প্রশংসার ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব -১

প্রশংসার ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধ:

সৌন্দর্য ও সদগুণের প্রতি মুগ্ধতা মানবমনের চিরায়ত ধর্ম। সেই মুগ্ধতা যখন বোধ-অনুভব ছাপিয়ে ভাষায় রূপায়িত হয় তখন তা হয় প্রশংসা। সুতরাং প্রশংসা মানবমনের এক অনিবার্য দ্যোতনা। স্বভাব-ধর্ম ইসলামে এ দ্যোতনা নিন্দিত নয়- যতক্ষণ তা স্বাভাবিকতার মাত্রা ছাড়িয়ে বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে না যায়। প্রশংসা যখন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায় তখন আর তা প্রশংসনীয় থাকে না; বরং নিন্দনীয় স্তাবকতায় পরিণত হয়ে যায়। ইসলাম স্তাবকতাকে অনুমোদন করে না। কেননা তা প্রশংসাকারী ও প্রশংসিত উভয়ের পক্ষে ক্ষতিকর। অতএব প্রশংসায় মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দেওয়া ও মধ্যপন্থা অবলম্বন জরুরি। অর্থাৎ যে যতটুকু প্রশংসার উপযুক্ত ঠিক ততটুকু প্রশংসা করা, তার বেশি নয়।

তা কে কতটুকু প্রশংসার উপযুক্ত তা কিভাবে নির্ণিত হবে? এ ব্যাপারে প্রথম কথা হচ্ছে, সৃষ্টিমাত্রেরই রূপ-গুণে সীমাবদ্ধতা আছে। অন্তহীন সৌন্দর্য ও অসীম গুণাবলীর মালিক কেবলই আল্লাহ তাআলা।

তাই তো ইরশাদ হয়েছে,

وَلَوْ أَنَّمَا فِي الْأَرْضِ مِنْ شَجَرَةٍ أَقْلَامٌ وَالْبَحْرُ يَمُدُّهُ مِنْ بَعْدِهِ سَبْعَةُ أَبْحُرٍ مَا نَفِدَتْ كَلِمَاتُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
যদি ভূ-পৃষ্ঠের গাছ-গাছালি সব কলম হয়ে যায় এবং সাগরের সাথে আরও সাত সাগর মিলে কালি হয়ে যায়, তবু আল্লাহর মহিমাকীর্তন শেষ হবে না।’ (লুকমান : ২৭),

তাই আল্লাহর প্রশংসায় বাড়াবাড়ি বলে কিছু নেই। যে যত প্রশংসাই করম্নক, তাঁর অন্তহীন মহিমার সামনে তা কণামাত্রও নয়।

দুনিয়ার সকল কবি-সাহিত্যিক, দুর্দামত্ম সব ভাষা-পণ্ডিত স্বীকার করতে বাধ্য-

اللهم لا نحصي ثناء عليك أنت كما أثنيت على نفسك
‘হে আল্লাহ! আমরা তোমার গুণগান করে কখনও শেষ করতে পারব না। বস্তুত তুমি নিজেই নিজের যেমন গুণগান করেছ, তুমি তেমনই’।

তো আল্লাহ তাআলার প্রশংসার বাড়াবাড়িমূলক যে প্রান্তিকতা তাতে লিপ্ত হওয়া মানুষের পক্ষে সম্ভবই নয়। তবে শৈথিল্যমূলক প্রান্তিকতা অবশ্যই হতে পারে এবং অহরহ তা হচ্ছে। এক তো অধিকাংশ লোকই এক্ষেত্রে গাফলতির শিকার।
প্রথমত প্রতি মুহূর্তে তাঁর অগণ্য নিআমত ভোগ করছে, অথচ একটিবারও মুখে উচ্চারণ করে না الحمد لله ‘আল্লাহরই সকল প্রশংসা’।
দ্বিতীয়ত অনেকে তাঁর প্রশংসা করতে গিয়ে এমনসব বিশেষণ তাঁর প্রতি আরোপ করে, যা তাঁর জন্য মেটেই শোভন নয়। অর্থাৎ ক্ষেত্রবিশেষে তাঁকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করে ফেলে। অথচ আল্লাহ তাআলা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন ليس كمثله شيء ‘তাঁর অনুরূপ নয় কোন কিছুই’।
উদাহরণত কেউ কেউ তাঁর আরশকে রাজা-বাদশাহর সিংহাসনের মত মনে করে এবং বলে থাকে, রাজা-বাদশাহ যেমন সিংহাসনে সমাসীন হয়, তিনিও সেইরকম আরশে আসন গ্রহণ করে আছেন (নাউযুবিল্লাহ)। অথচ এর ফলে আল্লাহ তাআলার অসীম সত্তাকে স্থান-কালে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয় এবং তাঁর জন্য দেহত্ব, অনিত্যতা প্রভৃতি মানবীয় গুণ অনিবার্য হয়, যা থেকে আল্লাহ সম্পূর্ণ মুক্ত ও পবিত্র। এ জাতীয় বিশ্বাস তাঁর মহামর্যাদার সাথে বিলকুল সংগতিপূর্ণ নয়। এতে তো আল্লাহকে মাখলূকের সাথে তুলনা করা হয়ে যায়।

কুরআন-সুন্নাহয় আরশের কথা এসেছে এবং তার বিশালত্বের বিবরণ এসেছে। আরশ আল্লাহ তাআলার মাখলূক। আল্লাহর সৃষ্টির দ্বারাই তা অস্তিত্বে এসেছে। আল্লাহ আরশের খালিক এবং রব। আল্লাহর গুণাবলীর মধ্যে ‘রববুল আরশিল আযীম’ গুণটি কুরআন -সুন্নাহয় অনেকবার উচ্চারিত হয়েছে। এই আরশের সাথেই সম্পৃক্ত আল্লাহ তাআলার একটি ক্রিয়া ইসতিওয়া (استواء) -এর কথা কুরআন মজীদের একাধিক আয়াতে উলেস্নখিত হয়েছে। যেমন সূরা ইউনুসের ৩ নং আয়াতে এসেছে,

إِنَّ رَبَّكُمُ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ

(তরজমা) নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ, যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনি আরশে ‘ইসতিওয়া’ গ্রহণ করেন। তিনি সকল কিছু পরিচালনা করেন। তাঁর অনুমতি ছাড়া কেউ (তাঁর কাছে) কারও পক্ষে সুপারিশ করার নেই। তিনিই আল্লাহ- তোমাদের প্রতিপালক। সুতরাং তাঁর ইবাদত কর। তবুও কি তোমরা অনুধ্যান করবে না?

হযরত মাওলানা তকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম এই আয়াতের অনুবাদের টীকায় লেখেন,

استواء ‘ইসতিওয়া’ -এর শাব্দিক অর্থ সোজা হওয়া, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা, সমাসীন হওয়া ইত্যাদি। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি-সদৃশ নন। কাজেই তাঁর ‘ইসতিওয়া’ ও সৃষ্টির ইসতিওয়ার মত নয়। এর স্বরূপ আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কেউ জানে না। এ কারণেই আমরা কোনও তরজমা না করে হুবহু শব্দটিকেই রেখে দিয়েছি। কেননা আমাদের জন্য এতটুকু বিশ্বাস রাখাই যথেষ্ট যে, আল্লাহ তাআলা নিজ শান মোতাবেক আরশে ‘ইসতিওয়া’ গ্রহণ করেছেন। এ বিষয়ে এর বেশি আলোচনা-পর্যালোচনার দরকার নেই। কেননা আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি দ্বারা এর সবটা আয়ত্ত করা সম্ভব নয়। (তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১১)

কেউ কেউ আল্লাহ তাআলার ‘ইসতিওয়া’ ক্রিয়াটির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এমন বাড়াবাড়ি করে ফেলে যাতে মনে হয় তারা (استوى) ‘ইসতাওয়া’কে সরাসরি جلس (বসা) -এর অর্থে মনে করে। এখানে আরও একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য- কুরআন মজীদে ‘ইসতিওয়া’কে আল্লাহর فعل (ক্রিয়া) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কথা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তারা এটিকে ‘সিফাতে যাতে’র মত মনে করে। এ সব কিছুই সালাফের অনুসৃত ‘মানহাজের’ পরিপন্থী।

এ ব্যাপারে মধ্যপন্থা হল আরশের অসিত্মত্বকে অবশ্যই স্বীকার করা এবং ‘ইসতিওয়া’রও আকিদা রাখা। কিন্তু ‘ইসতিওয়া’র বিষয়টাকে অব্যাখ্যাত রাখা। অর্থাৎ ‘ইসতিওয়া’ তো অবশ্যই হয়েছে, কিন্তু সে ‘ইসতিওয়া’ কী রকম তা আমাদের বোধ-বুদ্ধির অতীত। অমত্মত ইহজগতে বসে তা উপলব্ধি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

যা হোক আল্লাহ তাআলার সত্তা ছাড়া আর কেউ সীমার উর্ধ্বে নয়। নবী রাসূলগণ নিঃসন্দেহে মহামানব ছিলেন, কিন্তু সীমার অতীত ছিলেন না কিছুতেই। তাঁরা অবশ্যই মাসূম ও নিষ্পাপ ছিলেন, কিন্তু সর্বাবস্থায় তাঁরা মানুষই ছিলেন। কাজেই তাদের জন্য উপযুক্ত প্রশংসা তাই, যা তাঁদের নিষ্পাপতা ও নবুওয়াতী মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করবে না, আবার তাদেরকে অপার্থিব ও অতিমানবিক সত্তায়ও পরিণত করবে না, কিংবা তাদেরকে সৃষ্টিকর্তার সত্মরে উপনীত করবে না। বরং মানুষ নবী সর্বাবস্থায় মানবজাতির সর্বোত্তম আদর্শ হয়েই থাকবেন। তাদের প্রশংসা-জ্ঞাপনে এটাই হল মধ্যপন্থা। প্রাণভরে তাদের মহিমাকীর্তণ করুক, তাতে দোষের কিছু নেই, বরং সওয়াবের কাজরূপেই গণ্য হবে। বিশেষত খাতামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ মুসত্মফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণগানে কিছু বলা বা লেখা তো অত্যন্ত বরকত ও সৌভাগ্যের ব্যপার। সাহাবায়ে কিরাম থেকে আজ পর্যন্ত এ উম্মত প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গুণগানকে তাদের নিত্যদিনের একটি করণীয় হিসেবেই গণ্য করে আসছে। মজলিস-মাহফিলের বয়ান-বক্তৃতার বাইরে এটা লেখনী-চর্চার এক গৌরবজনক বিষয়রূপেও বরিত। বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে নবী-প্রশস্তিমূলক গদ্য ও পদ্য রচনার বৈচিত্রপূর্ণ বিপুলতা এক মূর্তিমান বিস্ময়। সন্দেহ নেই সেসব রচনার অংশবিশেষে ভক্তির সীমালংঘনও আছে, কিন্তু মধ্যপন্থার শর্তে উত্তীর্ণ এমন বহু কালজয়ী রচনা আছে, যা তার রচয়িতাকে নাতের জগতে অমরত্ব দান করেছে। চাচা আবু তালিবের লামিয়া, সাহাবী হযরত কা‘ব ইবনে যুহায়রের বানাত সু‘আদ, বূসীরীর কাসীদা বুরদা (দু’চারটি পঙ্তি বাদ দিয়ে যেগুলোতে কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়েছে) প্রভৃতি রচনা নবী-প্রশস্তির অপূর্ব নিদর্শন। মহান সাহাবী কবি হযরত হাসসান ইবনে ছাবিত রা.-এর নাম চিরকাল এ তালিকার শীর্ষস্থানেই শোভা পাবে। সীমার ভেতর থেকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম মহাপুরুষের রূপ-গুণ বড় চমৎকারভাবে চিত্রিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। একটা নমুনা দেখুন-

وأحسن منك لم ترقط عيني + وأجمل منك لم تلد النساء

خلقت مبرأ من كل عيب + كأنك خلقت كما تشاء

তোমার চেয়ে উত্তম কাউকে কখনও দেখেনি এ চোখ

তোমার চেয়ে সুন্দর কাউকে জন্ম দেয়নি কোনো নারী

তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে সম্পূর্ণরূপে দোষমুক্ত করে

যেন তোমাকে সৃষ্টি করা হয়েছে তোমার চাহিদামত

আমাদের কর্তব্য নবী-প্রশস্তিতে এসব আদর্শ পুরুষের অনুসরণ করা, যাতে ভাবাবেগের আতিশয্যে দিশাহারা হয়ে না পড়ি এবং প্রশংসা করতে গিয়ে এমন কিছু না বলে ফেলি, যা আখেরে আমাকে নিন্দিত ও ধিকৃত করে ফেলে। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামসহ সমস্ত নবী-রাসূলেরই আবির্ভাব হয়েছিল তাওহীদের বানী প্রচার করার জন্য। সে হিসেবে আমাদের প্রশংসা অবশ্যই তাওহীদী চেতনার সাথে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। তাওহীদের স্থানে শিরকের প্রচারণায় লিপ্ত না হয়ে পড়ি সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। একদা একদল শিশু তাঁর গুণকীর্তনে গেয়ে উঠেছিল وفينا نبي يعلم ما في غد ‘আমাদের মাঝে আছেন এক নবী – যিনি জানেন আগামী দিনে কী ঘটবে’। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সংগে সংগে থামিয়ে দিলেন এবং বললেন, এতক্ষণ যা বলছিলে তাই বল। বারণ করেছিলেন এ কারণে যে, এটা তাঁর মিশনবিরোধী কথা।
তাঁর তো প্রচার ছিল ‘আমি গায়েব জানি না’ (হূদ : ৩১)।
আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যারা আছে কেউ গায়ব জানে না। কেবল আল্লাহই তা জানেন’ (নামল : ৬৫)।

পরবর্তী অংশসমূহ:
প্রশংসার ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব -২
প্রশংসার ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব -৩
প্রশংসার ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব -৪
প্রশংসার ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব -৫

2 Comments

  1. Pingback: প্রশংসার ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব-৩ - ইসলাম বার্তা

  2. Pingback: প্রশংসার ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যপন্থা ও পরিমিতিবোধের গুরুত্ব -৪ - ইসলাম বার্তা

Leave a Comment

Your email address will not be published.