পূর্ববর্তী অংশ =
বিবাহে অভিভাবকের ভূমিকা-১
বিয়েটা যেহেতু সন্তানের, স্বামী বা স্ত্রীকে নিয়ে সংসার জীবন সে-ই যাপন করবে এবং উপযুক্ত বিবাহের সুফল ও অনুপযুক্ততার কুফল মূলত সেই ভোগ করবে তাই তার বিবাহে তার নিজের পছন্দ-অপছন্দই মুখ্য এবং তার মতামতই প্রধান। এটাই যুক্তির কথা এবং এ অগ্রাধিকার শরীয়তই তাকে দিয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
الأيم أحق بنفسها من وليها
সাবালিকা মেয়ের নিজ বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার অভিভাবক অপেক্ষা তার নিজেরই বেশি।
(সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪২১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২০৯৮; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২০৯৮)
কাজেই তার যদি কোনো পছন্দ থাকে এবং তা তার পক্ষে অসম না হয়, তবে অভিভাবকের কর্তব্য তার পছন্দকে মূল্য দেওয়া ও তাতে বাধার সৃষ্টি না করা। এমনকি কোনো মেয়ে যদি তার তালাকদাতা প্রাক্তন স্বামীকে ফের বিবাহ করতে চায়, তবে তার ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ অভিভাবককে তাতে বাধ সাধতে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআন মজীদে ইরশাদ-
فَلَا تَعْضُلُوْهُنَّ اَنْ یَّنْکِحْنَ اَزْوَاجَهُنَّ اِذَا تَرَاضَوْا بَیْنَهُمْ بِالْمَعْرُوْفِ ؕ
তারা যদি ন্যায়সঙ্গতভাবে পরস্পর সম্মত হয়, তবে স্ত্রীগণ নিজেদের (প্রাক্তন) স্বামীদেরকে বিবাহ করতে চাইলে তোমরা তাদের বাধা দিও না। (সূরা বাকারা : ২৩২)
অপরদিকে তাদের যদি কোনো সম্বন্ধ পছন্দ না হয়, তবে তা মেনে নিতে বাধ্য করা যাবে না। বিশেষভাবে মেয়েদের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের এ প্রবণতা অতি ব্যাপক। সেই প্রাচীন কাল থেকেই এটা চলে আসছে। এই আধুনিককালেও অভিভাবকদের সে মানসিকতায় খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। অথচ এটা বিলকুল ইসলাম সম্মত নয়। অভিভাবকের যতই পছন্দ হোক না কেন, মেয়ের যদি পছন্দ না হয় তবে সে রকম পাত্রকে মেনে নিতে বাধ্য করার কোনো অধিকার অভিভাবকের নেই। বাস্তবিকপক্ষে যদি অভিভাবকের সিদ্ধান্ত সঠিক হয় এবং মেয়েই অপরিপক্কতার কারণে তা বুঝতে সক্ষম না হয়, তবে সর্বতোপ্রকারে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করা যেতে পারে, কিন্তু চাপ প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। যদি চাপ দিয়ে তার সম্মতি আদায় করা হয় আর এভাবে অপছন্দের পাত্রের সাথে তাকে বিবাহ দেওয়া হয়, তবে পরবর্তীতে সে বিবাহ বলবত রাখা বা নাকচ করার এখতিয়ার পর্যন্ত শরীয়ত তাকে দিয়েছে। হাদীসগ্রন্থসমূহে এরূপ একাধিক ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়, যাতে এ জাতীয় বিবাহে মেয়েকে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল।
যেমন উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, একবার এক তরুণী তাঁর কাছে এসে বলল, আমার বাবা আমাকে তার ভাতিজার সাথে বিবাহ দিয়েছে-উদ্দেশ্য আমার দ্বারা তার হীনাবস্থা ঘুচানো-কিন্তু আমার তাতে সম্মতি ছিল না। উম্মুল মুমিনীন বললেন, তুমি বসো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসুন। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এলে তিনি তাঁকে সে ঘটনা অবগত করলেন। তা শুনে তিনি মেয়েটির বাবাকে ডেকে পাঠালেন। তারপর মেয়েটিকে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার দিলেন।
মেয়েটি বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার বাবা যা করেছেন আমি তা অনুমোদন করলাম। আমার উদ্দেশ্য কেবল নারীদেরকে জানানো যে, এ বিষয়ের ক্ষমতা বাবাদের হাতে নয়।
(সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৫৩৯০; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৮৭৪; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৫০৮৭)
স্বীকার করতে হবে, তরুণী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ছিলেন। একদিকে তিনি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে নালিশ করে জেনে নিলেন এবং নারী সমাজকে সচেতন করে দিলেন যে, নিজ বিবাহের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অগ্রাধিকার বিবাহ যে করবে তারই এবং সে অধিকার কেবল ছেলের জন্য সংরক্ষিত নয়; বরং মেয়ের জন্যও অবারিত। অন্যদিকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ হতে তিনি যখন বিবাহ বহাল রাখা-না রাখার এখতিয়ার লাভ করলেন তখন যে পত্রপাঠ বিবাহ ডিসমিস করলেন তা নয়; বরং সদ্বিবেচনার পরিচয় দিলেন। তিনি পিতার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানালেন। জীবনসঙ্গী ও সুখ-দুঃখের সাথী হিসেবে একদম পছন্দ নয়, কিন্তু তারপরও অভিভাবক হিসেবে পিতাই যেহেতু তাঁকে স্বামী হিসেবে মনোনীত করেছেন, তাই সে মনোনয়নকে খারিজ করে পিতার মর্যাদাকে খাটো করলেন না। তাঁর এ কর্মপন্থা দ্বারাও আমরা ভারসাম্য ও পরিমিতিবোধের শিক্ষা পাই। অর্থাৎ দৃষ্টি একরোখা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। লক্ষ দুদিকেই রাখা চাই। নিজ পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটা যেমন আছে, তেমনি অভিভাবকেরও মর্যাদা আছে। আছে সন্তানকে নিয়ে তার স্বপ্ন। তার প্রতি শুভেচ্ছা ও কল্যাণকামিতা এবং সর্বাপেক্ষা বেশি কল্যাণকামিতা। নিজ পছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে এসব অগ্রাহ্য করলে নিঃসন্দেহে তা চরম একদেশদর্শিতার পরিচায়ক হবে। সন্তান যাতে এ রকম একদেশদর্শী কর্মপন্থা অবলম্বন করে নিজ জীবনে দুর্ভোগ বয়ে না আনে সেজন্য ইসলাম অভিভাবকের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়েছে।
একথা অনস্বীকার্য যে, সন্তানের জন্য স্বামী বা স্ত্রী নির্বাচনে সন্তানের নিজের অপেক্ষা অভিভাবকের বাছাই বেশি সঠিক হয়ে থাকে। কেননা বিয়েটা সন্তানের একান্ত নিজের হলেও সাধারণত তার দৃষ্টি যেহেতু থাকে নেশাচ্ছন্ন এবং কেবল নিজ জীবনের পরিমন্ডলে আর তাও দিক-বিশেষের মধ্যে সীমিত। তাই উপযুক্ত বাছাই তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তা সম্ভব হয় অভিভাবকের পক্ষেই। সন্তানের প্রতি অমিত কল্যাণকামিতার সাথে তার যেহেতু থাকে বাস্তব অভিজ্ঞতা ও বয়সজনিত বিচক্ষণতা, জানা থাকে সন্তানের স্বভাব-চরিত্র ও রুচি-অভিরুচি, সেই সাথে দৃষ্টিতে থাকে প্রসারতা-সন্তানের, নিজের ও পরিবার-খান্দানের পরিমন্ডল ছাড়িয়েও আঞ্চলিক ও কালিক পরিবেশ-পরিস্থিতিতে তা ব্যাপ্ত থাকে তাই তার নির্বাচনও তুলনামূলক বেশি নিখুঁত ও সুষ্ঠু হয়ে থাকে। সুতরাং সন্তানেরই কল্যাণার্থে তার বিবাহের দায়িত্বও ইসলাম অভিভাবকের উপর ন্যস্ত করেছে।
আল্লাহ তাআলার ইরশাদ-
وَ اَنْکِحُوا الْاَیَامٰی مِنْكُمْ
তোমাদের মধ্যে যারা আয়্যিম (অর্থাৎ যে পুরুষের স্ত্রী ও যে নারীর স্বামী নেই-বিবাহিত, বিপত্নীক, বিধবা যাই হোক না কেন) তাদের বিবাহ সম্পন্ন কর। (সূরা নূর : ৩২)
কুরআন-হাদীসের এ নির্দেশ সন্তানের বিবাহদানকে অভিভাবকের এক অবশ্যপালনীয় দায়িত্বই সাব্যস্ত করছে না, সেই সঙ্গে অভিভাবকত্বের ব্যাপারটা যে বিবাহের এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ তারও জানান দিচ্ছে। কাজেই এ গুরুত্বকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। অভিভাবকের প্রতি অর্পিত দায়িত্বকে যদি সন্তান নিজের হাতে নিয়ে নেয় এবং নিজেই নিজের বিবাহ সম্পন্ন করে ফেলে তবে সে গুরুত্বকে খাটো করা হয় না কি? এবং তাতে কি খর্ব করা হয় না অভিভাবকের শরীয়ত-প্রদত্ত মর্যাদা? তাই তো অভিভাবকবিহীন বিবাহ যেন সত্যিকারের শরীয়তী বিবাহই নয়।
হাদীস সতর্ক করছে, অভিভাবক ছাড়া বিবাহ নেই।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২০৮৫; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১০১)
অর্থাৎ ইসলাম যে বিবাহের ব্যবস্থা দিয়েছে তাতে অভিভাবকেরও একটা ভূমিকা আছে। সে ভূমিকাকে অগ্রাহ্য করে যে বিবাহ হবে তা বৈধতার বিচারে উত্তীর্ণ হলেও একটা অনুষঙ্গ বাদ পড়ায় ত্রুটিযুক্ত বিবাহ হবে এবং অভিভাবকের জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতের সংশ্লিষ্টতা না থাকার ফলে তা বহুবিধ কল্যাণ ও বরকত থেকে বঞ্চিত থাকবে। যে কোনও কাজে বড়দের সংশ্লিষ্টতা বরকতপূর্ণ হয়ে থাকে।
হাদীসে আছে, বরকত তোমাদের বড়দেরই সাথে।
(মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস : ২১০; মুজামে আওসাত, তবারানী, হাদীস : ৮৯৯১; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস : ১১০০৪)
অপর বর্ণনায় আছে, কল্যাণ রয়েছে তোমাদের বড়দের সাথে। (মুসনাদে বাযযার)
বিবাহ যেহেতু জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় এবং কেবল নিজের ভবিষ্যত জীবনই নয়, পরিবার, খান্দান ও পরবর্তী প্রজন্মের স্বার্থও এর সাথে জড়িত থাকে তাই এক্ষেত্রে কল্যাণ ও বরকতকে ছোট করে দেখার কোনো উপায় নেই। কল্যাণ-বরকতহীন বিবাহ সংশ্লিষ্ট সকলের পক্ষেই মসিবতের কারণ। তাই তো বিবাহের পর বরকতের জন্য দুআ করা হয়-
بَارَكَ اللهُ لَكَ وَبَارَكَ اللهُ عَلَيْكَ وَجَمَعَ بَيْنَكُمَا بِخَيْرٍ
আল্লাহ তাআলা তোমাকে এ বিয়েতে বরকত দান করুন, বরকত দিন তোমার সত্ত্বায় এবং তোমাদের দাম্পত্যকে কল্যাণময় করুন।
(জামে তিরমিযী, হাদীস : ১০৯১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২১৩০)
তো কল্যাণ ও বরকতের স্বার্থেই বিবাহে অভিভাবকের সংশ্লিষ্টতা জরুরি। অভিভাবকবিহীন বিবাহ যে কল্যাণময় হয় না তা কেবল যুক্তিতর্কের বিষয় নয়; বরং এমনই এক বাস্তবতা, যা চারদিকে নজর দিলে যে কারও চোখে পড়বে। এমনকি এজাতীয় বিবাহ টেকসইও হয় না। ক্রমবর্ধমান বিবাহবিচ্ছেদের এটাও একটা বড় কারণ। কাঁচাবুদ্ধির বন্ধন তো পরিপক্ক হওয়ারও কথা নয়। বিশেষত যে সকল মেয়ে অভিভাবককে এড়িয়ে এ পথে ঝাঁপ দেয়-যে কি না স্বভাবতই আবেগপ্রবণ ও কোমলমতি, জীবন ও জগতের ঘোরপ্যাচ সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, তাদের আবেগতাড়িত বন্ধন যেন বালির বাঁধ। আকছারই টেকে না।
সেই সতর্কবাণীই হাদীসে উচ্চারিত হয়েছে, যে কোনো নারী তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিবাহ করে, তার বিবাহ বাতিল বাতিল বাতিল।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ২০৮৩; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১১০২)
অর্থাৎ অসম বিবাহ হলে তো অভিভাবক আদালতের মাধ্যমে তা নগদই বাতিল করাতে পারে আর যদি অসম নাও হয় তবু তা অতি ক্ষণস্থায়ী হয়। নানাবিধ অসংগতির কারণে সাধারণত বিচ্ছেদই হয় তার পরিণতি।
সারকথা সন্তান ও অভিভাবক উভয়কেই পারস্পরিক দায়িত্ব ও অধিকারের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। অভিভাবককে চিন্তা করতে হবে বিবাহটা যেহেতু সন্তানের তাই মতামতের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার তারই। কাজেই তার অমতে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না এবং নিজ সিদ্ধান্তকে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। অন্যপক্ষে সন্তানকেও অভিভাবকের মর্যাদা রক্ষা করতে হবে, তাঁর স্বপ্ন ও শুভাকাঙ্ক্ষাকে মূল্যায়ন করতে হবে এবং নিজেরই স্বার্থে তার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান-প্রজ্ঞাকে কাজে লাগানোর সুযোগ দিতে হবে।
অর্থাৎ মতামত দানের অগ্রাধিকার যেমন সন্তানের, তেমনি সন্তানের বিবাহ সম্পাদনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের দায়িত্ব অভিভাবকের!
এটাই মধ্যপন্থা এবং এতেই বরকনেসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কল্যাণ ।
মধ্যপন্থা ও পরিমিতবোধের অন্যান্য লিখা:
আয় ব্যয় এর ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ
মোহর নির্ধারণে ইসলামে মধ্যমপন্থা ও পরিমিতবোধের গুরুত্ব