বর্তমান সমাজে পর্দা একটি বহুল আলোচিত ও সমালোচিত বিষয়। আধুনিক সমাজে সবচেয়ে কঠিন ইবদত হলো সঠিকভাবে পর্দা পালন করা। পর্দার বিভিন্ন স্তর রয়েছে।
যুগশ্রেষ্ঠ আলেম, সময়ের খ্যাতনামা সংস্কারক হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ.) পর্দাকে তিনটি স্তরে বিন্যস্ত করেছেন। যথা-
১. সর্বনিন্ম স্তর= মুখমন্ডল এবং হাতের কব্জা ব্যতীত নারীর সমুদয় দেহ পর্দাবৃত রাখা। ভিন্নমতে টাখনুর গিরা পর্যন্ত- পায়ের পাতা ব্যতীত গোটা শরীর আবৃত রাখা ফরয।
২. মাদ্যমিক স্তর= মুখমন্ডল হাত এবং পাসহ সবকিছুই বোরখা দ্বারা আবৃত রাখা।
৩. সর্বোচ্চ স্তর= নারী তার শরীর আবৃত রাখার সাথে সাথে তার পরিধেয় বস্রও আবৃত রাখবে। এটা হলো পর্দার সর্বোচ্চ সম্মানিত স্তর।
বর্ণিত প্রথম স্তর সম্পর্কে আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- “মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখে ও তাদের লজ্জাস্হানের হেফাজত করে। তারা, যা সাধারণত প্রকাশ থাকে তা ব্যতীত তাদের আবরণ প্রদর্শন না করে। তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে। তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতাপুত্র, ভগ্নিপুত্র, আপন নারীগণ, তাদের মালিকানাধীন দাসী, পুরুষদের মধ্যে যৌনকামনারহিত পুরুষ এবং নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক ব্যতীত কারও নিকট তাদের আবরণ প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন আবরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে। হে মুমিনগণ ! তোমরা সকলে আল্লাহর সমীপে প্রত্যাবর্তন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা নূর:৩১)
আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে, কোন মহিলার জন্যই মুখমন্ডল, উভয়হাতের কব্জি পর্যন্ত ও উভয় পা ছাড়া অন্যকোন অঙ্গই ‘গায়রে মাহরা ’- যাদের সাথে বিবাহ বৈধ তাদের কারও সামনে খোলা বৈধ নয়। যুবতী ও বৃদ্ধা সকলেই এই হুকমের শামিল। চিকিৎসা বা এই জাতীয় শরীয়ত সমর্থিত ওযর ও সমস্যা ছাড়া কারও সামনেই সতর খোলা জায়েয নেই। এখানে লক্ষনীয় বিষয় হলো, কর্মব্যস্ততার কারণে যদি কোন মহিলার উপরোক্ত অঙ্গগুলো থেকে কাপড় সরে যায় তাহলে এতে কোন গোনাহ নেই। সুতরাং এই অনুমতির অর্থ যে একথা নয়, এসব অঙ্গ প্রদর্শনী করে বেড়াবে-তা খুব সহজেই অনুমেয়। (পরদাহকে শরঈ আহকাম, হাকীমুল উম্মত থানবী (রহ.))
একটি হাদীসে আছে, রসুলে কারীম সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসা্ললাম ইরশাদ করেন-
“হে আসমা, কোন মেয়ে যখন সাবালিকা হয় তখন তার মুখমন্ডল ও হাতের কব্জি ব্যতীত অন্য অঙ্গ দেখা জায়েয নেই”। (প্রাগুক্তঃ১০পৃ)
দ্বিতীয় স্তরের পর্দা সম্পর্কে আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
“তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়”। (সূরা আহযাবঃ৫৯)
আয়াতে উল্লেখিত ‘জালাবীব’ শব্দটি ‘জিলবাব’ শব্দের বহুবচন। যার অর্থ অর্থ বিশেষ ধরনের লম্বা চাদর। এই চাদরের আকার-আকৃতি সম্পর্কে বিখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেনঃ ‘আমি হযরত উবায়দা সালমানী (রহ.) কে এই আয়াতের উদ্দেশ্য এবং জিলবাব এর আকার-আকৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি মস্তকের উপর দিক থেকে চাদর টেনে মুখমন্ডলের উপর ঝুলিয়ে দিলেন এবং মুখমন্ডল ঢেকে ফেললেন এবং শুধু চোখ খোলা রেখে আয়াতের ব্যাখ্যা বাস্তবে দেখিয়ে দিলেন’।
এতে একথা প্রতীয়মান হয়, নারীরা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলে লম্বা চাদর দ্বারা শরীর আবৃত করে বের হবে এবং সেই চাদরটি মাথার উপরের দিক থেকে এমনভাবে ঝুলিযে দিবে যাতে মুখমন্ডল ঢেকে যায়। আমাদের বর্তমান মুসলিম সমাজে প্রচলিত বোরকাও এর স্হলাভিষিক্ত হতে পারে। (মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষিপ্ত: ১০৯০-১০৯৮পৃ.)
তৃতীয় স্তরের পর্দা সম্পর্কে আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- “এবং তোমরা স্বগৃহে অবস্হান করবে, প্রাচীন জাহেলী যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেরিও না”। (আহযাবঃ৩১)
বক্ষমান আয়াত থেকে একথা স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়, আল্লাহর দরবারে নারীদের বাড়ি থেকে বের না হওয়াই কাম্য। কারণ, গৃহকর্ম সম্পাদনের মহান লক্ষ্যেই তাদের সৃষ্টি। এই নিয়েই তারা ব্যস্ত থাকবে। মূলত শরীয়তের কাম্য প্রকৃত পর্দা হলো গৃহের অভ্যন্তরে পালিত অনুসৃত পর্দা। শরীয়ত সমর্থিত প্রয়োজন ছাড়া তাদের জন্য ঘর থেকে বের হওয়া হারাম। (মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষিপ্তঃ১১৭৭ পৃ.)
হাদীস শরীফে রাসূল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসা্ললাম ইরশাদ করেন:
‘নারী হলো গোপনযোগ্য ! যখন ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান তার দিকে দৃষ্টি উচু করে তাকাতে থাকে’। (তাবরানী, তারগীব)
এই হাদীসের স্পষ্ট ভাষ্য হলো, পর্দার ভেতরে থাকাটাই নারীর জন্যে শোভনীয়। যদি কোন নারী বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হয় তখন শয়তান পুরুষদের মনে কুমন্ত্রনা দেয়, প্রলোভন সৃষ্টি করে যেন সে নারীর রূপ লাবণ্যের প্রতি কু-দৃষ্টিতে তাকায় এবং তার দেহ সৌন্দর্য ক্ষুধার্ত দৃষ্টিতে উপভোগ করে।
ইসলামী ফিকহ’ র দৃষ্টিতে সাধারণত প্রথম স্তরের পর্দা হলেও ফিতনার আশংকা থাকলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরের পর্দাও ওয়াজিব হয়ে পড়ে। অবশ্য ফিতনার আশংকা না থাকলে তা কেবল ‘উত্তম পর্দা’ বলেই বিবেচিত হবে। কিন্তু ফিতনার আশংকা কোথায় আছে আর কোথায় নেই- তাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন মহান আল্লাহ !
ইরশাদ করা হয়েছে পবিত্র কুরআনে-
“বৃদ্ধা নারী যারা বিবাহের আশা রাখে না, তাদের জন্যে অপরাধ নেই- যদি তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে তাদের বহির্বাস খুলে রাখে, তাবে এ থেকে বিরত থাকাই তাদের জন্যে উত্তম। আল্লাহ তা‘আলা সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ”। (সূরা নূরঃ৬০)
অর্থাৎ যেসব নারীদের ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে তারাই এই আয়াতের আলোচ্য নারী সমাজ। তারা যদি তাদের পরিধেয় বস্রের উপরের চাদর খুলে ফেলে তবে তাতে তাদের ক্ষতি নেই। কিন্তু যুবতী কিংবা মাঝ বয়সী নারীরা এমনটি করতে পারে না আদৌ। কারণ তাদের ক্ষেত্রে ফিতনার আশংকা সর্বদাই বিরাজমান এবং প্রবলভাবে । (পরদাহকে শরঈ আহকাম, ১৫-২০ পৃ.)
পবিত্র আয়াতটির বক্তব্য থেকে একথা দিবালোকের মত প্রতিভাত হয়ে ওঠে যে, ফ্রি মাইন্ড বা উদার মনের মত আধুনিক চাকচিক্যপূর্ণ শব্দাবলীর আড়াল ধরে যুবতী ও মাঝবয়সী নারীদের কোন পরপুরুষের কাছাকাছি আসার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই।