সালাতুল জানাযায় কি সূরা ফাতিহা জরুরি?-১

সেদিন গাজীপুর থেকে এক মসজিদের ইমাম ছাহেব ফোন করে জানালেন,তাঁর এলাকায় গত কয়েকদিন আগে এক ব্যক্তির ইন্তেকাল হয়। ঘটনাক্রমে সেই সময় তিনি এবং এলাকার অন্যান্য ইমাম উপস্থিত না থাকায় এক গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধু জানাযার নামাযে ইমামতি করেন। নামায শেষে তিনি এলাকার মুসুল্লীদের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দেন ‘এতদিন যত জানাযার নামায পড়েছেন কোনোটাই হয়নি। কেননা জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া ফরয। যেহেতু এতদিন এই ফরযের উপর আমল হয়নি তাই কোনো জানাযার নামাযই সহীহ হয়নি। তার এই বক্তব্যে সেই এলাকায় ব্যাপক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে।

অথচ জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়া ফরয হওয়া তো অনেক দুরের বিষয় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন এ মর্মে কোনো সহীহ হাদীস আছে বলে আমাদের জানা নেই। এ প্রসঙ্গে হাফেয ইবনুল কায়্যিম রাহ.-এর একটি উক্তি উল্লেখ করা যায়, যাকে আমাদের ঐ বন্ধুরাও নিজেদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব বলে দাবি করে থাকেন। তিনি বলেছেন:

ويذكر عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه أمر أن يقرأ على الجنازة بفاتحة الكتاب ولا يصح إسناده

অর্থ: নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-থেকে উল্লেখ করা হয় যে, তিনি জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এর সনদ সহীহ নয়।
-যাদুল মা‘আদ ১/৪৮৬

মূলত জানাযার নামায সাহাবায়ে কেরাম মৌখিক বর্ণনার পরিবর্তে প্রায়োগিক পদ্ধতিতেই নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বেশি হাসিল করেছেন। পরবর্তীতে তা‘আমুল এবং তাওয়ারুছের মাধ্যমে তাবেয়ীগণ সাহাবাদের থেকে তা হাসিল করেছেন। আর সাহাবা-তাবেয়ীগণ এবং খাইরুল কুরূনের ব্যাপক কর্মধারা সামনে রাখলে বুঝা যায় যে, তাঁদের অধিকাংশই জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়তেন না। আমরা প্রথমে সাহাবীদের তারপর তাবেয়ীদের কিছু আছার নিচে উল্লেখ করছি।

(১) খলীফায়ে রাশেদ হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা.-এর আমল

قال ابن أبي شيبة : حدثنا محمد بن فضيل عن العلاء بن المسيب عن أبيه عن علي أنه كان إذا صلى على ميت يبدأ يحمد الله ويصلى على النبي صلى الله عليه وسلم ثم يقول : اللهم اغفر لأحيائنا و أمواتنا وألف بين قلوبنا وأصلح ذات بيننا واجعل قلوبنا على قلوب خيارنا .

অর্থ: হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন কোনো মায়্যেতের জানাযার নামায পড়তেন তখন প্রথমে আল্লাহর প্রশংসা করতেন তারপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পড়তেন অতপর এই বলে দুআ করতেন :

اللهم اغفر لأحيائنا وأمواتنا وألف بين قلوبنا وأصلح ذات بيننا واجعل قلوبنا على قلوب خيارنا.

-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১১৪৯৪

এই বর্ণনার রাবীগণ সকলেই নির্ভরযোগ্য। এই আছর দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, হযরত আলী রা. জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়তেন না

(২) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর আমল

مالك عن نافع أن عبد الله بن عمر كان لا يقرأ في الصلاة على الجنازة

অর্থ: নাফে রাহ. বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়তেন না
-মুয়াত্তা মালিক, হাদীস ৫২৩; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১১৫২২

এই আছরটিও বিশুদ্ধতম সনদে বর্ণিত। এখানেও স্পষ্টভাবে বলা হল, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. জানাযার নামাযে কুরআন পড়তেন না।

(৩) হযরত আবু হুরায়রা রা.-এর আমল এবং তালীম

ما لك عن سعيد بن أبي سعيد المقبري عن أبيه أنه سأل أبا هريرة كيف تصلي على الجنازة؟ فقال أبو هريرة أنا لعمر الله أخبرك أتبعها من أهلها فإذا وضعت كبرت وحمدت الله وصليت على نبيه ثم أقول اللهم إنه عبدك وابن عبدك وابن أمتك كان يشهد أن لا إله إلا الله وأن محمدا عبدك ورسولك وأنت أعلم به اللهم إن كان محسنا فزد في إحسانه وان كان مسيئا فتجاوز عن سيئاته اللهم لا تحرمنا أجره ولا تفتـنا بعده.

অর্থ: আবু সাঈদ মাকবুরী থেকে বর্ণিত, তিনি হযরত আবু হুরায়রা রা.-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কীভাবে জানাযার নামায পড়েন? আবু হুরাইরা রা. বললেন, আল্লাহর কসম অবশ্যই আমি তোমাকে বলব। আমি মায়্যেতের (ঘর থেকে) পরিবারের সাথে আসি। অতপর যখন মায়্যেতকে রাখা হয় আমি তাকবীর দেই এবং আল্লাহর প্রশংসা করি। তারপর নবীর উপর দরূদ পড়ি। অতপর এই দুআ করি… اللهم।

-মুয়াত্তা মালেক, হাদীস ৫২১; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৬৪২৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১১৪৯৫

এই আছরেরও সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। এখান থেকেও বোঝা গেল, হযরত আবু হুরায়রা রা. জানাযার নামাযে কুরআন পড়তেন না

(৪) উবাদা ইবনে ছামিত রা.-এর ফরমান

عن أبي هريرة أنه سأل عبادة بن الصامت عن الصلاة على الميت فقال أنا والله أخبرك تبدأ فتكبر ثم تصلي على النبي صلى الله عليه وسلم، وتقول اللهم إن عبدك فلانا كان لا يشرك بك شيئا، أنت أعلم به، إن كان محسنا فزد في إحسانه وإن كان مسيئا فتجاوز عنه، اللهم لا تحرمنا أجره ولا تضلنا بعده.

অর্থ: হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত যে, তিনি উবাদা ইবনে ছামিত রা.-কে জানাযার নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! অবশ্যই আমি তোমাকে বলব, তুমি সর্বপ্রথম তাকবীর দিয়ে নামায শুরু করবে। অতপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর দরূদ পড়বে এবং এই দুআ পড়বে … اللهم

-সুনানে কুবরা বায়হাকী ৪/৪০

উল্লেখ্য : জানাযার নামাযে ফাতিহা পাঠ প্রমাণ করার জন্য গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুগণ হযরত উবাদা ইবনে ছামিত রা.-এর সূত্রে বর্ণিত এ প্রসিদ্ধ হাদীস উদ্ধৃত করে থাকেন-

لا صلاة لمن لم يقرأ بفاتحة الكتاب.

‘যে ফাতিহাতুল কিতাব পড়েনি তার নামায নেই।’-সহীহ বুখারী, হাদীস ৭৫৬

অথচ উপরোক্ত বর্ণনায় পাওয়া গেল যে, স্বয়ং উবাদা ইবনুস সামিত রা.-ই জানাযার নামায ফাতিহা ছাড়া পড়ার নিয়ম জানতেন ও মানতেন। সাহাবী আবু হুরায়রা রা.-এর প্রশ্নের উত্তরে তিনি এই নিয়মেরই উল্লেখ করেছেন। আবু হুরায়রা রা.-ও এ নিয়ম জানতেন ও মানতেন। ইতিপূর্বে তাঁর বিবরণও উল্লেখিত হয়েছে। আবু হুরায়রা রা. থেকেও সহীহ মুসলিমে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ হাদীস বর্ণিত হয়েছে-

لا صلاة إلا بقراءة

(কুরআন) পড়া ছাড়া নামায নেই। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৩৯৬

এর পরিষ্কার অর্থ এই যে, তাঁরা ‘সালাতুল জানাযা’কে এই হাদীসের বিধানের অন্তর্ভুক্ত মনে করেন না। বরং এ পর্যন্ত উল্লেখিত বড় বড় মনীষী সাহাবীর কর্ম ও সিদ্ধান্ত এবং মুসলিম জাহানের বড় বড় কেন্দ্রগুলোর প্রতিষ্ঠিত কর্মধারাও একথাই প্রমাণ করে যে, ‘সালাতুল জানাযা’ উপরোক্ত হাদীসের নির্দেশনার আওতাভুক্ত নয়। সুতরাং এ হাদীসকে সালাতুল জানাযার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা শুধু দলীলহীন প্রয়োগ নয়; দলীলবিরোধী প্রয়োগ বটে।

সালাতুল জানাযার হাকীকত হচ্ছে এটি দুআ। মাইয়েতের জন্য দুআ। একারণে দুআর ভূমিকা হিসেবে ‘ছানা’ (আল্লাহর প্রশংসা) ও ‘সালাত’ (দরূদ) পাঠ করা হয়। ইমাম মালিক রাহ. বলেছেন-

إنما هو الدعاء

‘এ তো দুআ’-আল মুদাওওয়ানা ১ : ২৫১

আর সালাতুল জানাযা যে সাধারাণ সালাতের মতো নয় এ তো বলাই বাহুল্য। এতে রুকু-সিজদা নেই, কা’দা-তাশাহহুদ নেই। সুতরাং একে সাধারণ সালাতের মধ্যে কীভাবে শামিল করা যায়? এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত তাবেয়ী আবুল আলিয়া রাহ.-এর একটি বাণী মনোযোগের দাবিদার। আবুল মিনহাল বলেন-

سَأَلْتُ أَبَا الْعَالِيَةِ عَنِ الْقِرَاءَةِ فِي الصَّلَاةِ عَلَى الْجِنَازَةِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَقَالَ: “مَا كُنْتُ أَحْسَبُ أَنَّ فَاتِحَةَ الْكِتَابِ تُقْرَأُ إِلَّا فِي صَلَاةٍ فِيهَا رُكُوعٌ وَسُجُودٌ”

আমি আবুল আলিয়া রাহ.-কে সালাতুল জানাযায় ফাতিহা পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি (আশ্চর্য হয়ে) বললেন, আমার তো ধারণাও ছিল না যে, ফাতিহাতুল কিতাব রুকু-সিজদা বিশিষ্ট সালাত ছাড়া অন্য কোনো সালাতে পড়া হবে?! -আলমুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা ১১৫২৪

আবুল আলিয়া রাহ. প্রথম সারির তাবেয়ীগণের অন্তর্ভুক্ত। বিশুদ্ধ মত অনুসারে ৯৩ হিজরীতে তাঁর ইন্তিকাল। (তাহযীবুল কামাল ও তাহযীবুত তাহযীব)

বিখ্যাত হানাফী ফকীহ আল্লামা কাসানী রাহ. (মৃত্যু ৫৮৭ হি.) এ বাস্তবতা এভাবে বর্ণনা করেছেন-

وَقَوْلُهُ عَلَيْهِ السَّلَامُ “لَا صَلَاةَ إلَّا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ” وَلَا صَلَاةَ إلَّا بِقِرَاءَةٍ لَا يَتَنَاوَلُ صَلَاةَ الْجِنَازَةِ؛ لِأَنَّهَا لَيْسَتْ بِصَلَاةٍ حَقِيقَةً إنَّمَا هِيَ دُعَاءٌ وَاسْتِغْفَارٌ لِلْمَيِّتِ، أَلَا تَرَى أَنَّهُ لَيْسَ فِيهَا الْأَرْكَانُ الَّتِي تَتَرَكَّبُ مِنْهَا الصَّلَاةُ مِنْ الرُّكُوعِ وَالسُّجُودِ إلَّا أَنَّهَا تُسَمَّى صَلَاةً لِمَا فِيهَا مِنْ الدُّعَاءِ، وَاشْتِرَاطُ الطَّهَارَةِ، وَاسْتِقْبَالُ الْقِبْلَةِ فِيهَا لَا يَدُلُّ عَلَى كَوْنِهَا صَلَاةً حَقِيقِيَّةً كَسَجْدَةِ التِّلَاوَةِ؛

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী ‘লা সালাতা ইল্লা বিফাতিহাতিল কিতাব’ ও‘লা সালাতা ইল্লা বি কিরাআ’ সালাতুল জানাযাকে শামিল করে না। কারণ মূলত তা ‘সালাত’ নয়। মাইয়েতের জন্য দুআ ও ইস্তিগফার। লক্ষ করুন, যে সকল ‘রোকন’ দ্বারা সালাত যেমন রুকু-সিজদা, তা-ই তো এতে নেই। একে ‘সালাত’ বলা হয় কারণ তা দুআ। আর পবিত্রতা ও কিবলামুখী হওয়া জরুরি হওয়ার দ্বারা তা হাকীকী সালাত হওয়া প্রমাণ হয় না। কারণ ওগুলো তো তিলাওয়াতের সিজদাতেও জরুরি।
-বাদায়েউস সানায়ে ১ : ৩১৪

 

পরবর্তী অংশ:
সালাতুল জানাযায় কি সূরা ফাতিহা জরুরি?-২

Leave a Comment

Your email address will not be published.