ইসলামে সন্তানের কল্যাণকামনা

যার সন্তান হয় না তাকে জিজ্ঞেস করুন, সন্তানহারা মাকে জিজ্ঞেস করুন, সন্তান আল্লাহর কত বড় নেয়ামত। নিঃসন্তান মা সন্তানের জন্য কত ব্যাকুল,

সন্তানহারা মা সন্তানের শোকে কতটা ব্যাথিত। আল্লাহ তাআলা বান্দাকে এই নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যাতে বান্দা কৃতজ্ঞ হয়।

لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ إِنَاثًا وَيَهَبُ لِمَنْ يَشَاءُ الذُّكُورَ * أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَإِنَاثًا وَيَجْعَلُ مَنْ يَشَاءُ عَقِيمًا إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ

(তরজমা) আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর আধিপত্য আল্লাহ্রই। তিনি যা ইচ্ছা তা-ই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন, অথবা দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা তাকে করে দেন বন্ধ্যা; তিনি সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। (সূরা শুরা ৪২ : ৪৯-৫০)

কিন্তু এ নেয়ামত হাতে পাওয়ার পর অনেক বান্দা ভুলে যায় যে, সন্তান আল্লাহর পক্ষ হতে তার হাতে সোপর্দকৃত এক আমানত। ফলে আল্লাহর বাতলানো পথ রেখে এ নেয়ামতের ব্যবহার করে নিজের খেয়াল-খুশি মত। আমি আমার সন্তানকে এই বানাবো সেই বানাবো, নিজের মত করে গড়ে তুলবো ইত্যাদি।

প্রতিটি মা-বাবাই নেক সন্তান চান। আল্লাহ ইবরাহীম আলাইহিস সালামের যবানে আমাদেরকে নেক সন্তান প্রার্থনার দুআ শিখিয়েছেন

رب هب لى من الصالحين

হে আল্লাহ, আমাকে নেক সন্তান

দান কর।

আলকুরআনুল কারীমে আরেকটি দুআ এসেছে। সেটা হল, সন্তান, পরিবার পরিজন যেন হয় মুত্তাকী ও চক্ষুর শীতলতা :

رَبَّنَا هَبْ لَنَا مِنْ أَزْوَاجِنَا وَذُرِّيَّاتِنَا قُرَّةَ أَعْيُنٍ وَاجْعَلْنَا لِلْمُتَّقِينَ إِمَامًا

(তরজমা) হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করুন যারা হবে আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর এবং আমাদেরকে করুন মুত্তাকীদের ইমাম (অনুসরণযোগ্য)। (সূরা ফুরকান (২৫) : ৭৪)

আর সন্তানের মাঝে ঈমান ও ইসলামকে গ্রহণ করার এবং ভাল ও নেক হওয়ার স্বভাবজাত যোগ্যতা দিয়েই আল্লাহ দুনিয়াতে পাঠান। ইরশাদ হয়েছে, অর্থ: প্রতিটি শিশুই ফিতরতের (ঈমান ও ইসলামকে গ্রহণ করার যোগ্যতার) উপর জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু বাবা-মা তাকে খৃষ্টান, অগ্নিপূজক বা ইহুদী বানায়। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৬৫৮)

শিশু কাদা মাটির খামিরা। তাকে যে ছাঁচে ঢালা হবে সে তাই হবে। ইটের ছাঁচে ইট কলসি বানালে কলসি। কিন্তু কখনো এর ব্যাতিক্রমও হয়। সঠিক ছাঁচে দেওয়ার পরও কোনো কারণে নষ্ট হয়ে যায়। ইটওয়ালার দায়িত্ব হলো সঠিক ছাঁচে ঢেলে ইটটিকে পূর্ণতাদানে ত্রুটি বা অবহেলা না করা।

সন্তান যেহেতু আমার হাতে আল্লাহর আমানত সুতরাং আমাকে ভাবতে হবে, আমি কি এ আমানতের যথেচ্ছ ব্যবহারের অধিকার রাখি? বিশেষত এই আমানতকে কি আল্লাহর নাফারমানীর পথে এগিয়ে দিতে পারি? যদি এমনটি করি তা হবে এ আমানতের খেয়ানত, এ নেয়ামতের না-শুকরি। আর নেয়ামতের না-শুকরির পরিণাম বড় ভয়াবহ।

(তরজমা) স্মরণ কর, তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেন, যদি তোমরা কৃতজ্ঞ হও তাহলে আমি বাড়িয়ে দিব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও (তাহলে জেনে রেখ) অবশ্যই আমার আযাব বড়ই কঠিন। (সূরা ইবরাহীম (১৪): ৭)

দুনিয়ার পরিণামের অনেক নযীর আমাদের চোখের সামনে। আর আখেরাতের পরিণাম….?  এ ব্যাপারে তো কোন সন্দেহ নেই, সন্তানকে যদি আল্লাহর পথ না দেখাই তাহলে প্রিয়তম সন্তানই কাল কেয়ামতের দিন আল্লাহর আদালতে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করবে, আমাকে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিবে।

সেদিন পথভ্রষ্টরা পথভ্রষ্টকারীদের বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে মামলা দায়ের করে বলবে, (তরজমা) হে আমাদের প্রতিপালক! যেসব জিন ও মানব আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল তাদেরকে দেখিয়ে দিন, আমরা তাদেরকে পদদলিত করব, যাতে তারা লাঞ্ছিত হয়। (সূরা হা-মীম আস্সাজদা (৪১) : ২৯)

আমার কারণে যদি কেউ পথভ্রষ্ট হয় (আমি বাবা-মা হই আর সমাজপতি হই) তাহলে রোজ হাশরের আদালতে আমাকেও এই অভিযোগের  সম্মুখীন হতে হবে। আমরা আল্লাহ্র পানাহ্ চাই।

প্রতিটি মা-বাবাই সন্তানের কল্যাণ কামনা করেন। প্রত্যেকেই আপন দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সন্তানের কল্যাণকামনা করেন। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি  সঠিক না হওয়ার কারণে অনেক সময় দেখা যায় সন্তান দুনিয়ার কল্যাণ তো লাভ করে কিন্তু আখেরাতের কল্যাণের বিষয়ে হয় হতবঞ্চিত। সন্তানের কল্যাণকামনা হতে হবে দুনিয়া ও আখেরাতের। যেমনটি আল্লাহ আলকুরআনুল কারীমে একটি দুআর মাধ্যমে শিখিয়েছেন-

رَبَّنَا آَتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآَخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ

(তরজমা) হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের দুনিয়াতে কল্যাণ দাও এবং আখেরাতে কল্যাণ দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা কর। (সূরা বাকারা (২): ২০১)

এ আয়াতের দুআ আমাদের জন্য উত্তম শিক্ষা। দুনিয়াকে পূর্ণ বর্জন করে আখেরাত নয় আবার দুনিয়ার মোহে পড়ে আখেরাত বরবাদ নয়। বরং কল্যাণময় দুনিয়া কল্যাণময় আখেরাত। আর এটিই সন্তানের কল্যাণকামনা ও আল্লাহর আমানত রক্ষার মানদন্ড। এখন দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানের কল্যাণ সামনে রেখে সন্তানকে গড়ে তুলতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে প্রাধান্য পাবে আখেরাত। উভয় দিকের লাভ ক্ষতি যখন সামনে আসবে প্রাধান্য দিতে হবে আখেরাতের লাভ ক্ষতিকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমরা প্রাধান্য দিই দুনিয়াকে। আল্লাহ সে বিষয়ে আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছেন।

(তরজমা) কিন্তু তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকে প্রাধান্য দাও। অথচ আখেরাতই উৎকৃষ্টতর এবং স্থায়ী। (সূরা আ‘লা (৮৭): ১৬-১৭)

সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে আরো সতর্ক হওয়া দরকার। নইলে আখেরাতের আদালতে প্রিয়তম সন্তান আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে; আমার মা-বাবা আমার বিষয়ে ইনসাফ করেনি। আমার দুনিয়ার লাভ ক্ষতিকে আখেরাতের উপর প্রাধান্য দিয়েছে বা আমার বাবা মা আমাকে শুধু দুনিয়া শিখিয়েছে আখেরাতের বিষয়ে আমাকে কোনো প্রকার নির্দেশনা দেয়নি।

আখেরাতের ওই ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা না হয় না-ই বললাম। দুনিয়াতেই তো সন্তান তার (উন্নত থেকে উন্নততর সফলতা না পাওয়ার উপর) মা-বাবাকে দায়ী করে; আপনারা যদি আমাকে ওখানে ভর্তি করতেন বা অমুক কোর্সের ব্যবস্থা করতেন কিংবা অমুক বিষয়ে পড়াতেন তাহলে  আজ আমার এই বেহাল দশা হত না, আমার ক্যারিয়ার আরো সুন্দর হত ইত্যাদি।

উপরে আলোচিত যে আয়াতে দুনিয়া ও আখেরাত উভয়টির কল্যাণের দুআর কথা এসেছে তার আগের আয়াতের ভাষ্য হল, যে  শুধু দুনিয়া চাইবে সে কেবল দুনিয়াই পাবে আখেরাতে তার কোনো হিস্সা নেই।

(তরজমা) কিছু মানুষ আছে যারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে দুনিয়াতেই দাও, বস্ত্তত আখেরাতে তাদের জন্য কোন অংশ নাই। (সূরা বাকারা (২): ২০০)

অনেক বাবা-মা দেখা যায় ফজরের সময় সন্তানকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলছেন স্কুলে যাওয়ার জন্য, ফজরের নামাজের জন্য নয়। সামনে পরীক্ষা তাই সন্তানের ইচ্ছা সত্ত্বেও রোজা রাখতে দিচ্ছেন না ইত্যাদি। সন্তানের কল্যাণকামনায় এই প্রান্তিকতা তার চিরস্থায়ী অকল্যাণ বয়ে আনে। সুতরাং আখেরাতকে প্রাধান্য দিয়ে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণকামনাই হবে সন্তানের প্রকৃত কল্যাণকামনা। এ দৃষ্টিকোণ থেকেই সন্তানের শিক্ষা, সংস্কৃতি, জীবন-জিবিকা, পোশাক-পরিচ্ছদ, পরিবেশ-পারিপার্শিকতা নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।

Leave a Comment

Your email address will not be published.