পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে ইসলামে মধ্যমপন্থা ও পরিমিতবোধের গুরুত্ব

পূর্ববর্তী অংশ=
বিবাহের ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যমপন্থা ও পরিমিতবোধের গুরুত্ব

পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে পরিমিতবোধ:

পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশনা হল-

إذا خطب إليكم من ترضون دينه وخلقه فزوجوه إلا تفعلوا تكن فتنة في الأرض وفساد عريض.

‘যার দ্বীনদারী ও আখলাক-চরিত্রে তোমরা সন্তুষ্ট, এমন কেউ প্রস্তাব দিলে তার সাথে তোমরা বিবাহ সম্পন্ন কর। তা না করলে পৃথিবীতে ফিৎনা দেখা দেবে ও ব্যাপক ফ্যাসাদ ছড়িয়ে পড়বে।’
(তিরমিযী, হাদীস : ১০৮৪)

এবং ইরশাদ হয়েছে-

تنكح المرأة لأربع : لمالها ولحسبها ولجمالها ولدينها فاظفر بذات الدين تربت يداك.

‘নারীকে বিবাহ করা হয় চারটি জিনিস দেখে। তার সম্পদ দেখে, বংশমর্যাদা দেখে, রূপ দেখে এবং দ্বীনদারী দেখে। হে মুমিন! তুমি দ্বীনদার নারী বিবাহ করে ধন্য হয়ে যাও।’
(বুখারী, হাদীস : ৫০৯০; মুসলিম, হাদীস : ১৪৬৬)

অপর এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা নারীদের (কেবল) রূপ দেখে বিবাহ করো না। অসম্ভব নয় রূপই তাদের বরবাদ করে দেবে। তাদের অর্থ-সম্পদ দেখেও বিবাহ করো না। হতে পারে অর্থ-সম্পদ তাকে উদ্ধত করে তুলবে। বরং দ্বীন দেখেই তাদের বিবাহ কর। একজন নাক-কান-কাটা কালো দাসীও (রূপসী ধনবতী স্বাধীন নারী অপেক্ষা) শ্রেয়, যদি সে দ্বীনদার হয়। (ইবনে মাজাহ)

এসব হাদীসের শিক্ষা হল পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে দ্বীনদারী ও আখলাক-চরিত্রকেই পয়লা নম্বরে রাখতে হবে। চেহারা-সুরতও অবহেলার নয়। অর্থ-সম্পদ ও বংশীয় সমতাও বিচার্য বটে, কিন্তু সবই দ্বীনদারীর পরবর্তী স্তরে। দ্বীনদারী ও আখলাক-চরিত্র সন্তোষজনক হলে বাকিগুলোতে ছাড় দেওয়া যায়, কিন্তু বাকিগুলো যতই আকর্ষণীয় হোক, তার খাতিরে দ্বীনদারীতে ছাড় দেওয়ার অবকাশ নেই। হাঁ দ্বীনদারীর সাথে অন্যগুলোও যদি মিলে যায়, সে অতি সুন্দর মিলন বটে, কিন্তু তা খুব সহজলভ্যও নয়। তাই সে রকম আশার ক্ষেত্রে মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া জরুরি।
অর্থাৎ পয়লা নম্বরের শর্ত পূরণ হয়ে গেলে অন্যগুলোতে বেশি কড়াকড়ি না করে চলনসই পর্যায়ে চিন্তা করতে হবে। অর্থাৎ বংশ-মর্যাদা সমান-সমান না হলেও কাছাকাছিতেই সন্তুষ্ট থাকা, অর্থ-সম্পদে উনিশ-বিশ বা আরও কিছু বেশি তারতম্য থাকলেও তা উপেক্ষা করা এবং রূপ-সৌন্দর্যেও আকাশ-পাতাল পার্থক্য না হলে তা অগ্রাহ্য করা বাঞ্ছনীয়।
আমাদের ফকীহগণ বলেছেন, স্ত্রীর নগদ মোহর এবং খোরপোশ ও থাকার স্থান দেওয়ার মতো সামর্থ্য যার আছে, ধনবতী কনের পক্ষে সে অনুপযুক্ত পাত্র নয়। হাঁ যার সেই সামর্থ্যও নেই, সে রকম হতদরিদ্র ধনবতীর পক্ষে অনুপযুক্তই বটে।
এমনিভাবে বনূ হাশিম ও কুরায়শের বাইরে আর যত গোত্র-বংশ আছে, তারা বনূ হাশিম ও কুরায়শের সমমানের না হলেও তারা পরস্পরে সমমানেরই গণ্য হবে।

সুতরাং শেখ, চৌধুরী, তালুকদার, মল্লিক, হাওলাদার ইত্যাদি বংশসমূহের মধ্যে কৌলীন্যগত বিশেষ পার্থক্য নেই, তাতে তারা নিজেদেরকে নিজেদের দৃষ্টিতে অন্যদের অপেক্ষা যত অভিজাতই মনে করুক না কেন। যতটুকু পার্থক্য আছে, দ্বীনদারীর শর্ত পূরণ হওয়ার পর তার জন্য বিবাহকে আটকে রাখা সমীচীন নয়। আমাদের ফকীহগণ এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এ স্থলে আমাদের বলার উদ্দেশ্য কেবল এতটুকুই যে, দ্বীনদারীকে প্রাধান্য দেওয়ার পর অন্যসব শর্তকে শিথিল পর্যায়েই বিবেচনা করা উচিত। একদম অগ্রাহ্য করাও নয়, যেমনটা কেউ কেউ বেহুঁশ জোশের কারণে করে থাকে। এবং মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়াও হয়। সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করার পরিণতিও অনেক সময় ভালো হয় না। কেননা কৌলীন্যে বেশি তফাৎ থাকলে বনিবনাও কঠিন হয়ে যায়।
হযরত যায়নাব বিনতে জাহ্শ রা. ও হযরত যায়েদ ইবনে হারিছা রা.-এর বিবাহ থেকে আমরা সে শিক্ষা পাই। অভিজাত কুরায়শী নারীর পক্ষে একজন আযাদকৃত গোলামের সাথে মধুর দাম্পত্য রচনা কঠিন হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত সে বিবাহ টিকতে পারেনি। সব সমাজেই এটা একটা অনস্বীকার্য বাস্তবতা।

অনুরূপ ধনী-নির্ধনের জোড়ও অনেক সময় টেকসই হয় না। রূপ ও সৌন্দর্যও হৃদয় কাড়ে বৈকি। এর মধ্যে দুস্তর ব্যবধানও শয়তান বা প্রবৃত্তির ছলনায় মদদ যোগাতে পারে। এ কারণেই তো শরীআত বিয়ের আগে দেখে নেওয়ার হুকুম দিয়েছে। মোদ্দাকথা, ইসলাম এসব ব্যাপারকে অবজ্ঞা করেনি; বরং গুরুত্বের মাত্রা অনুযায়ী এরও মূল্যায়ন করেছে। সুতরাং পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে এসবও বিবেচনায় রাখা চাই। তবে মাত্রাজ্ঞানের সাথে। অর্থাৎ এসব নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি সংগত নয়, যদ্দরুন আসল শর্ত দ্বীনদারীটাই চাপা পড়ে যায় এবং বিবাহের মূল উদ্দেশ্য ভেস্তে যায়।

কুরআন-হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী মানব প্রজন্ম রক্ষার সাথে সাথে চরিত্র রক্ষা ও মনের প্রশান্তিলাভও বিবাহের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। যে কোনও পক্ষে দ্বীনদারীর অভাব থাকলে এসব উদ্দেশ্যের সবটাই ঝুকিতে পড়ে যায়। মানব প্রজন্ম হতে পারে কলুষিত, চরিত্র হতে পারে কলঙ্কিত আর মনের শান্তি থেকে যেতে পারে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

এ কেবল আশংকাই নয়। অকাট্য বাস্তবতা। আজকের মানবসমাজ অশান্তির আগুনে পুড়ছে। মানুষের দাম্পত্য জীবন বড় যন্ত্রণাময়। মানুষ ঘরের বাইরে সুখ খুঁজছে। যুগলসমূহ তাদের ভক্তি-বিশ্বাসের শিকল ছিন্ন করে অন্ধকার পথে ছুটছে। পিপাসা নিবারণের জন্য মরিচিকার দ্বারস্থ হচ্ছে। দেহমনের অতৃপ্তি ঘোচানোর ব্যর্থ প্রয়াস কোথায় না চোখে পড়ছে? কেন আজ এ পরিস্থিতি? যে দাম্পত্যের ব্যবস্থাই দেওয়া হয়েছে বহির্জীবনের সংগ্রাম-সংঘাতে জর্জরিত, কঠোর-কঠিন মেহনতে ক্লান্ত শ্রান্ত দেহমনে শান্তির পরশ বুলানোর জন্য, মানুষের অমূল্য চরিত্রের হেফাযতের জন্য, তা কেন অশান্তির কাঁটা হয়ে শান্তিকামী জুটিকে নিত্যদিন বিঁধছে? কারণ আর কিছুই নয়। বাছাইপর্বের ভুল।

সেই ভুল-ই এ অনর্থের মূল। মানুষ দ্বীনের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিচ্ছে। পয়লা নম্বরের শর্তকে হয় উপেক্ষা, নয়ত সবশেষে নিয়ে গেছে। এসব তারই খেসারত। এ খেসারত যে দিতেই হবে সে কথাও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীসে পরিষ্কার।
তিনি ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি কোন নারীকে বিবাহ করবে (কেবল) তার ক্ষমতার কারণে আল্লাহ তাআলা তার অসহায়ত্বই বৃদ্ধি করবেন। যে ব্যক্তি কোন নারীকে বিবাহ করবে তার সম্পদের লোভে, আল্লাহ তাআলা তার দারিদ্র্যই বৃদ্ধি করবেন, যে ব্যক্তি কোন নারীকে বিবাহ করবে তার বংশমর্যাদার কারণে আল্লাহ তাআলা তার হীনতাই বৃদ্ধি করবেন আর যে ব্যক্তি কোন নারীকে বিবাহ করবে নিজ দৃষ্টি সংযতকরণ, চরিত্রের হেফাযত ও আত্মীয়তা রক্ষার উদ্দেশ্যে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য তার স্ত্রীকে এবং স্ত্রীর জন্য তাকে কল্যাণময় করবেন। (তবারানী, আলআওসাত, হাদীস : ২৩৪২)

অপর এক হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি চরিত্র রক্ষার উদ্দেশ্যে বিবাহ করে, আল্লাহ তাআলা তার সাহায্য করাকে নিজের প্রতি অবধারিত করে নিয়েছেন। (তিরমিযী, হাদীস : ১৬৫৫; নাসায়ী, হাদীস : ৩২১৮)

এসব হাদীস আমাদেরকে এ শিক্ষাই দেয় যে, পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে দ্বীনদারীকেই সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দিতে হবে এবং বিবাহের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণ হওয়াটা তারই উপর নির্ভরশীল। এর অন্যথা করলে উপরে বর্ণিত অনর্থ অবশ্যম্ভাবী। বরং অনর্থ তারই মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বর্তমান সমাজে যে যৌবনোত্তীর্ণ বা প্রায়োত্তীর্ণ অবিবাহিতদের ক্রমবৃদ্ধি ঘটছে তাও ওই অন্যথাকরনেরই কুফল।

দেখা যায় অর্থ-বংশ ও রূপ নিয়ে অহেতুক বাড়াবাড়ি- খোড়াখুড়ির কারণে ছেলেমেয়ের বিয়েতে অনেক দেরিও হয়ে যায়। অর্থ আছে তো বংশ মেলে না, বংশ মেলে তো দেখতে-শুনতে সেরকম নয়। অর্থাৎ সব মেলানোর সোনার হরিণ খুঁজতে গিয়ে বছরের পর বছর পার হতে থাকে, ওদিকে ছেলেমেয়ের বয়সও বাড়তে থাকে। তো বয়স বাড়ুক, তাই বলে সামাজিক স্ট্যাটাচে তো ছাড় দেওয়া যায় না। কিন্তু সেই নাছোড় স্ট্যাটাচ তো কেবল বয়সই শেষ করে না, ঘুণের মত রূপ-লাবণ্যও তিলে তিলে নিঃশেষ করে। ফলে যেই ছাড় প্রথমেই স্বেচ্ছায় দেওয়া উচিত ছিল, শেষ পর্যন্ত নাচার তা দিতে বাধ্য হতে হয়। তাতেও সবক্ষেত্রে শেষরক্ষা হয় না। কারও কারও চিরটাকাল আইবুড়োই কাটিয়ে দিতে হয় আর অতটা দুর্গতি যার বরাতে লেখা হয়নি, তাকেও অন্তত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়। সুতরাং অভিভাবককে ভাবতে হবে, সে অপেক্ষাকৃত লঘুকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে কিংবা বলা যায় নিজের অপরিমিত খাহেশ পূরণের পাকচক্রে ফেলে ছেলেমেয়ের জীবনকে এভাবে বিপর্যস্ত করবে, না নবী মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা অনুযায়ী পরিমিত চিন্তার সাথে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের বৈতরনী পার হবে এবং প্রিয় সন্তানদের মধুর দাম্পত্য রচনায় অর্থপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

 

পরবর্তী অংশসমূহ=
মোহর নির্ধারণে ইসলামে মধ্যমপন্থা ও পরিমিতবোধের গুরুত্ব

পরিমিতবোধ ও মধ্যমপন্হার উপর অন্যান্য লেখা সমূহ:
আল্লাহ তা‘আলা এ উম্মতকে মধ্যমপন্থী উম্মত বানিয়েছেন-১

1 Comment

  1. Anonymous

    ভালো লিখেছেন ভাইয়া

    Reply

Leave a Comment

Your email address will not be published.