মোহর নির্ধারণে ইসলামে মধ্যমপন্থা ও পরিমিতবোধের গুরুত্ব

মোহর নির্ধারণে মধ্যমপন্থা:

বিবাহের ক্ষেত্রে আরও একটি উল্লেখযোগ্য বাড়াবাড়ি হয়ে থাকে মোহর নির্ধারণে। এর মূল কারণ মোহরের হাকীকত সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং তারও গোড়ার কারণ, শুরুতে যা বলে এসেছি, বিবাহকে কেবল পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা। বিবাহের একটা পারলৌকিক মহিমা আছে আর সে জন্য নর-নারীর দাম্পত্য জীবন মধুময় হওয়া, পারস্পরিক সম্পর্ক ভক্তি-শ্রদ্ধাপূর্ণ হওয়া এবং একে অন্যের প্রতি আন্তরিক ও বিশ্বস্ত থাকা একান্ত জরুরি। মোহর নির্ধারণ মূলত সে লক্ষ্যেই। অর্থাৎ এটা স্বামীর পক্ষ হতে নববধুকে প্রদত্ত নজরানা। যে-কোন মর্যাদাবান ব্যক্তির সাথে সাক্ষাতকালে তার মর্যাদার নিদর্শনস্বরূপ সেলামী-নজরানা পেশ করা হয়ে থাকে। এর ফলে উভয় পক্ষে হৃদ্যতা সৃষ্টি হয়। হাদীসেও আছে, ‘তোমরা পরস্পরে উপহার বিনিময় কর, তাতে পরস্পরে মহববত সৃষ্টি হবে।’ স্ত্রী হচ্ছে স্বামীর জীবন-সংগিনী। তার উষর জীবনের সঞ্জিবনী ও দীর্ঘ চলার পথের সহচরী। এমন আপনার ও মর্যাদাবান তার আর কতজন আছে? সুতরাং দর্শনী পাওয়ার হক যদি কারও থাকে তা স্ত্রীরই আছে। খোদ শরীআতই এ হক তার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, এমনকি বিবাহকালে যদি তা ধার্য করা নাও হয়, তবুও আপনা-আপনিই তা ধার্য হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে মাহরুল-মিছল অর্থাৎ স্ত্রীর খান্দানভুক্ত তার মত নারীদের অনুরূপ মোহর তার প্রাপ্য হয়।
সারকথা মোহর কোন বিনিময়মূল্য নয় যে, এর দ্বারা স্বামী তার স্ত্রীকে কিনে নেয়; বরং এটা তার শরীআতপ্রদত্ত মর্যাদার স্বীকৃতি। এ স্বীকৃতি প্রদান ব্যতিরেকে বিবাহই হয় না। সুতরাং মোহরকে গুরুত্বের সাথেই দেখতে হবে। কোনওক্রমেই এর মহিমাকে খাটো করার অবকাশ নেই।

পরিতাপের বিষয় হল মোহরের এ গুরুত্ব সমাজের চোখে বলতে গেলে আর অবশিষ্ট নেই। এটাও এখন বাণিজ্যীকরণের শিকার। এ নিয়ে বড় দর কষাকষি। এ ব্যাপারে দুই পক্ষ দুই প্রান্তিক মানসিকতা পোষণ করে। পাত্রপক্ষ চায় মোহর কত কম দিয়ে পারা যায়। পাত্রীপক্ষের জিদ থাকে সর্বোচ্চ পরিমাণের। এই দর কষাকষিতে অনেক সময় বিবাহই ভেংগে যায়। আবার অনেক সময় উভয় পক্ষই সর্বোচ্চ পরিমাণে একমত হয়ে যায় কেবল বাহাদুরি ফলানোর লক্ষে। মোটকথা মোহরের ক্ষেত্রে শিথিলতা ও বাড়াবাড়ি দু’ রকম প্রান্তিকতাই ব্যাপক। মধ্যপন্থা অবলম্বনের লোক বড় কম।

যারা মাহ্র কম দিতে চায় তারা একটি হাদীসের মতলবি ব্যবহার করে। বলা হয়েছে-

إن أعظم النكاح بركة أيسرة مؤنة

যে বিবাহে খরচা কম হয়, তাই বেশি বরকতপূর্ণ হয়।’ (শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস : ৬৫৬৬) তারা খরচা কম বলতে প্রয়োজনীয় খরচারও সংকোচন বোঝাতে চায়। কিন্তু এটা একটা মারাত্মক বিভ্রান্তি। এর দৃষ্টান্ত হল নামাযের সংক্ষেপণ। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আদেশ রয়েছে, ‘ইমাম যেন নামায হালকা করে। যেহেতু তার পেছনে অসুস্থ, বৃদ্ধ ও বিশেষ প্রয়োজন-ব্যস্ত লোক থাকে।’
এ নির্দেশের ছলে অনেকে নামাযকে ইচ্ছামত সংক্ষেপ করে নিয়েছে। ব্যস যত তাড়াতাড়ি পার আদায় করে নাও, যেহেতু হাদীসের নির্দেশ। অথচ চিন্তা করে না অতটা ব্যস্তমমস্ত আদায়ের ফলে নামাযের প্রাণবস্ত্ত খুশূ’-খুযূ’ই নষ্ট হয়ে যায় এবং নামাযের রূপ-শোভা সুন্নত-মুস্তাহাব বাদ পড়ে যায়। ফলে মুসল্লী নামাযের কাঙ্খিত সুফল হতেও বঞ্চিত থেকে যায়। হাদীস দ্বারা মূলত বোঝানো উদ্দেশ্য সুন্নত-মুস্তাহাব ও আদাব রক্ষা করার পর যেন নামাযকে আরও দীর্ঘ করা না হয়। মুসল্লীদের সুবিধার্থে সুন্নত-মুস্তাহাবও ছেড়ে দিতে বলা হয়নি।

অনুরূপ বিবাহে খরচা কম করার মানে এ নয় যে, মোহরের পরিমাণ নির্ধারণে স্ত্রীর মর্যাদার বিষয়টাকেও অগ্রাহ্য করা হবে। বরং তার অর্থ হচ্ছে স্ত্রীর যথাযথ মর্যাদা রক্ষার সাথে স্বামীর পক্ষে যা আদায় করা সহজ সেই পরিমাণ মোহরের ধার্য করা।
সহজের প্রতি লক্ষ করতে গিয়ে যদি স্ত্রীর মর্যাদাকে উপেক্ষা করা হয় এবং এতটা কম মাহ্র ধার্য করা হয়, যা স্ত্রীর পক্ষে সম্মানজনক নয়, তবে তা স্ত্রীর মর্যাদাই খর্ব হয় না, মোহর ধার্যকরণের শরয়ী বিধানটিরও মহিমা ক্ষুণ্ণ হয় এবং বিধানটির কাঙ্খিত সুফলও হয় ব্যাহত। সূচনাতেই যে স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি যথাযথ মর্যাদা প্রদর্শন করতে পারল না, পরবর্তীতে উচ্ছ্বাসে যখন ভাটা পড়বে, সেই সঙ্গে যুক্ত হবে নানারকম পারিপার্শ্বিকতা, তখন তার পক্ষ হতে মর্যাদাপূর্ণ আচরণের কতটুকু আশা রাখা যায়? এ অবহেলাকে আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন একজন মানুষ কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। কম-বেশি আত্মসম্মানবোধ সব মানুষেরই আছে। বিশেষত অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন নিয়ে যে নারী জীবনের নতুন সফরের সঙ্গীরূপে কাউকে বরণ করল, তার পক্ষে তো এরূপ অন্যায্যতা সুখকর হতে পারে না। এতে যে ধাক্কা সে খায় তাতে তার পরবর্তী গতি আর স্বচ্ছন্দ হয় না, অন্ততপক্ষে ছন্দময় তো নয়ই। একধরনের জড়তা ও কুণ্ঠাভাব উভয়ের দিক থেকেই থেকে যায়, যা তাদের পরস্পর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠার পক্ষে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

তাই বলি, মোহর নির্ধারণে একরোখাভাবে সহজতার প্রতি দৃষ্টি না রেখে পাত্রীর মর্যাদাকেও বিবেচনায় রাখা বাঞ্ছনীয়। উভয় পক্ষ হতেই উভয়ের প্রতি ন্যায্যদৃষ্টি কাম্য। এটাই মোহর নির্ধারণের মধ্যপন্থা। মোহরের কাঙ্খিত সুফল এরই মাধ্যমে পাওয়া যায়। একদিকে সাধ্যানুযায়ী হওয়ার কারণে তা পরিশোধ সহজ হয়, অন্যদিকে স্ত্রীর পক্ষে সম্মানজনক হওয়ার কারণে তার অন্তরে এটা রেখাপাত করবে, সে এর মূল্যায়ন করবে এবং স্বামীর প্রতি স্বচ্ছন্দ হবে। এভাবে পরিমিত মাহ্র নব দম্পতির মধ্যে মাধুর্যপূর্ণ সম্পর্কের ভিত রচনা করবে।

এর বিপরীত প্রান্তিকতা হল মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে মোহর নির্ধারণ। এটা যেমন পাত্রীপক্ষের জেদের কারণে হয়, তেমনি ক্ষেত্রবিশেষে পাত্রপক্ষেরও তাতে আগ্রহ থাকে। এরূপ মোহর আকছার পরিশোধ করা উদ্দেশ্য থাকে না। উদ্দেশ্য কেবলই নাম ফলানো ও বাহাদুরি দেখানো এবং ক্ষেত্রবিশেষে পাত্রপক্ষকে বেকায়দায় ফেলা। অর্থাৎ নিয়তই সহীহ নয়। আমলের সুফল পাওয়ার জন্য নিয়ত সহীহ থাকা তো শর্ত। এখানে নিয়ত যখন সহীহ নয়, তখন মোহরের কাঙ্খিত সুফলেরও আশা রাখা যায় না; বরং কুফল অনিবার্য।

সবচে’ বড় কুফল তো এই যে, হাদীসের ভাষ্যমতে যে ব্যক্তি মোহর আদায়ের নিয়ত রাখে না, সে ব্যভিচারীরূপে মারা যাবে’ কি কঠিন সতর্কবাণী! বিবাহ করা সত্ত্বেও যদি ব্যভিচারী সাব্যস্ত হতে হয়, সে বিবাহের সার্থকতা কি? আর যদি আদায়ের নিয়ত থাকেও, তবু পরিমাণ ভারী হওয়ার কারণে আদায় করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়। এর পরিণাম দাঁড়ায় স্ত্রীর প্রতি বিতৃষ্ণা। মনে মনে তাকে দুষতে থাকে যে, তার কারণে এত বড় একটা দায় আমার মাথায় চেপে আছে। ফলে স্ত্রীর প্রতি সে আন্তরিক হতে পারে না, যার প্রকাশ আচার-আচরণেও ঘটতে থাকে। পরিণামে দাম্পত্য জীবন হয়ে পড়ে যন্ত্রণাময়। সে যন্ত্রণা থেকে মুক্তির জন্য যদি তালাকই অনিবার্য হয়ে পড়ে তখনও অতিরিক্ত মোহর সে পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। স্ত্রী হাজার বার মুক্তি চাইলেও মোহর পরিশোধের ভয়ে স্বামী তাকে তালাক দিতে প্রস্ত্তত হয় না। আর স্ত্রী না চাইলেও স্বামী নিজের পক্ষ থেকেও যে তালাক দিয়ে নিস্তার পাবে ওই একই কারণে তা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অগত্যা উপায় থাকে দু’টি। হয় তা পরিশোধ করে সর্বস্বান্ত হও, নয়ত সেই দুর্বিষহ জীবনের বোঝাই বয়ে বেড়াও যাবৎ না কোনও একজনের মৃত্যু ঘটে। এরূপ ক্ষেত্রে অনাকাঙ্খিত কোন দুর্ঘটনা ঘটাও বিচিত্র নয়। তখন তো ‘খাসিরাদ-দুনয়া ওয়াল-আখিরাহ’ (দুনিয়া-আখিরাত সবই বরবাদ)। সেক্ষেত্রে সেই দুর্ঘটনাজনিত দুর্ভোগ ছাড়াও মোহর অনাদায়ের দায় তো থেকেই যায়, যা আখিরাতে তার আমল থেকে কেটে নেওয়া হবে। মোটকথা অতিরিক্ত মোহর নির্ধারণের কুফল দু’ চারটি নয়। তার রয়েছে সুদীর্ঘ তালিকা। কাজেই মোহর নির্ধারণে অবশ্যই মাত্রাজ্ঞানের পরিচয় দিতে হবে। মনে রাখতে হবে মধ্যপন্থা সবক্ষেত্রেই কল্যাণকর।

এ বিষয়ে অন্যাণ্য লিখা সমূহ

বিবাহের ক্ষেত্রে ইসলামে মধ্যমপন্থা ও পরিমিতবোধের গুরুত্ব

Leave a Comment

Your email address will not be published.