বিবাহে অভিভাবকের ভূমিকা-১

বিবাহের ক্ষেত্রে যেসব মধ্যপন্থার লংঘন ব্যাপক, অভিভাবকের ভূমিকার বিষয়টিও তার অন্যতমবাড়াবাড়ি দুদিক থেকেই হয়। খোদ অভিভাবকের দিক থেকেও এবং ছেলেমেয়ের দিক থেকেও। দাপুটে অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের মতামতকে গুরুত্ব দেয় না। তাদের কাছে নিজেদের ইচ্ছাই শেষ কথা। ছেলেমেয়ের ইচ্ছা-অভিরুচিকে অবজ্ঞা-অগ্রাহ্য করে নিজেদের খেয়াল-খুশিমত বিবাহ মেনে নিতে তাদেরকে বাধ্য করে। চিন্তা করছে না বিবাহটা তাদের ছেলের বা মেয়ের। একত্রে ঘর-সংসার তারাই করবে। বিবাহের ভালোমন্দ ফল তারাই ভোগ করবে। কাজেই স্ত্রী বা স্বামী নির্বাচনের আসল হক তাদেরই। সে হক থেকে তাদেরকে বঞ্চিত করা নির্ঘাত জুলুম।

অভিভাবকত্বের গুমরে সে জুলুম করার কোন অধিকার তাদের নেই। আর অনধিকার হস্তক্ষেপ তথা জুলুমের পরিণাম কখনওই শুভ হয় না। জুলুম হল জুলুমাত বা বহুমাত্রিক অন্ধকারের উৎস। সেই অন্ধকার থেকে নানা অমঙ্গল জন্ম নেয়। প্রথমেই ছেলে মনে করে স্ত্রী হল তার উপর অভিভাবকদের পক্ষ থেকে এক চাপিয়ে দেওয়া বিপত্তি। কিংবা মেয়ে মনে করে তার অভিভাবক তাকে ধরে বেঁধে অজানা অন্ধকারে নিক্ষেপ করল। এহেন ভাবনার সাথে স্বচ্ছন্দ দাম্পত্যের আশা দুরাশামাত্র। শুরু থেকেই তারা একে অন্যকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করে। ফলে সব কিছুতে কেবল খুঁতই চোখে পড়ে। ভালোটাও যেন ঠিক ভালো মনে হয় না। এভাবে অন্তরে ঘৃণা ও বিদ্বেষ দানা বাঁধতে থাকে। অভিভাবকদের শত চেষ্টাতেও তা দূর করা সম্ভব হয় না। অগত্যা হয় সারাটা জীবন অশান্তির আগুনে জ্বলতে থাক, নয়ত মিছে শান্তির সন্ধানে মরীচিকার পেছনে ছোট আর দ্বীন ও ঈমান সব বরবাদ কর, তা না হলে ছাড়াছাড়ির পথ ধরে নতুন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হও। এই যে, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি তাদের জীবনে দেখা দিল দৃশ্যত এটা তাদের ইচ্ছা-অভিরুচিকে অগ্রাহ্য করারই কুফল। সংগত কারণেই অভিভাবক তার দায়ভার এড়াতে পারে না । ফলে অনুভূতিসম্পন্ন অভিভাবকেরা আপনমনে নিজেদের দুষতে থাকে এবং প্রিয় সন্তানের এহেন দুরাবস্থার ঘটয়িতা হিসেবে মনে মনে দারুণ গ্লানিবোধ করে। আবার বোধ-অনুভবের ঘাটতি যাদের আছে তারা সবটা দায় নিয়তির উপর চাপিয়ে নিজেকে বেকসুর খালাসও দিয়ে ফেলে। তা নিজেরা নিজেদের যতই খালাস দিক না কেন ভুক্তভোগী সন্তানও কি সে রায় সর্বান্তকরণে মেনে নেয়? তাদের মনে কি এর বিরুদ্ধে কোনোই আপত্তি থাকে না? অধিকাংশেরই থাকে এবং সারা জীবনের জন্য সেই অভিভাবক তাদের চোখের-মনের কাঁটায় পরিণত হয়। এভাবে পিতামাতা-সন্তান-কেন্দ্রিক জগতের সর্বাপেক্ষা শক্ত বাঁধনের ও সর্বাপেক্ষা আপনার ভূবনটি ক্ষোভে, অনাস্থায় ও আত্মগ্লানিতে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে বহু ছেলেমেয়েও তাদের বিয়েতে অভিভাবককে মূল্যায়ন করে না। তারা নিজেরাই নিজেদের বিবাহ সেরে ফেলছে। সাম্প্রতিককালে এরকম বিবাহের হিড়িক পড়ে গেছে এটা সহশিক্ষা, পর্দাহীনতা ও অবাধ মেলামেশার কুফল। তরুণ-তরুণীরা পরস্পর কাছাকাছি আসার সুযোগ পাচ্ছে। সেখান থেকে ঘনিষ্ঠতা, পরিশেষে বিবাহ। অভিভাবককে জানানোরও দরকার মনে করছে না বা এই ভয়ে জানাচ্ছে না যে, তারা অমত প্রকাশ করতে পারে এবং বাধা দিতে পারে। কোনভাবে যদি জেনে ফেলে এবং সর্ববিচারে মনঃপুত না হওয়ায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, তবে তাদেরকে দুশমন ঠাওরিয়ে তাদের স্বপ্নকে ধূলিস্যাত করে দিয়ে গোপনে বিবাহ সেরে ফেলছে। তা সাক্ষী রেখে বিবাহ করলে বিবাহ বৈধ হল বটে, কিন্তু এক তো গুপ্ত বিবাহ ইসলামে পছন্দনীয় নয়, দ্বিতীয়ত অভিভাবকবিহীন বিবাহও পুরোপুরি ইসলামসম্মত নয়
এরূপ কখনও সুষ্ঠু ও সুন্দর হয় না। এর পরিণাম শুভ হয় না এবং এর অধিকাংশই টেকসই হয় না। হওয়ার কথাও নয়। দুজন তরুণ-তরুণী যখন পরস্পর ঘনিষ্ঠ হয় তখন তাদের দুজনই ঘোরের মধ্যে থাকে তারা একে অন্যের দ্বারা চরম নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কোনও রকম বিবেচনাবোধ তাদের মধ্যে কাজ করে না। একথা ভাবারই অবকাশ হয় না যে, তারা একে অন্যের জন্য উপযুক্ত কি না। পন্থাটাই যেহেতু বদদ্বীনী তাই দ্বীনদারীর ক্ষেত্রে পারস্পরিক সমতা-সাযুজ্য দেখার তো প্রশ্নই আসে না, এমনকি সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে তারা পরস্পর সমপর্যায়ের কি না সে প্রশ্নও সম্পূর্ণ উপেক্ষিত থাকে। ফলে ঘরে ঘরে আজ অসম বিবাহের হিড়িক। বাড়িওয়ালার মেয়ে তার গাড়ির ড্রাইভারের সাথে চলে যাচ্ছে। কিংবা তার ছেলে কাজের মেয়েকে বিবাহ করছে ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে পাড়ার কোনো অশিক্ষিত বখাটের সাথে ঘড় ছাড়ছে। অপরিণত বয়সের ছেলে মায়ের বয়সী কারও সাথে ফেঁসে গেছে কিংবা কোনো আনকোড়া কিশোরী পক্ককেশ প্রৌঢ়ের গলায় ঝুলে পড়ছে। এজাতীয় অসম পরিণয় কী পরিণতি বয়ে আনতে পারে তা বলাই বাহুল্য। দু-চার দিন পর মোহ যখন ঘুচে যায়, চোখ আপনিই খুলে যায়। জীবনের কি সর্বনাশ করে ফেলেছে তা চাক্ষুস দেখতে পায়। অমনি পরস্পর ঘৃণা-বিদ্বেষ দানা বাঁধতে শুরু করে। শক্তিমান করে দুর্বলের উপর নির্যাতন। হত্যা বা আত্মহত্যা পর্যন্তও গড়ায়। আহা! অমূল্য জীবনের কি করুণ পরিণতি! জীবন বিসর্জনেও কি সে ভুলের খেসারত শেষ হয়ে যায়? তা যে আরও কতদূর গড়ায় সমাজের খোঁজ-খবর নিয়ে কিংবা পত্রপত্রিকার পাতায় নজর বুলালে তার বড় বেদনাদায়ক তফসীল জানা যায়।

দেখা যাচ্ছে ছেলেমেয়ের অমতে যেমন অভিভাবকের একক সিদ্ধান্তও বিবাহের পক্ষে কল্যাণকর হয় না, তেমনি অভিভাবকবিহীন বিবাহও ছেলেমেয়ের জন্য শুভ হয় না। অনর্থ-অশান্তিই উভয় রকম বিবাহের সাধারণ পরিণতি। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, কিন্তু ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই। নিয়ম হিসেবে তা কখনও বিচার্য হয় না। সাধারণত যা ঘটে নীতি নির্ধারণে তাই লক্ষবস্ত্ত হয়ে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যখন বিপত্তিই হয় পরিণতি তখন এজাতীয় বিবাহ সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা উচিত। উভয়পক্ষেরই বাড়াবাড়ি পরিহার করে মধ্যপন্থায় চলে আসা উচিত। বলাবাহুল্য শরীয়ত প্রদত্ত নিয়মই মধ্যপন্থা। তাই অভিভাবকেরও কর্তব্য শরীয়ত তাকে যে সীমা পর্যন্ত ক্ষমতা দিয়েছে সেই সীমাকে অতিক্রম না করা এবং ছেলেমেয়েকে দেওয়া শরয়ী অধিকারের বিলকুল খর্ব না করা আর ছেলেমেয়েরও কর্তব্য নিজ অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংযমী হওয়া, অভিভাবকের অভিভাবকত্বের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া সর্বোপরি শভোনতাবোধের পরিচয় দেওয়া

পরবর্তী অংশ=
বিবাহে অভিভাবকের ভূমিকা-২

এ বিষয়ে অন্যান্য পোস্ট সমূহ:
পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে ইসলামে মধ্যমপন্থা ও পরিমিতবোধের গুরুত্ব
বিবাহের ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যমপন্থা ও পরিমিতবোধের গুরুত্ব

1 Comment

  1. Pingback: বিবাহে অভিভাবকের ভূমিকা-২ | ইসলাম বার্তা

Leave a Comment

Your email address will not be published.