউকে শরিক করা, আল্লাহ ছাড়া কাউকে রিযিকদাতা, ফসলদাতা, সন্তানদাতা ইত্যাদি মনে করা।

 

৭. অন্যদের ধর্মীয় প্রতীক গ্রহণ করা, কথা বা কাজে এর প্রতি ভক্তিশ্রদ্ধা প্রকাশ করা।

 

৮. ইসলামী শরীয়ত তথা আল্লাহ রববুল আলামীনের হাকিমিয়্যত (শাসকত্ব)-কে অস্বীকার করা। অর্থাৎ জীবনের সর্বস্তরে আল্লাহ তাআলা হালাল-হারাম, সিদ্ধ-অসিদ্ধ নির্ধারণকারী এবং তিনিই যে একমাত্র বিধানদাতা তা বিশ্বাস না করা ইত্যাদি।

 

ইরতিদাদের সকল প্রকার সাধারণ কুফরের চে ভয়াবহ। সাধারণ কুফর হল সত্যদ্বীন গ্রহণ না করা বা প্রকৃত দ্বীন থেকে বিমুখ থাকা। কিন্তু ইরতিদাদ নিছক বিমুখতা নয়, এ হল বিদ্রোহ, বিরুদ্ধতা! সত্য দ্বীন গ্রহণ করার পর তা বর্জনের অর্থ ঐ দ্বীনকে অভিযুক্ত করা, যা নির্জলা অপবাদ। পাশাপাশি তা ইফসাদ ফিল আরদ তথা পৃথিবীতে ফেতনা সৃষ্টিও বটে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

 

كَيْفَيَهْدِياللَّهُقَوْمًاكَفَرُوابَعْدَإِيمَانِهِمْوَشَهِدُواأَنَّالرَّسُولَحَقٌّوَجَاءَهُمُالْبَيِّنَاتُوَاللَّهُلَايَهْدِيالْقَوْمَالظَّالِمِينَأُولَئِكَجَزَاؤُهُمْأَنَّعَلَيْهِمْلَعْنَةَاللَّهِوَالْمَلَائِكَةِوَالنَّاسِأَجْمَعِينَخَالِدِينَفِيهَالَايُخَفَّفُعَنْهُمُالْعَذَابُوَلَاهُمْيُنْظَرُونَإِلَّاالَّذِينَتَابُوامِنْبَعْدِذَلِكَوَأَصْلَحُوافَإِنَّاللَّهَغَفُورٌرَحِيمٌإِنَّالَّذِينَكَفَرُوابَعْدَإِيمَانِهِمْثُمَّازْدَادُواكُفْرًالَنْتُقْبَلَتَوْبَتُهُمْوَأُولَئِكَهُمُالضَّالُّونَ

 

আল্লাহ এমন একটা কওমকে কীভাবে হেদায়েতের পথে পরিচালিত করতে পারেন; যে সমাজ একবার ঈমান আনার পর, রাসূলকে সত্য বলে মেনে নেওয়ার পর এবং তাদের কাছে সুস্পষ্ট দলিল-প্রমাণ এসে যাওয়ার পর আবার কাফের হয়ে যায়? অবস্থা এই যে, আল্লাহ এমন জালিম সমাজকে কখনো হেদায়েতের পথ দেখান না। এই যে লোকগুলো, এদের কর্মফল হলো, এদের উপর আল্লাহ, ফেরেশতাকুল এবং সমগ্র মানবজাতির অভিশাপ! তবে এর পরে যারা তওবা করবে আর (নিজেদেরকে) সংশোধন করে নেবে, তাদের কথা অবশ্য আলাদা। পরন্তু আল্লাহ হচ্ছেন মহাক্ষমাশীল করুণাময়। (কিন্তু) যারা একবার ঈমান আনার পর আবার কাফের হয়ে যায় এবং তাদের কুফরী আচরণ আরও বেড়ে চলে, তাদের তওবা কখনো কবুল হবে না। (আলে ইমরান ৩ : ৮৬-৯০)

 

অন্য আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন-

 

وَمَنْيَرْتَدِدْمِنْكُمْعَنْدِينِهِفَيَمُتْوَهُوَكَافِرٌفَأُولَئِكَحَبِطَتْأَعْمَالُهُمْفِيالدُّنْيَاوَالْآَخِرَةِوَأُولَئِكَأَصْحَابُالنَّارِهُمْفِيهَاخَالِدُونَ

 

আর তোমাদের মধ্যে কেউ যদি নিজের ধর্ম থেকে ফিরে যায়। আর সে অবিশ্বাসী অবস্থায় মারা যায়, তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের সকল নেক আমল বরবাদ হয়ে যাবে। এই লোকেরাই হল জাহান্নামের অধিবাসী, তারা চিরকাল সেখানে থাকবে। (বাকারা ২ : ২১৭)

 

আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

 

(তরজমা) প্রকৃতপক্ষে যারা তাদের সামনে হেদায়েত পরিস্ফুট হওয়ার পরও মুরতাদ হয়ে যায়, (আসলে) শয়তান তাদেরকে ফুসলিয়েছে এবং অমূলক আশা দিয়েছে। এসব এজন্য যে, যারা আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয়কে অপছন্দ করে, তাদেরকে (সেই কাফেরদেরকে) তারা (মুরতাদ-মুনাফিকেরা) বলে, কিছু কিছু বিষয়ে আমরা তোমাদের কথাও মানবো। (স্মরণ রাখা উচিত) আল্লাহ তাদের গুপ্ত কথা সম্পর্কে অবগত। ফেরেশতারা যখন এদের চেহারায় এবং পিছন দিক থেকে আঘাত করতে করতে এদের জান কবজ করবে, তখন এদের কী দশা হবে! এসব (শাস্তি) এজন্য যে, তারা এমন মতবাদ বেছে নিয়েছে, যা আল্লাহ তাআলাকে নারাজ করে এবং তারা তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন পছন্দ করে না। তাই আল্লাহ তাদের আমলগুলো বরবাদ করেছেন। (মুহাম্মাদ (৪৭) : ২৫-২৮)

 

মুরতাদের পরকালীন এ শাস্তিগুলির ফয়সালা হবে হাশরের ময়দানে। যেখানে ফয়সালাকারী হবেন খোদ আল্লাহ রাববুল আলামীন। দৃশ্য-অদৃশ্য সকল বিষয় সম্পর্কে যিনি অবগত। যিনি আহকামুল হাকিমীন। মানুষের অন্তরের একান্ত গোপন কথাও যার অজানা নয়। তাই দুনিয়াতে যে নিজের ইরতিদাদ ও কুফর লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে, কেয়ামতের দিন সেও অপরাধী সাব্যস্ত হবে। তাকেও কঠিন আযাব ভোগ করতে হবে।

 

কিন্তু এই দুনিয়ার আদালতে মনের অবস্থার উপর বিচার করা যায় না। এখানে কারো মনের খবর নিশ্চিতভাবে জানাও সম্ভব হয় না। তাই দুনিয়াতে বিচার হয় বাহ্যিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে। কোনো মুনাফিক নিজের অন্তরে কুফরি আকিদা-বিশ্বাস লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হলে বিচারকের সামনে তার ইরতিদাদ প্রমাণিত হবে না। সুতরাং দুনিয়াবী কোনো শাস্তিও তার উপর আপতিত হবে না। দুনিয়াবী শাস্তি প্রয়োগ হবে কেবল ঐ ব্যক্তির উপর-যার ইরতিদাদ স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়ে গেছে এবং হাকিমের কাছে তা প্রমাণিত হয়েছে।

 

মুরতাদ দুই প্রকারের হয়ে থাকে : এক. যে নিজের ইরতিদাদের ঘোষণা দিয়েছে। দুই. যে ইরতিদাদ-মূলক কোনো আকিদা-বিশ্বাস পোষণ করে অথবা অনুরূপ কাজ-কর্মের সঙ্গে জড়িত থেকেও নিজেকে কথা বা কাজে মুসলমান বলে দাবী করছে। দ্বিতীয় প্রকারের মুরতাদকে যিন্দীক, মুলহিদ ও মুনাফিক ইত্যাদি বলা হয়।

 

স্বঘোষিত মুরতাদ হোক আর মুনাফিকজাতীয় মুরতাদ হোক, উভয় প্রকার মুরতাদের ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম হল, যদি আদালতে এদের ইরতিদাদ প্রমাণ হয়ে যায়, তাহলে তার বিষয়ে শরীয়ত মোতাবেক ফয়সলা করা বিচারকের উপর ফরজ। আর প্রশাসনের ফরজ হল ঐ শাস্তি অপরাধীর উপর প্রয়োগ করা।

 

আল্লাহ পাকের আইনে মুরতাদের দুনিয়াবী শাস্তি কী- সেটা ইসলামী শরীয়তের অকাট্য সর্বজনস্বীকৃত ও যুগ পরম্পরায় অনুসৃত শিক্ষাগুলির একটি। এর উপর উম্মতের সকল মাযহাব, সকল গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠীর ইজমা রয়েছে। এতে কোনো কালেই কোনো আলেমে দ্বীনের দ্বিমত বা দ্বিধা ছিল না। এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে থাকলে মুলহিদ-যিন্দীকরাই করেছে। কোনো মুমিন করেনি। একজন মুমিন তো শরীয়তের সকল বিধানের উপর ঈমান রাখে। হদ-কিসাস ও দন্ডবিধি শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এগুলিকে হুবহু মেনে নেওয়াই ঈমান। এগুলির একটি হল, মুরতাদের দুনিয়াবী শাস্তি মৃত্যুদন্ড।

 

বিচারকের জন্য নিয়ম হল, মুরতাদকে প্রথমে তওবা করার সুযোগ দিবে। তওবা করলে তো ভালো। অন্যথায় নির্ধারিত শাস্তি প্রয়োগ করবে।

 

মুরতাদের তওবা কবুল করা এবং এ উসিলায় তার শাস্তি মওকুফ করা শরীয়তে মুহাম্মদীর বিধান। নতুবা তাওরাতের শরীয়তে তওবা করলেও এ শাস্তি মাফ হত না। বরং তওবার মাধ্যমে পরকালীন শাস্তি থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য দুনিয়াবী শাস্তি গ্রহণ করা অপরিহার্য ছিল।

 

বনী ইসরাইলের একটি দল যখন গোবৎসের পুজা করে শিরকে লিপ্ত হল, যে কারণে তারা মুরতাদ হয়ে গেল, তখন তাদের ব্যাপারে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হল এবং এটা তাদের তওবারই একটা অংশ ছিলো। ইরশাদ হয়েছে-

 

(তরজমা) যারা বাছুরকে উপাস্য বানিয়েছে, শীঘ্রই তাদের রবের গজব তাদেরকে পাকড়াও করবে আর দুনিয়ার জীবনেই লাঞ্ছনা আপতিত হবে। যারা মিথ্যা রচনা করে, আমি এভাবেই তাদেরকে শাস্তি দিয়ে থাকি। (আরাফ ৭ : ১৫২)

 

মুরতাদের উপর আপতিত সেই গজব ও লাঞ্ছনা কী ছিল? কোরআনেই ইরশাদ হয়েছে-

 

إِنَّكُمْظَلَمْتُمْأَنْفُسَكُمْبِاتِّخَاذِكُمُالْعِجْلَفَتُوبُواإِلَىبَارِئِكُمْفَاقْتُلُواأَنْفُسَكُمْذَلِكُمْخَيْرٌلَكُمْعِنْدَبَارِئِكُمْفَتَابَعَلَيْكُمْإِنَّهُهُوَالتَّوَّابُالرَّحِيمُ

 

তোমরা বাছুরকে (উপাস্য হিসাবে) গ্রহণ করে প্রকৃতপক্ষে নিজেরাই নিজেদের উপর জুলুম করেছ। সুতরাং তোমরা তোমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট তওবা কর এবং নিজেরা নিজেদের মাঝে মৃত্যুদন্ড কার্যকর কর। তোমাদের সৃষ্টিকর্তার নিকট এ ব্যবস্থা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। তাহলে তিনি তোমাদের তওবা কবুল করবেন। তিনি তো তওবা কবুলকারী, পরম করুণাময়। (বাকারা ২ : ৫৪)

 

দুনিয়াতে এই ক্রোধ ও গজব এবং লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা যারা শিরক করে মুরতাদ হয়ে গেছে শুধু তাদের জন্যই নয়, বরং সব ধরনের মুরতাদের জন্য। ইরশাদ হয়েছে-

 

(তরজমা) যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার পর তার কুফরীতে লিপ্ত হয় -অবশ্য সে নয়, যাকে কুফুরীর জন্য বাধ্য করা হয়েছে, কিন্তু তার অন্তর ঈমানের উপর প্রশান্ত রয়েছে, বরং সেই ব্যক্তি, যে সহৃদয়ে কুফুরী মেনে নিয়েছে, এরূপ ব্যক্তির উপর আল্লাহর গজব এবং তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। (নাহল ১৬ : ১০৬)

 

সূরা বাকারার ৫৪ নম্বর আয়াত থেকে বোঝা যায়, মুরতাদের উপর আপতিত খোদায়ী গজব হল মৃত্যুদন্ড। ইসলামের প্রতি দুশমনি করা অথবা যে কোনো ধরনের শিরকী-কুফরী কর্ম ও বিশ্বাসের মাধ্যমে মুরতাদ হয়ে যাওয়া ব্যক্তি -যদিও সে আচরণে-উচ্চারণে নিজেকে মুসলমান প্রমাণের চেষ্টা করে -তবু সে মুরতাদ। কোরআনের পরিভাষায় এমন ব্যক্তিকে মুনাফিক বলা হয়। এদের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ পাক বলেন-

 

لَئِنْلَمْيَنْتَهِالْمُنَافِقُونَوَالَّذِينَفِيقُلُوبِهِمْمَرَضٌوَالْمُرْجِفُونَفِيالْمَدِينَةِلَنُغْرِيَنَّكَبِهِمْثُمَّلَايُجَاوِرُونَكَفِيهَاإِلَّاقَلِيلًامَلْعُونِينَأَيْنَمَاثُقِفُواأُخِذُواوَقُتِّلُواتَقْتِيلًاسُنَّةَاللَّهِفِيالَّذِينَخَلَوْامِنْقَبْلُوَلَنْتَجِدَلِسُنَّةِاللَّهِتَبْدِيلًا

 

মুনাফিকরা, যাদের অন্তরে ব্যাধি রয়েছে তারা এবং মদীনাতে ভয়ংকর সংবাদ রটনাকারীরা যদি নিবৃত্ত না হয়, তাহলে অবশ্যই আমি আপনাকে তাদের বিরুদ্ধে প্রবল করে দিব। আর তখন তারা আপনার প্রতিবেশী হিসাবে সেখানে বেশি দিন টিকতে পারবে না। তাও থাকবে অভিশপ্ত অবস্থায়, যেখানেই এমন লোককে পাওয়া যাবে, ধরে ধরে একে একে হত্যা করে ফেলা হবে। আল্লাহ তাআলার এ নিয়ম পূর্ববর্তী লোকদের জন্যও বলবৎ ছিল। আল্লাহর নিয়মে কোনো দিন আপনি কোনো ব্যত্যয় খুজে পাবেন না। (আহযাব ৩৩ : ৬০-৬২)

 

উল্লেখিত আয়াতে মুরতাদ-মুনাফিকের দুটি অপতৎপরতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং তা থেকে বিরত না হলে শাস্তি লাঞ্ছনা এবং মৃত্যুদন্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

আয়াতের শেষ অংশ থেকে এ-কথাও স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, পূর্ববর্তী নবীগণের শরীয়তেও মুরতাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। (মাআরিফুল কুরআন, মুফতী শফী ৭ : ২৩৪-২৩৫)

 

বিদ্রোহের শাস্তি কেবল মৃত্যুদন্ড

 

এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, মুরতাদ (প্রকাশ্য মুরতাদ অথবা মুনাফেক মুরতাদ দুজনই) আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী মুহারিব। ইসলাম ও মুসলমানকে অপমানকারী বিশ্বাসঘাতক। আল্লাহর জমিনে শান্তি বিনষ্টকারী প্রতারক। সকল মুহারিব ও ফেৎনাবাজ দুষ্কৃতিকারীর শাস্তি প্রসঙ্গে কোরআন মাজীদের ইরশাদ হয়েছে-

 

إِنَّمَاجَزَاءُالَّذِينَيُحَارِبُونَاللَّهَوَرَسُولَهُوَيَسْعَوْنَفِيالْأَرْضِفَسَادًاأَنْيُقَتَّلُواأَوْيُصَلَّبُواأَوْتُقَطَّعَأَيْدِيهِمْوَأَرْجُلُهُمْمِنْخِلَافٍأَوْيُنْفَوْامِنَالْأَرْضِذَلِكَلَهُمْخِزْيٌفِيالدُّنْيَاوَلَهُمْفِيالْآَخِرَةِعَذَابٌعَظِيمٌ

 

যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে দুশমনিতে লিপ্ত হয় এবং পৃথিবীতে অশান্তি ও বিপর্যয় সৃষ্টির পাঁয়তারা করে, তাদের শাস্তি কেবল মৃত্যুদন্ড, শূলিবিদ্ধ করে হত্যা কিংবা হাত পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা অথবা নির্বাসিত করা (কারাগারে নিক্ষেপ করা)। এ তো হল তাদের পার্থিব অপমান। আর পরকালেও তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মর্মন্তুদ শাস্তি। (মায়েদা ৬ : ৩৩)

 

আয়াতে বিভিন্ন প্রকার ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টিকারী মুহারিবের এবং তাদের অপরাধের ধরন ও মাত্রাভেদে বিভিন্ন শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আর মুহারিব ও মুফসিদ (বিপর্যয় সৃষ্টিকারী) এর মাঝে সবচে মারাত্মক হল যারা দ্রোহের ঘোষণা দিয়ে ইসলাম ত্যাগ করে, ইসলামের অবমাননা করে মুসলিম পরিচয় দিয়ে মুমিনদেরকে তাদের ঈমানের ব্যাপারে সন্দিহান করে-ফেলার মতো দুষ্কর্মে লিপ্ত হয়। উল্লিখিত আয়াতে أَنْيُقَتَّلُوا শব্দে সর্বপ্রথম এ ধরনের মুহারিব এবং নিরপরাধ মানুষকে হত্যাকারীর শাস্তি মৃত্যুদন্ড বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া উল্লিখিত আয়াত প্রসঙ্গে লিখেছেন, (অর্থ 🙂 আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দুভাবে হতে পারে। একটা অস্ত্রের মাধ্যমে আরেকটা যবানের মাধ্যমে। আর দ্বীনী বিষয়ে কখনো কখনো অস্ত্রের যুদ্ধের চে যবানের যুদ্ধ মারাত্মক হয়ে থাকে। এই জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অস্ত্রের যুদ্ধে লিপ্ত অনেককে বেঁচে থাকার সুযোগ দিতেন, কিন্তু আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে যবানি দুশমনিতে লিপ্ত কাউকে ক্ষমা করতেন না। তেমনি পৃথিবীর শান্তি শৃংখলা কখনো অস্ত্র বিস্তারের কারণে বিনষ্ট হয় আর কখনো হয় যবান দরাজির কারণে। আর দ্বীনি বিষয়ে যবান দরাজির মাধ্যমে যে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়, তা অস্ত্রের মাধ্যমে সৃষ্ট বিশৃংখলার চে বহু গুণে মারাত্মক।-আছ ছা-রিমুল মাছলূল পৃ. ৩৯১

 

হাদীসে নববীতে মুরতাদের শাস্তি-প্রসঙ্গ

 

হাদীস ইসলামী শরীয়তের স্বয়ংসম্পূর্ণ দলিল এবং কুরআনের তাফসীর। এখন আমরা সহীহ হাদীস ও আছারে সাহাবার আলোকে মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে শরীয়তের নির্দেশনা তুলে ধরবো। তা থেকে মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে শরীয়তের দ্বিতীয় দলিলের ফয়সালা সামনে এসে যাবে এবং সুন্নাহর মাধ্যমেও এ কথা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, উল্লিখিত আয়াতসমূহের বক্তব্য তা-ই যা উপরে বলা হয়েছে।

 

عنعكرمةقال : أتيعليرضياللهعنهبزنادقةفأحرقهم. فبلغذلكابنعباسفقال : لوكنتأنالمأحرقهم،لنهيرسولاللهصلىاللهعليهوسلم : لاتعذبوابعذابالله،ولقتلتهملقولرسولاللهصلىاللهعليهوسلم : منبدلدينهفاقتلوه.

 

১. ইকরিমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী রা. এর নিকট কয়েকজন মুরতাদ-যিন্দীককে ধরে আনা হল। তিনি তাদের পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিলেন। এ-খবর ইবনে আববাস রা এর নিকট পৌছলে তিনি বললেন, আমি হলে পুড়িয়ে হত্যা করার আদেশ দিতাম না। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা আল্লাহ পাকের শাস্তি দানের বস্ত্ত (আগুন) দ্বারা শাস্তি দিও না। আমি বরং এদেরকে হত্যা করতাম। কেননা আল্লাহর রাসুল বলেছেন, যে নিজের দ্বীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করে ফেলবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৯২২, জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪৫৮, সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৩৫১, মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৮৭১)

 

প্রসিদ্ধ হাদীসে এসেছে-

 

عنعبداللهقال : قالرسولاللهصلىاللهعليهوسلم : لايحلدمامرءمسلميشهدأنلاإلهإلاالله،وأنيرسولالله،إلابإحدىثلاث : النفسبالنفس،والثيبالزاني،والمفارقلدينه،التاركللجماعة.

 

২. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে মুসলমান সাক্ষ্য দেয়, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই আর আমি আল্লাহর রাসূল, তিন কারণের কোনো একটি ব্যতীত তার রক্ত প্রবাহিত করা হালাল নয় : অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা, বিবাহিত ব্যক্তি যেনা করা, ইসলাম ত্যাগ করে উম্মত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৮৭৮, জামে তিরমিযী, হাদীস ১৪০২, মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, হাদীস ১৮৭০৪, বায়হাকী ৮:১৯৪ ইত্যাদি)

 

অন্য একটি হাদীসে এসেছে-

 

৩. আবু মুসা আশআরী রা. বলেন, আমি নবীজীর নিকট এলাম। আমার সঙ্গে দুজন আশআরী লোক ছিল। তারা দুজনেই প্রশাসনিক পদ প্রার্থনা করল। নবীজী চুপ করে রইলেন। একটু পর আমাকে বললেন, আবু মুসা! তোমার কী মত? আমি বললাম, যে আল্লাহ আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তার কসম করে বলছি, এরা দুজন তাদের মনের কথা আমাকে জানায়নি। আমিও ভাবতে পারিনি যে, তারা পদের আশায় এসেছে। আবু মুসা বলেন, আমি যেন এখনো দেখতে পাচ্ছি নবীজীর মেসওয়াক ঠোঁটের তলে উচু হয়ে আছে। হুজুর বললেন, আমরা কোনো উমেদারকে প্রশাসনের কাজে নিযুক্ত করি না। তবে আবু মুসা, তুমি যাও। অতঃপর নবীজী তাকে ইয়ামান পাঠালেন। তার পিছনে পাঠালেন মুআয ইবনে জাবালকে।

 

বর্ণনাকারী বলেন, মুআয যখন আবু মুসার কাছে পৌঁছলেন, তখন আবু মুসা তাকে স্বাগতম জানালেন এবং বসার জন্য তাকিয়া এগিয়ে দিলেন। ইতিমধ্যে দেখা গেল, আবু মুসার পাশে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে এক ব্যক্তি। মুআয বললেন, এর কী হল? তিনি বললেন, এই লোক ইহুদী ধর্ম ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু আবার সে তার বিকৃত ধর্মে ফিরে গেছে। মুআয বললেন, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা। আবু মুসা বললেন, হাঁ, ঠিক আছে। আপনি একটু বসুন। কিন্তু তিনি বললেন, না, একে হত্যা করার আগ পর্যন্ত আমি বসব না। এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নিদের্শ। তিনি এ-কথা তিনবার বললেন। অবশেষে আবু মূসা লোকটিকে হত্যা করে ফেলার আদেশ দিলেন এবং তাই করা হল। (সুনানে আবু দাউদ : হাদীস ৪৩৫৪)

 

আরও এক হাদীসে এসেছে-

 

৪. যখন উমর রা. এর নিকট তুসতার নামক এলাকা বিজয়ের সংবাদ এলো, তখন তিনি সংবাদবাহীদের কাছে কোনো বিরল ঘটনা ঘটেছে কি না জানতে চাইলেন। লোকেরা বললো, এক মুসলমান ব্যক্তি মুশরিক হয়ে গিয়েছিলেন তাকে আমরা গ্রেফতার করে নিয়েছি। তিনি বললেন, ঐ লোকের সঙ্গে তোমরা কী আচরণ করেছো? তারা বললো, আমরা তাকে হত্যা করে ফেলেছি। হযরত উমর বললেন, যদি তাকে একটি ঘরে আবদ্ধ করে রাখতে এবং ক্ষুধা নিবারণের জন্য প্রতিদিন রুটি দিতে। এইভাবে তিনদিন তওবা তলব করতে তাহলে কত ভালো হতো! তখন সে তওবা করলে তো করল, না হয় হত্যা করে ফেলতে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদীস ২৯৫৮৮)

 

মুরতাদের শাস্তি প্রসঙ্গে উম্মতের ইজমা

 

হাদীসে নববী যেমন শরীয়তের স্বয়ংসম্পূর্ণ দলিল, ইজমাও তেমনি পৃথক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দলিল। অর্থাৎ শরীয়তের কোনো বিষয়ে যদি উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে ঐ বিষয়ে সরাসরি কুরআন ও হাদীসের কোনো বক্তব্য না থাকলেও শুধু ইজমার ভিত্তিতে সেটা শরীয়তের অকাট্য বিধানরূপে পরিগণিত হয়।

 

মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড-এর উপর উম্মতের ইজমা রয়েছে। কোনো দ্বীনী বিষয়ে যুগের মুজতাহিদ আলেমগনের মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়াকে ইজমা বলে। এখানে ইজমার কিছু দলিল তুলে ধরা হচ্ছে। এ- থেকে মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে শরীয়তের তৃতীয় দলিলের ফায়সালা সামনে এসে যাবে এবং এই দলিলের মাধ্যমেও এটা আরেকবার স্পষ্ট হবে যে, উল্লিখিত আয়াত ও হাদীসের বক্তব্য তা-ই, যা উপরে বলা হয়েছে।

 

ইমাম তিরমিযী (মৃত্যু ২৭৯- হি.) তার জামে তিরমিযীর ১৪৫৮ নম্বর হাদীস-منبدلدينهفاقتلوه অর্থাৎ যে তার দ্বীন পরিবর্তন করবে, তাকে হত্যা করে ফেলবে-এর অধীনে লিখেছেন,

 

والعملعلىهذاعندأهلالعلمفيالمرتد

 

অর্থাৎ মুরতাদের শাস্তির বিষয়ে ইলমের সকল ধারক-বাহকের নিকট এটাই অনুসৃত বিধান।

 

ইবনে আরাবী (মৃত্যু ৫৪৩ হি.) ইমাম তিরমিযীর উপরোক্ত বক্তব্যের প্রসঙ্গে লিখেছেন,

 

لاخلاففيأنالمرتديقتل.

 

অর্থাৎ মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড-এ ব্যাপারে কারো কোনো দ্বিমত নেই।-আরিযাতুল আহওয়াযী ৬/২৪৩

 

ইবনু আব্দিল বার (মৃত্যু ৪৬৩ হি.) লিখেছেন,

 

إنمنارتدعندينهحلدمه،وضربتعنقه،والأمةمجتمعةعلىذلك

 

অর্থাৎ যে তার দ্বীন ত্যাগ করে তাকে হত্যা করা বৈধ হয়ে যাবে এবং তার শিরশ্ছেদ করা হবে। মুরতাদের এ শাস্তির বিষয়ে পুরো উম্মতের সুপ্রতিষ্ঠিত ইজমা তথা মতৈক্য রয়েছে। আততামহীদ ৫/৩০৬

 

ইবনে কুদামা হাম্বলী (মৃত্যু ৬২০ হি.) লিখেছেন,

 

وأجمعأهلالعلمعلىوجوبقتلالمرتدين. ورويذلكعنأبيبكر،وعثمان،وعلي،ومعاذ،وأبيموسى،وابنعباس،وخالدوغيرهم،ولمينكرعلىذلك. فكانإجماعا.

 

অর্থাৎ সব ধরনের মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। এ বিষয়ে আলেমগণের ইজমা তথা মতৈক্য রয়েছে। হযরত আবু বকর, উসমান, আলী, মুআয, আবু মুসা, ইবনে আববাস এবং খালিদ ইবনে ওয়ালীদ প্রমুখ সাহাবী রাযিয়াল্লাহু আনহুম থেকে এ শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। আর এ শাস্তির উপর কোনো সাহাবী আপত্তি করেননি। অতএব মৃত্যুদন্ডের এ বিধানের উপর সাহাবায়ে কেরামেরও ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।-আলমুগনী ১২ : ২৬৪

 

এ বিষয়ে আরও যারা ইজমা নকল করেছেন, তাদের কয়েকজন যথাক্রমে,

 

১. ইবনুল মুনযির (মৃত্যু ৩১৮ হি.)-আলইজমা পৃ. ১২২

 

২. ইবনে হায্ম যাহেরী (মৃত্যু ৪৫৬ হি.)-মারাতিবুল ইজমা পৃ. ২১০

 

৩. ইবনে রুশদ আলহাফীদ মালেকী (মৃত্যু ৫৯৫ হি.)-বিদায়াতুল মুজতাহিদ ২ : ৩৪৩

 

৪. ইবনে কুদামা মাকদিসী হাম্বলী (মৃত্যু ৬৮২ হি.)-আশশরহুল কাবীর ৫ : ৩৫৫

 

৫. বুরহানুদ্দীন আলহানাফী (মৃত্যু ৬১৬ হি.)-আলমুহীতুল বুরহানী ৭ : ৪৪৩

 

৬. ইবনে হাজার মক্কী হাইতামী শাফেয়ী (মৃত্যু ৯৭৪ হি.)-আলইলাম বি কাওয়াতি-ইল ইসলাম পৃ. ৪০০

 

৭. মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আসসানআনী (মৃত্যু ১১৮২ হি.)-সুবুহুস সালাম ৩ : ৫৩৪

 

৮. ইবনে আবেদীন শামী (মৃত্যু ১২৫২ হি.)-রাসায়েল ১ : ৩১৬

 

৯. যফর আহমদ উসমানী (মৃত্যু ১৩৯৬ হি.)-ইলাউস সুনান ১২ : ৫৯৯

 

যুক্তির আলোকে মুরতাদের মৃত্যুদন্ড

 

শরীয়তের সকল বিধানেরই যৌক্তিকতা রয়েছে। যে সকল বিধানের দলিল কুরআন, হাদীস ও ইজমায়ে উম্মতের মাঝে বিদ্যমান, সে সকল বিধানের উপর আমলের জন্য কেয়াস তথা যৌক্তিকতার অপেক্ষায় থাকা চলে না। এজাতীয় বিধানের যৌক্তিকতা বোধগম্য হোক বা না হোক, এর উপর আমল অপরিহার্য। মুতরাদের মৃত্যুদন্ডের বিষয়টিও তেমন একটি বিধান। যদিও এ-বিধানটিও খুবই যুক্তিযুক্ত। আর এখানে এটাও স্মরণ রাখা উচিতৎ যে, শরীয়তের বিধানাবলীর প্রকৃত রহস্য, হেকমত ও যৌক্তিকতা আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন। কারণ তিনিই হলেন সৃষ্টিকর্তা শরীয়তদাতা, বিধানদাতা। তবে মানুষের সাধ্যের ভিতরে যতটুকু আছে, ততটুকু যৌক্তিকতা জানা মানুষের আন্তরিক প্রশান্তি বৃদ্ধির জন্য সহায়ক।

 

মুরতাদের মৃত্যুদন্ডের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে ইবনুল কায়্যিম আলজাওযিয়্যাহ (মৃত্যু ৭৫১ হি.) লিখেছেন,

 

فأماالقتلفجعلهعقوبةأعظمالجنايات،كالجنايةعلىالنفسوكالجنايةعلىالدينبالطعنفيهوالارتدادعنه،وهذهالجنايةأولىبالقتلإذبقائهبينأظهرالعبادمفسرةلهم،ولاخيريرجىفيبقائهولامصلحة.

 

 মৃত্যুদন্ড হলো সর্বোচ্চ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি। সর্বোচ্চ অপরাধ যেমন, মানুষ হত্যা, দ্বীনের বিষয়ে কটূক্তি করা বা দ্বীন ত্যাগ করার মাধ্যমে দ্বীনের উপর আঘাত হানা ইত্যাদি।

 

ইরতিদাদের অপরাধে মৃত্যুদন্ড দেওয়া খুবই যুক্তিসঙ্গত। কারণ সমাজে মুরতাদের অবস্থান সংঘাত-সহিংসতা ও আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতির কারণ হয়ে থাকে। এমন ব্যক্তির বেঁচে থাকার মাঝে কোনো মঙ্গলের আশা করা যায় না। একে বাঁচিয়ে রাখা বরং অনেক বড় নির্বুদ্ধিতা।-ইলামুল মুওয়াক্যিঈন ২/৮৪

পাঠক! আমরা যদি সাম্প্রতিক পরিস্থিতির দিকে একটু লক্ষ্য করি, তাহলেই আমাদের সামনে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

(আরো সংযুক্ত হবে।)

Leave a Comment

Your email address will not be published.