সহীহ দলিলের আলোকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামায-২

নামাজ আদায়

পূর্বের অংশ:
সহীহ দলিলের আলোকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামায-১

১০. তাআওউয ও তাসমিয়াহ (আউজুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ) পড়ার পর  সূরা ফাতেহা পড়তেন।

১১. সূরায়ে ফাতেহা সমাপ্ত হলে আমীন বলতেন।

১২. আমীন কি উচ্চস্বরে বলতেন, না অনুচ্চস্বরে:
আস্তে কেরাতের নামাযে অনুচ্চস্বরে বলতেন। উম্মাহর কর্মধারা তা-ই প্রমাণ করে। কিন্তু উচ্চস্বরে কেরাআতের নামাযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল কী ছিলো এর ব্যাপারে বর্ণনা বিভিন্ন ধরনের। সহীহ হাদীসে উভয়টিই পাওয়া যায়, তবে বিভিন্ন আলামত ও লক্ষণ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, অনুচ্চস্বরে বলাই তার মূল রীতি ছিল; তবে আমীন বলা শিক্ষা দেয়ার জন্য কখনো কখনো উচ্চস্বরেও বলেছেন। (ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ ১/২৬৬, কুনুত ফিল ফজর এর আলোচনায়) ইমাম ইবনে জারীর তবারী (রহ.) লেখেন-

والصواب أن الخبرين بالجهربها و المخافتة صحيحان وعمل بكل من فعليه جماعة من العلماء وإن كنت مختارا خفض الصوت بها اذ اكثر الصحابة و التابعين على ذلك
সঠিক কথা হলো, উচ্চস্বর ও অনুচ্চস্বর উভয় ধরনের হাদীসইও সহীহ এবং তাঁর প্রত্যেক কর্মই একদল আলেমের মাধ্যমে অনুসৃত হয়েছে, যদিও আমার নিকট অনুচ্চস্বরে বলাই বেশী পছন্দনীয়। কেননা অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ীর আমল এরূপই ছিল। (তাহযীবুল আসার, আল জাওহারুন নাকী ফির-রাদ্দি আলাল বায়হাকী২/৫৮)

১৩. সূরায়ে ফাতেহার পরে অন্য কোন সূরা পড়তেন। তবে ফরয নামাযের তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাআতে ফাতেহার পরে কোন সূরা পড়েছেন বলে কোন প্রমান পাওয়া যায় না। (ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ ১/ ২৩৯)

১৪. কেরাত তারতিলের সাথে পরিষ্কার করে পড়তেন
কখনো অনেক দীর্ঘ কেরাত পড়তেন এবং কখনো সফর ইত্যাদির কারণে অতি সংক্ষিপ্ত কেরাত পড়তেন। সাধারণত মাঝারি ধরনের কেরাত পড়তেন।(ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ ১/২০২)
হযরত আবু বারযাহ আসলামী (রাযি.) এর বর্ণনা মতে ফজরের নামাযে ষাট থেকে একশ আয়াত পড়তেন।
হযরত জাবের ইবনে সামুরা (রাযি.) বলেন, নবীজী ফজরের নামাযে সূরা কাফ এবং এ জাতীয় সূরা পড়তেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস-৪৫৮(১৬৯) মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২০৩৩২)
এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সাধারণত ফজরের নামায়ে তিওয়ালে মুফাসসাল সূরাসমূহ পড়তেন।
যোহরের নামাযে কখনো দীর্ঘ কেরাত পড়তেন এবং কখনো সূরা আলা ও সূরা গাশিয়া বা (এই পরিমাণ) পড়তেন। কোন কোন সহীহ হাদীসে দুই রাকাতে সূরা আলিফ-লাম-মীম সেজদা এর সমপরিমাণ (যা ত্রিশ আয়াতসম্বলিত) পড়ার কথা বর্ণিত হয়েছে।
আসরের কেরাত যোহরের কেরাতের প্রায় অর্ধেক হত (যদি যোহরের কেরাআতকে দীর্ঘ ধরা হয়) বা তার সমান হত (যদি যোহরের কোরাআত মাঝারি ধরা হয়)। (ইবনুল কায়্যিম , যাদুল মাআদ ১/২০৩)
মাগরিবের নামাযে মুফাসসাল-এর সূরাসমূহ পড়তেন, তবে সর্বদা এমন করতেন না। কেননা মাগরিবের নামাযে বড় সূরা যথা: সূরা সফফাত, হা-মীম, দুখান, মুরসালাত ও আলা ইত্যাদি পড়াও বর্ণিত আছে। (ইবনুল কায়্যিম , যাদুল মাআদ ১/২০৩-২০৫, আযযইলায়ী, নাসবুর রায়া ২/৫-৬)
বিভিন্ন বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয যে, ইশার নামাযে আওসাতে মুফাসসাল এর সূরাসমূহ পড়তেন। একবার হযরত মুআয (রাযি.) ইশার নামাযে অনেক দীর্ঘ কেরাআত পড়লে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, যখন ইমামত করবে তখন-

والليل اذا يغشى – اقرأ باسم ربك – سبح اسم ربك الاعلى – والشمس وضحاها
ইত্যাদি সূরা পড়বে। কেননা তোমার পেছনে বৃদ্ধ, দুর্বল কোন প্রযোজনে গমনকারী ব্যক্তিরাও নামায পড়ে থাকে। (সহীহ বুখারী , হাদীস ৭০১-৭০৫, সহীহ মুসলিম ২/ ৩৭৮,৩৮১, হাদীস ৪৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৩০৭; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৯৯৭-৯৯৮)
জুমআর দিন ফজরের নামাযে সূরা আলিফ লাম মীম তানযীল ও সূরা দাহর পড়তেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস -৮৯৯১; সহীহ মুসলিম হাদীস ৮৮০)
জুমআর নামাযে কখনো প্রথম রাকাতে সূরা আলা ও দ্বিতীয় রাকাতে সূরা গাশিয়া পড়তেন।
দুই ঈদের নামাযে কখনো প্রথম রাকাতে সূরা আলা ও দ্বিতীয় রাকতে সূরা গাশিয়া পড়তেন এবং কখনো সূরা কাফ ও সূরা কামার পড়তেন।
তবে উপরোক্ত বর্ণনাসমূহের উদ্দেশ্য এই নয় যে, নামাযের কেরাত উল্লেখিত সূরাসমূহের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কেননা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাযি.) বলেন, মুফাসসালের ছোট বড় কোন সূরা এমন নেই যা আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ফরয নামাযে পড়তে শুনিনি। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস-৮১৪) বরং মুফাসসালের বাইরে কুরআনে কারীমের অন্যত্র থেকে পড়াও সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে।

১৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইমামগণকে বিশেষভাবে মুকতাদীদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখার আদেশ করতেন। তিনি ইরশাদ করনে-
اذا صلى احدكم للناس فليخفف فان فيهم الضعيف السقيم والكبير واذا صلى لنفسه فليطول ما شاء
“যখন তোমাদের কোন ব্যক্তি অন্যের ইমামতি করবে তখন সে যেন কিরাত সংক্ষেপ করে। কেননা তাদের মধ্যে দুর্বল, অসুস্থ ও বৃদ্ধ ব্যক্তি থাকে এবং যখন সে একাকী নামায পড়বে তখন যে পরিমাণ দীর্ঘ করতে চায় করবে”। (সহীহ বুখারী, হাদীস-৭০৩, সহীহ মুসলিম ২/ ৩৮৩-৩৮৪ হাদীস ৪৬৮)
একবার কোন ব্যক্তি নবীজীর নিকট অভিযোগ করল যে, অমুক ইমাম খুব দীর্ঘ কেরাআত পড়েন, যার কারণে আমি হয়ত জামাতে শরীক হতে পারবো না। তিঁনি তা শুনে অত্যন্ত রাগান্বিত হলেন এবং বললেন-
يا ايها الناس ! إن منكم منفرين فايكم ام الناس فليوجز فان من وراءه الكبير والضعيف وذا الحاجة (والمريض)
“হে লোক সকল! তোমাদের মধ্যে কতক ব্যক্তি এমন আছে, যারা মানুষের আগ্রহ নষ্টকারী। তোমাদের কেউ যখন ইমামতি করবে তখন সে যেন সংক্ষেপ করে। কেননা তার পেছনে বৃদ্ধ, দুর্বল, প্রয়োজনে গমনকারী (ও অসুস্থ ) ব্যক্তি থাকে। (সহীহ বুখারী , হাদীস ৯০, সহীহ মুসলিম২/৩৮২ হাদীস ৪৬৬)

১৫. তিনি ইমামের পেছনে ফাতেহা বা অন্য কোন সূরা পড়ার আদেশ কখনো করেননি। (ইবনে তাইমিয়্যা , মাজমাউল ফাতাওয়া ২৩/৩১৫.৩২০)
তিনি বলেছেন- من كان له امام فقراءة الامام له قراءة
যে ব্যক্তির ইমাম আছে ইমামের কেরাআতই তার কেরাআত হবে।
আরো বলেছেন- اذا صليتم فاقيموا صفوفكم ثم يؤمكم احدكم فاذا كبر فكبروا واذا قرأ فانصتوا واذا قال غير المغضوب عليهم ولا الضا لين فقولوا امين يجبكم الله
“যখন তোমরা নামাযে দাঁড়াও তখন কাতার সোজা করা। এরপর তোমদের একজন ইমাম হও। যখন সে তাকবীর বলে তখন তোমরাও তাকবীর বল; যখন সে কেরাত পড়ে তখন তোমরা চুপ থাক; যখন সে غير المغضوب عليهم ولا الضا لين (গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম) বলে তখন তোমরা আমীন বল, আল্লাহ তোমাদের দু‘আ কবুল করবেন”। (সহীহ মুসলিম-৪০৪, সহীহ আমি আওয়ানা২/ ১৩২-১৩৩)
কোন কোন বর্ণনায় অনুচ্চস্বরে কেরাআতের নামাযে ফাতেহা পড়ার শুধু অনুমতি বর্ণিত হয়েছে। তবে সে সব বর্ণনার ব্যাপারে অনেক হাদীস বিশারদের আপত্তি রয়েছে। (ইবনে তাইময়া, মাজমুউল ফাতাওয়া ২২/৩৪০; কাশ্নীরী , ফাসলুল খিতাব ফি ফাতিহাতিল কিতাব)

১৬. ফজরের উভয় রাকাত, মাগরিব, ইশার প্রথম দুই রাকাত, জুমআ, দুই ঈদ, ইস্তিসকা (বৃষ্টির নামায) ও সূর্যগ্রহণের নামাযে তিনি উচ্চস্বরে কেরাত পড়তেন। অন্যান্য ক্ষেত্রে অনুচ্চস্বরে পড়তেন। তাহাজ্জুদের নামাযে সাধারণত কিছুটা উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করতেন।

১৭. ফজরের নামাযে সাধারণত প্রথম রাকাত দ্বিতীয় রাকাতের তুলনায় দীর্ঘ করতেন (যাতে মুকতাদীরা পুরো জামাআত পায়) এবং যোহর আসরেও এমন করতেন। তবে যোহর আসরের উভয় রাকাতের কেরাআত সমান হওয়ার কথাও সহীহ হাদীসে রয়েছে।
(সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৭৯ ইলাউস সুনান ৪/২৪-২৬)

পরবর্তী অংশ:

সহীহ দলিলের আলোকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামায-৩
সহীহ দলিলের আলোকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামায-৪

1 Comment

  1. Pingback: সহীহ দলিলের আলোকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নামায-১ | ইসলাম বার্তা

Leave a Comment

Your email address will not be published.