মাযহাব বিরোধীরা কী বলতে চান?

মাযহাব অনুসরণ মুসলিম উম্মাহর একটি কর্মধারা। মুসলিম উম্মাহর এই সর্বসম্মত কর্মধারার (মাযহাব অনুসরণ) বিরুদ্ধে সর্ব প্রথম দলবদ্ধ আওয়াজ  ওঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের সাড়ে বারশো বছর পরে। আর তা-ও এই উপমহাদেশে এবং ইংরেজদের শাসনামলে, যাদের রাজ্য-শাসনের পলিসিই ছিল Devide and rule “বিভিদ সৃষ্টি কর এবং রাজ্যশাসন কর”।

এই বিরোধী আওয়াজটির হাকীকত বড়ই অস্পষ্ট অথবা সীমাহীন স্ববিরোধিতার এক সমষ্টি। আমি আমাদের দেশের গায়রে মুকাল্লিদ ভাইদের (যারা নিজেদেরকে  আহলে হাদীস নামে পরিচয় দেন) অনেক পুস্তিকা ও লিফলেট পড়েছি, তাদের নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শুনেছি, কারো কারো  সাথে আলোচনাও হয়েছে কিন্তু এসব কিছুর পরও তাদের বিভ্রান্তি বা অসাধুতাই আমার সামনে পরিস্ফুট হয়েছে।

এরা তাকলীদ করা বা মাযহাব মানাকে না-জায়েয, হারাম এমনকি শিরক পর্যন্ত বলে থাকে । তাদের কেউ কেউ বলে, সাধারণ মানুষের জন্য তাকলীদ জায়েয়, আলেমদের জন্য না-জায়েয। কেউ বলে, তাকলীদ জায়েজ তবে নির্র্দিষ্ট কোন ইমামের তাকলীদ না-জায়েয। আবার কেউ ‘মাযহাব মানা ফরয নয়’ এটুকু বলে চুপ করে থাকে। ‘ফরয না হলে কী?- এ কথা আর বলে না।

এখানে আমি এইসব ভ্রান্ত কথাগুলোর বিস্তারিত ‌পর্যালোচনা করতে চাই না, বা তার প্রয়োজনও নেই কেননা এ বিষয়ে দলীল-প্রমাণ সমৃদ্ধ, যথোপযুক্ত আলোচনা বক্ষ্যমান গ্রন্থেই রয়েছে। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই যে, তাকলীদ বিরোধী লোকদের বিভিন্ন বই-পুস্তক অদ্যায়ন করে এবং তাদের বেশ কিছু ক্যাসেট শুনে এ বিষয়টিই জানা গেছে যে, তারা-

১.‘তাকলীদে’র পরিচয় দেয় “অন্ধ অনুসরণ” দ্বারা

২. তাদের মতে কারো দলীল বিহীন কথাকে শর্তহীনভাবে মেনে নেওয়ার নাম তাকলীদ। চাই কথাটি কুরআন-হাদীসের অনুকুলে হোক বা কুরআন-হাদীস পরিপন্হী।

৩. তাদের বক্তব্য হল, মুকাল্লিদগণ তাদের ইমামদেরকে “মাসূম”- ভুল-ত্রুটির উর্দ্ধে মনে করে। অর্থাৎ তারা যেন ইমামগণকে রাসূলের স্হানে পৌছে দিচ্ছে।

এ ধরনের আরো কিছু কথা তারা বলে যার সাথে  তাকলীদকারী বা মাযহাব অনুসরণকারীদের কোনই সম্পর্ক নেই। আমরা নিজেরাও মুকাল্লিদ, ফিকহে হানাফীর তাকলীদ করি। ঐসব বন্ধুরা তাকলীদের যে অর্থ করেছেন এবং মুকাল্লিদদের অবস্হার যে চিত্র অংকন করেছেন এর সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আমরা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম ছাড়া আর কাউকে মা‘সুম ভুল-ত্রুটির উর্দ্ধে মনে করি না। ইমাম আবু হানীফা রহ. কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন উম্মতী এবং তাঁর শরীয়তের খাদেম মনে করি। তাঁর ফিকগের অনুসরণ আমরা এজন্যই করি যে,  আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শরীয়তের হুকুম  আহকাম জানার জন্য ফকীহগণের শরনাপন্ন হওয়ার আদেশ করেছেন।

ইমাম আবু হানীফা রহ. এর কোন কথা যদি শরীয়তের দলীল দ্বারা ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে আমরা কী ভাবে কুরআন-হাদীসের  বিরোধিতা করে তাঁর তাকলীদ করলাম। আমরা  তো কুরআন-হাদীসের সত্যিকার অনুসরণের জন্যই, নিজের “কাঁচা বুঝের” উপর নির্ভর না করে উম্মাহর সর্বজন স্বীকৃত ফকীহ ইমাম আবু হানীফা রহ. এর ফিকহের অনুসরণ করছি।

মোট কথা, মাযহাব এবং ফিকহের হাকীকত সম্পর্কে এই নিবন্ধের শুরুর দিকেই আলোচনা করা হয়েছে। তাকলীদ-বিরোধীগণ যদি এই অর্থেই “তাকলীদ” বা “ফিকহে”র বিরোধিতা করে থাকেন তাহলে বাস্তবিকই মুকাল্লিদদের সাথে তাদের বিরোধিতা হতে পারে, কিন্তু তাকলীদ বা মাযহাবের এমন অর্থ বয়ান করা যে অর্থ তাকলীদ ও মাযহাব ভুল প্রমাণিত হয় এরপর অন্যায়ভাবে তা মুকাল্লিদদের মাথায় চাপিয়ে দেওয়া, এসব কাজের কোন বৈধতা হতে পারে কি? না কি তাদের ইদ্দেশ্যই হলো মুসলিম জাতির মধ্যে বিভেদ ও অণেক্য ছড়ানো। এটা অবশ্য এই বাস্তবতা বিরোধী বয়ান-বক্তৃতার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে!

আমরা সেই সব বন্ধুদের খেদমতে আরয করতে চােই; আপনারা তাকলীদ এবং ফিকহের সেই পরিচয় নিয়ে একবার ভাবুন যা ইতিপূর্বে  উল্লেখ করা হয়েছে। এবং যে নিয়ম অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহর বৃহৎ অংশের আমল চলে আসছে এরপর বলুন, এ ধরনের তাকলীদ বা এই অর্থে মাযহাব মানার ব্যাপারে আপনাদের কোন আপত্তি আছে কি না? যদি থাকে তাহলে কেন? এইটাই হবে যৌক্তিক ও ন্যায় সংগত  পন্হা। শুধু শুধু নিজেদের পক্ষ থেকে একটি মতবাদ তৈরী করে তা  কারো কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে এরপর মনের সুখে তার খন্ডনে নিমগ্ন হওয়া তো কোন ন্যায় সংগত পন্হা হতে পারে না। আর না এধরণের কাজে  লিপ্ত হওয়া কোন হাদীস-অনুসরণকারী মুসলমানের শোভা পায়।

বন্ধুবর্গের খেদমতে শুধু একটাই প্রশ্ন করতে চাই, যে সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য আমরা উম্মাহর ফকীহগণের সংকলিত ফিকহের শরণাপন্ন হয়েছি, এই সমস্যাগুলোর সমাধান আপনারা কীভাবে করেন? শুধুই নিজের মত ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে? না পরবর্তী যুগের কোন আলেমের ‘বুঝে’র উপর নির্ভর করে? না তৃতীয় কোন পথ অবলম্বন করে? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবুন এরপর ইনসাফের সাথে বলুন, ফিকহের অনুসরীরাই সরল-সঠিক পথের উপর আছেন না আপনারা?

আর একটি বিষওয়ও ভাবুন, মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশব্যক্তি এবং আপনাদের মধ্যে  মত পার্থক্যটি হচ্ছে হাদীস-অনুসরণের পন্হা ও পদ্ধতি নিয়ে। আপনারা এই ব্যাপারে একটি নব-আবিষ্কৃত কর্ম-পন্হা অবলম্বন করতে চান আর মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশ মানুষ থাকতে চান সুন্নাহ-নির্দেশিত পন্হার উপরই। হাদীস অনুসরণের মূল কথাটিতে তো কারো কিান দ্বিমত নেই্ তাহলে এই গোটা মুসলিম জাতির বিপরীতে আপনারা কীভাবে নিজেদেরে ‘আহলে হাদীস’ নামে পরিচয় দেন আর তাদের আখ্যা দেন হাদীস অমান্যকারী রূপে। হাদীস অনুসরণের পন্হা ও পদ্ধতি নিয়ে যে মতবিরোধ, আপনারা কোন যুক্তিতে তাকে খোদ হাদীস অনুসরনের মতবিরোধ সাব্যস্ত করেন? আল্লাহর ওয়াস্তে একটু ভাবুন, এবং কোন হানাফী মাযহাবের অনুসারীকে তাওবা করিয়ে গায়রে মুকাল্লিদ বানানোর এই রা-জায়েয বা অন্তত অর্থহীন কর্মকান্ড পরিত্যাগ করে অমুসলিম ও মুশরিকদেরকে মুসলমান বানানোর চেষ্ঠা করুন। কিন্তু যদি আপনারাও আপনাদের কোন কোন বে-ইলম অনুসারীর মত হানাফী থেকে গায়রে মুকাল্লিদ হওয়াকে কাফের থেকে মুসলমান হওয়ার সমর্থক মনে করেন তাহলে তো এসবকথা আপনাদেরকে বলাও একটা অর্থহীন পরিশ্রমই হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের হেফাযত করুন এবং ইসলামের এই দুর্দিনে বহুধা বিভক্ত উম্মতকে একত্রিত ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার তাওফীক দেন।
আমীন।

সংগ্রেহে: ভূমিকা, “মাযহাব ও তাকলীদ কি ও কেন”

এবষিয়ে অন্যাণ্য লিখাসমূহ:

মাযহাব কী এবং তাকলদি কাকে বলে?

তাকলীদ কি?

Leave a Comment

Your email address will not be published.