আল কুরআনে নারী: আল্লাহ দিলেন নারীর মর্যাদা, অধিকার ও নিরাপত্তা

নারীর অধিকার

وَإِذَا الْمَوْءُودَةُ سُئِلَتْ l بِأَيِّ ذَنْبٍ قُتِلَتْ

যখন জীবন্ত প্রোথিত কন্যা সন্তানকে জিজ্ঞেস করা হবে; কোন অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।-সূরা তাকভীর, আয়াত : ৮-৯

এই আয়াতে নারীর বিষয়ে জাহেলী যুগের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। সে সমাজে পুরুষ ও জীবজন্তুর মধ্যস্থলে ছিল নারীর অবস্থান। কন্যা সন্তানের জন্ম সেখানে ছিল অভিশাপ আর অপমানের বিষয়। যেন তা মহাপাপ বা স্থায়ী অমর্যাদার কারণ। অপমানবোধ আর মর্যাদা রক্ষায় জীবন্ত কবর দেয়া হতো কন্যা সন্তানকে। কত হীন মানসিকতা ও কতটা অপমানবোধ হলে মানুষ নিজের ঔরসজাত সন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলতে পারে! সেখানে তো নারীকে মানুষ বলেই গণ্য করা হতো না। না নিজের সত্তার ওপর ছিল তার কোনো অধিকার, না সম্পদের উপর; বরং সে নিজেই ছিল সম্পদ;ওয়ারিসসূত্রে যার হাত বদল হত।

ইসলাম এল, নারী মুক্তি পেল। ঘোষণা হল, কত নিষ্ঠুর তোমাদের এ কাজ।

কন্যা সন্তানের জন্মকে বলা হল ‘সুসংবাদ’

وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالْأُنْثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ l يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ

তাদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের ‘সুসংবাদ’ দেয়া হয় তখন তার চেহারা মলিন হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়। সে এ সুসংবাদকে খারাপ মনে করে নিজ সম্প্রদায় থেকে লুকিয়ে বেড়ায় (এবং চিন্তা করে ) হীনতা স্বীকার করে তাকে নিজের কাছে রেখে দেবে,নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে। কত নিকৃষ্ট ছিল তাদের সিদ্ধান্ত। (সূরা নাহ্ল,আয়াত : ৫৮-৫৯)

 

কন্যা সন্তানের জন্মকে বলা হচ্ছে ‘সুসংবাদ’

আধুনিক জাহেলী যুগে আজো কিন্তু নারীর জন্ম ‘সুসংবাদ’ নয় তখন নারীকে পুঁতে ফেলা হতো জন্মের পর। আর এখন পুঁতে ফেলা হয় জন্মের আগেই (বিজ্ঞানের কল্যাণে যখন জানতে পারে আগত শিশু নারী)

অধিকার আর মর্যাদা কি কাগজে কলমে আর শ্লোগানে সম্ভব? হৃদয় যদি মেনে না নেয়, ছিড়ে যায় কাগজ, ভেঙে যায় কলম, থেমে যায় শ্লোগান।

 

জাহেলী যুগে নারী ছিল অবহেলিত নির্যাতিত, নারীর প্রতি পুরুষের হীন মানসিকতার কারণে। ইসলাম সে মানসিকতারই  সংশোধন করেছে।

নারী ছিল পুরুষের কাছে অন্যান্য ভোগ্য পণ্যের মত। ইসলাম নারীকে বানাল পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী।

 

নারী নিজেই ছিল পুরুষের সম্পদ, যা ভোগ দখল করা যেত, ইসলাম নারীকে দিল সম্পদের অধিকার। কারো অধিকার নেই তার সম্পদে। কিন্তু তার আছে অধিকার পিতার সম্পদে,স্বামীর সম্পদে, সন্তানের সম্পদে। তার ভরণ পোষণের দায়িত্ব হয় পিতার, নয় স্বামীর, না হয় সন্তানের। কেউ নেই তো রাষ্ট্রের। নারী অভিভাবকহীন নয়;জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।

কিন্তু একটি পুরুষ এই অধিকার ভোগ করার অধিকার রাখে কেবল বালেগ হওয়া পর্যন্ত। পশ্চিমে অবশ্য নারীর বেলায়ও তাই। ফলে তাকে পড়তে হয় বিপদে। আর এটাই হয়তো ‘সমঅধিকার’ দাবিদারদের ইনসাফ(?!)

মত প্রকাশের কোনো স্বাধীনতা নারীর ছিল না। ইসলাম বলল, না;তার মতামত ছাড়া হবে না। স্বামী গ্রহণে নারীর মতই চূড়ান্ত। যদি সে ন্যায়ের উপর থাকে।

জাহেলী যুগের নির্যাতিতা,অবহেলিতা নারী নবীর দরবারে এসে বলার অধিকার পেল, আল্লাহর রাসূল! আমার স্বামী আমার প্রাপ্য হক দেয়নি। বলতে পারল নিজের পছন্দ অপছন্দের কথা; ‘না, অমুক আমার পছন্দ নয়।’

তবে নারীর ভরণ পোষণে যেমন তার অভিভাবক দায়িত্বশীল,যেন ভরণ পোষণের পিছে ছুটতে গিয়ে সে ক্ষতির সম্মুখীন না হয় (যেমনটি ঘটে পশ্চিমা নারীর বেলায়, জীবিকার অর্জনে সবকিছু বিসর্জন দিতে হয়) তেমনি নারী যাতে বৈবাহিক জীবনেও ক্ষতির সম্মুখীন না হয় এ ব্যাপারেও নারীর অভিভাবক দায়িত্বশীল। জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই নারীকে অনিরাপদ ছেড়ে দেয়নি ইসলাম। তবে নারীকে দিয়েছে মত প্রকাশের অধিকার। অভিভাবক যদি তার প্রতি অবিচার করে, সে বলতে পারবে।

অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে নারীকে স্বাধীনতার দাওয়াত দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এ স্বাধীনতা বা অধীনতামুক্ত হওয়ার অর্থ কী? পিতা ও স্বামীর অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বার্থান্বেষী,কপট শত পুরুষের অধীন হওয়া। অধীনতামুক্ত বলে কোনো বিষয় নেই। (একমাত্র আল্লাহই অধীনতামুক্ত)

নারীকে আহবান জানানো হচ্ছে স্বনির্ভর হতে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে। কিন্তু পায়ের তলের ঐ মাটিই যদি নারীকে  গ্রাস করতে উন্মুখ হয় তখন?

ইসলাম দিল নারীর নিরাপত্তা। নারীর প্রতি চোখ তুলে তাকানোও নিষেধ। পুরুষকে বলে দিল, হে পুরুষ! তোমার দৃষ্টি অবনত রাখ, আর লজ্জাস্থানের হেফাজত কর। আরো বললো, কোনো পুরুষ যেন কোনো বেগানা নারীর সাথে নির্জনে মিলিত না হয়। কারণ, তা নারীর বিপদের কারণ হতে পারে। নারীর প্রতি সকল প্রকারের অন্যায়কে ঘোষণা করল মহাপাপ, কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে।

নারীকেও বাতলে দিল নিরাপদ থাকার পথ।

আজকের ‘পুরুষতান্ত্রিক’ সমাজ নারী মুক্তির মেকি শ্লোগান দিয়ে কী পেতে চায়? আর নারীকেই বা কী দিতে চায়? নইলে নারীকে কেন হতে হয়; নতুন মডেলের গাড়ির ‘মডেল’,পণ্যের এ্যাডে ‘নারীপণ্য’? অর্থের বিনিময়ে কেন কেনা যায় নারীর রূপ-যৌবনের চিত্র? নারীকে রক্ষা না করে কেন তাকে ধোকা দেয়া হয় এই বলে, ‘তুমি যৌনকর্মী (তুমি কর্ম করে খাচ্ছ)? নারী কেন ওয়েটার? কেন সে রূপ-যৌবন নিলামকারী বিমানবালা,সেল্সম্যান? কেন ইডেন,জাহাঙ্গীরনগর ও অন্যান্য নারী কেলেঙ্কারী নারীবাদী সংগঠনগুলোর আন্দোলনের বিষয় হয় না….? আরো কত শত দৃষ্টান্ত,যা কারো অজানা নয়। তারপরও…?

ওরা যদি নারীর মর্যাদা,অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই চাইত,তাহলে নারীর মর্যাদা আর নিরাপত্তা রক্ষা হয় এমন পথই বেছে নিত। যেটা করেছে ইসলাম। ইসলাম কি নারীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে অস্বীকার করে? তাহলে দেন মোহর,মিরাস এবং মর্যাদা ও নিরাপত্তা ঠিক রেখে অর্থ উপার্জনের অধিকার কেন দিয়েছে? (তার উপর তো কারো ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেই)

নারী শুধু ভাবে, নারীর জন্য এত শর্ত কেন ইসলামে? তারই নিরাপত্তার জন্য,মর্যাদা রক্ষার জন্য।

ইসলাম কি শিক্ষার অধিকার দেয়নি নারীকে? দিয়েছে। কিন্তু শিক্ষার নামে নিরাপত্তাহীন পরিবেশে ছেড়ে দেয়নি।

তাই আজ ভাবতে হবে, কে নারীর প্রকৃত কল্যাণকামী?

সব শ্লোগান যখন থেমে যায়,নারীর যখন চোখ খোলে (সবকিছু হারানোর পর) তখন সবকিছুর দায় ও বোঝা কাকে বহন করতে হয়? এমনকি পশ্চিমেও? আর আইন? সেওতো অবলা হয়ে গেছে!

ইসলাম দিয়েছে নারীর নিরাপত্তা আর মর্যাদা। শুধু তাই নয়,যে পুরুষের কাছে নারীর কোনো মর্যাদা ছিল না, তার চরিত্রের ভালো মন্দের বিচারক বানানো হল নারীকে। ঘোষণা হল, তোমাদের মধ্যে সেই পুরুষ সবচেয়ে ভালো যে তার স্ত্রীর কাছে ভালো।

নারী নাম উচ্চারণ ছিল অপমানের, সেখানে আল কুরআনের সূরার নাম হল ‘নারী’ (সূরা নিসা) ।

ঘোষণা হল,নারীকে স্বযত্নে লালন পালন করা পিতামাতাকে নিয়ে যাবে জান্নাতে।

যে ‘রব’ নারীকে অবহেলা আর জুলুমের আঁস্তাকুর থেকে তুলে এনে এত অধিকার,ইনসাফ আর মর্যাদা দিলেন তিনি কি তাঁর অমঙ্গল চান? তাহলে তার নির্দেশনার সাথে বিদ্রোহ কেন? নারীর কল্যাণ ও মুক্তি তাঁর নির্দেশনায় নাকি চতুর স্বার্থান্বেষী ভোগবাদীদের মেকি শ্লোগানে?!

নারী ছিল মা হাওয়া। আদমের অর্ধাঙ্গিনী,জীবনসঙ্গিনী। তারপর? তারপর অলক্ষুণে, ভোগের পণ্য, অমর্যাদার কারণ। তারপর আবার কন্যা, জায়া,জননী। নারীর পায়ের তলে সন্তানের জান্নাত। মর্যাদার সুউচ্চ শিখরে সমাসীন। মত প্রকাশে স্বাধীন, নিজের সম্পদের একচ্ছত্র আধিকারী। তারপর? তারপর আবার অপ্রত্যাশিত নারীর জন্ম, অধিকারের মেকি শ্লোগানে বঞ্চিত,ধোকাগ্রস্ত। আবার ভোগের পণ্য! নিলামের পণ্য। সে যুগেও কেনা বেচা হতে,এখনো…! সেদিন জুলুম ছিল, চতুরতা ছিল না। কিন্তু আজ…? সেদিনও পৃথিবীতে তার আগমন ছিল অপ্রত্যাশিত,আজও…! সে যুগের কবি নারীর রূপ যৌবন,যৌবনের আবেদন নিয়ে আলোচনা করত কবিতায়, আর আজ তার রূপ-যৌবন ফেরি করা হয় টিভি পর্দায়। আর কত বলবো, ইতিহাসের পাতা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে এ অন্যায়ের বিবরণে; গ্রীক সভ্যতায়, ভারতীয় সভ্যতায়,চীন-সভ্যতায়,বৌদ্ধ ধর্মে, ইহুদী ধর্মে, খ্রীষ্টধর্মে, হিন্দু ধর্মে অমর্যাদা,অবহেলা আর জুলুমের যুপকাষ্ঠে বলি হয়েছিল নারী ও নারীত্ব। ইসলাম তাকে সেখান থেকে রক্ষা করে সমাসীন করেছে মর্যাদার সুউচ্চ শিখরে।

আদর্শহীন পুরুষ ইসলামে স্বীকৃত হক যথাযথ দেয় নি। তার দায় তো ফেলা যায় না ইসলামের উপর। যে ইসলাম ইনসাফ ফিরিয়ে দিল, তাকেই অভিযুক্ত করা হল না-ইনসাফির অপবাদে?!

আজ নারীর  নিজেকেই নির্ণয় করতে হবে, কে তার কল্যাণকামী আর কে শঠ ও প্রবঞ্চক।-মুহাম্মাদ ফজলুল বারী

Leave a Comment

Your email address will not be published.