সালাতুল জানাযায় কি সূরা ফাতিহা জরুরি?-২

পূর্ববর্তী অংশ:
সালাতুল জানাযায় কি সূরা ফাতিহা জরুরি?-১

পূর্বের আলোচনায় আমরা বেশ কয়েকজন সাহাবীর আছার উল্লেখ করলাম যারা জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়তেন না। এটিই ছিল সাহাবা-যুগের সাধারণ আমল। এ প্রসঙ্গে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর একটি বক্তব্য সম্পর্কেও কিছু আলোচনা করা দরকার, যা গায়রে মুকাল্লিদ বন্ধুরা তাদের ‘দলীল’ হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। আছরটি এই-

عَنْ طَلْحَةَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَوْفٍ، قَالَ: صَلَّيْتُ خَلْفَ ابْنِ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا عَلَى جَنَازَةٍ فَقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الكِتَابِ قَالَ: لِيَعْلَمُوا أَنَّهَا سُنَّةٌ

ত্বলহা ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আওফ রাহ. বলেন- আমি ইবনে আব্বাস রা.-এর পেছনে জানাযার নামায আদায় করেছি। নামাযে তিনি সূরা ফাতিহা পড়েছেন। (নামায শেষে) বলেছেন, (আমি ফাতিহা পড়েছি) যাতে লোকেরা জানতে পারে যে, এটা সুন্নাহ।
-সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৩৫

এ প্রসঙ্গে প্রথম কথা এই যে, স্বয়ং আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে ফাতিহা ছাড়া সালাতুল জানাযার নিয়ম বর্ণিত হয়েছে। তাবেয়ী আবু হামযা রাহ. বলেন-

قلت له : كيف أصلي في الكعبة؟

আমি তাঁকে (ইবনে আব্বাস রা.- কে) জিজ্ঞাসা করলাম, কা‘বার ভিতরে নামায কীভাবে পড়ব? তিনি উত্তরে বললেন-

كما تصلي في الجنازة تسبح وتكبر ولا تركع ولا تسجد ثم عند أركان البيت سبح وكبر وتضرع واستغفر، ولا تركع ولا تسجد

যেভাবে সালাতুল জানাযা পড়; তাসবীহ পড়বে, তাকবীর দিবে, তবে রুকু-সিজদা করবে না। এরপর বাইতের রোকনগুলোর কাছে তাসবীহ করবে, তাকবীর দিবে, রোনাযারি করবে ও ইস্তিগফার করবে। তবে রুকু করবে না ও সিজদা করবে না।
-ফতহুল বারী শরহু সহীহিল বুখারী  ৩ : ৪৬৯

এ বর্ণনার সনদ সহীহ।

লক্ষ্য করুন, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. কুরআন তিলাওয়াতের উল্লেখ করেননি। এখানে মনে রাখতে হবে যে, ইবনে আব্বাস রা. কা‘বার ভিতরে নামায পড়াকে মাকরূহ মনে করতেন। তিনি মনে করতেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কা‘বার ভিতরে নামায পড়া বিষয়ে যে বর্ণনাগুলো আছে তাতে ‘সালাত’ অর্থ দুআ, নামায নয়।

দ্বিতীয় কথা এই যে, ইতিপূর্বে উল্লেখিত সহীহ রেওয়ায়েতসমূহ থেকে জানা যায় যে, জানাযার নামাযে আল্লাহর হামদ-ছানা ও দুআ করা কর্তব্য। তবে এর জন্য কোনো দুআ-কালাম নির্ধারিত করে দেওয়া হয়নি। সুতরাং কেউ যদি সূরা ফাতিহার দ্বারা আল্লাহর হামদ ও দুআ করেন একে বিদআত বলার সুযোগ নেই। সাহাবায়ে কেরামের কারো কারো থেকে বর্ণিত ফাতিহা-পাঠের এ ব্যাখ্যাও হতে পারে। তাহলে সালাফের যুগ থেকে চলে আসা মুসলিম জাহানের সাধারণ কর্ম-ধারা ও বড় বড় মনীষী সাহাবীর কর্ম ও সিদ্ধান্তের সাথে তাদের কর্মের কোনো সংঘাত থাকে না। ইমাম তাহাবী রাহ. বলেছেন-

لعل قراءة من قرأ الفاتحة من الصحابة كان على وجه الدعاء لا على وجه التلاوة.

সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেউ কেউ যে ফাতিহা পাঠ করেছেন বলে পাওয়া যায় সম্ভবত সেটি ছিল দুআ হিসেবে, কুরআন তিলাওয়াত হিসেবে নয়
-উমদাতুল ক্বারী ৮/১৪১

আল্লামা ইবনে বাত্তাল রাহ. বলেন-

وَمِمَّنْ كَانَ لَا يقْرَأ فِي الصَّلَاة على الْجِنَازَة وينكر: عمر بن الْخطاب وَعلي بن أبي طَالب وَابْن عمر وَأَبُو هُرَيْرَة، وَمن التَّابِعين: عَطاء وطاووس وَسَعِيد بن الْمسيب وَابْن سِيرِين وَسَعِيد بن جُبَير وَالشعْبِيّ وَالْحكم، وَقَالَ ابْن الْمُنْذر: وَبِه قَالَ مُجَاهِد وَحَمَّاد وَالثَّوْري، وَقَالَ مَالك: قِرَاءَة الْفَاتِحَة لَيست مَعْمُولا بهَا فِي بلدنا فِي صَلَاة الْجِنَازَة،

যাঁরা জানাযায় ফাতিহা পড়তেন না, বরং ইনকার করতেন, তাঁদের কয়েকজন হলেন- ওমর ইবনুল খাত্তাব, আলী ইবনে আবি তালিব, ইবনে ওমর, আবু হুরাইরা রা.। আর তাবেঈগণের মাঝে তাঁদের কয়েকজন হলেন- আত্বা, তা‘উস, সাঈদ ইবনুল মুসায়্যিব, ইবনে সিরীন, সাঈদ ইবনে জুবায়ের, শা‘বী, হাকাম রহ. প্রমুখ। ইবনুল মুনযির রাহ. বলেছেন, একই মত পোষণ করেছেন মুজাহিদ, হাম্মাদ ও সুফইয়ান ছাওরী রাহ.। ইমাম মালেক রাহ. বলেছেন, জানাযায় ফাতিহা পড়ার ওপর আমাদের শহরে (মদীনা) আমল করা হয় না। (উমদাতুল কারী, ৮ : ১৩৯)

এমনকি প্রায় প্রত্যেক ইসলামী শহরের বড় বড় তাবেয়ী মনীষীও জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার প্রবক্তা ছিলেন না।

(১) মদীনা মুনাওয়ারার বিখ্যাত তাবেয়ী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ সালেম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-কে জিজ্ঞাসা করা হল, জানাযার নামাযে কি (কুরআন) পড়া আছে? তিনি বললেন, ‘জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়া নেই।’ -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৫৩২

(২) মক্কা মুকাররমার বিখ্যাত তাবেয়ী প্রায় দুশো সাহাবীর সাহচর্যধন্য মুহাদ্দিস আতা ইবনে আবী রাবাহ রাহ. জানাযার নামাযে কুরআন পড়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা  ১১৫২৯

(৩) কুফা নগরীর বিখ্যাত তাবেয়ী প্রায় পাঁচশ সাহাবীর সাক্ষাতধন্য প্রসিদ্ধ হাদীস বিশারদ ইমাম আমের ইবনে শারাহীল আশশা‘বী রাহ. বলেন, ‘জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়া নেই’। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা  ১১৫২৮

শা‘বী রাহ. আরো বলেন, ‘জানাযার নামাযের প্রথম তাকবীরে আল্লাহর প্রশংসা করবে, দ্বিতীয় তাকবীরের পরে দরূদ পড়বে, তৃতীয় তাকবীরের পরে মৃত ব্যক্তির জন্য দুআ করবে, চতুর্থ তাকবীর দিয়ে সালাম ফিরাবে’। -মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক  ৬৪৩৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা  ১১৪৯৬

কুফা-নগরীর আরেক তাবেয়ী ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. থেকেও এ নিয়ম বর্ণিত হয়েছে-

قَالَ مُحَمَّدٌ وَأَخْبَرَنَا سُفْيَانُ الثَّوْرِيُّ، عَنْ أَبِي هَاشِمٍ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ النَّخَعِيِّ، قَالَ: الْأُولَى: الثَّنَاءُ عَلَى اللَّهِ، وَالثَّانِيَةُ: صَلَاةٌ عَلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَالثَّالِثَةُ: دُعَاءٌ لِلْمَيِّتِ، وَالرَّابِعَةُ: سَلَامٌ تُسَلِّمُ. قَالَ مُحَمَّدٌ: وَبِهِ نَأْخُذُ. وَهُوَ قَوْلُ أَبِي حَنِيفَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ.

ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. সুফইয়ান ছাওরী হতে, তিনি আবু হাশেম হতে, তিনি ইব্রাহীম নাখাঈ রাহ. হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, প্রথম: আল্লাহ তা‘আলার প্রশংসা করা (ছানা পড়া)। দ্বিতীয়: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাআহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর দরূদ পড়া। তৃতীয়: মায়্যেতের জন্য দু‘আ করা। চতুর্থ: সালাম (ফিরিয়ে শেষ করা)। ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. বলেন, আমরা এটাই গ্রহণ করি। আর এটাই ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর মত। (ইমাম মুহাম্মাদ রাহ., আল-আছার, ২৩৮)

(৪) বসরা নগরীর বিখ্যাত তাবেয়ী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাহ. জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়তেন না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৫২৩; মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৬৪৩২

(৫) ইয়ামানের বিখ্যাত তাবেয়ী প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও ফকীহ তাউস রাহ.-ও জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়ার বিষয়টিকে অস্বীকার করতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১১৫২৯

উল্লেখ্য, ইসলামী উলূমের দুই মারকায মাদীনা মুনাওয়ারা এবং কুফা নগরীতে জানাযার নামাযে কুরআন পড়ার কোনো প্রচলন ছিল না।

মাদীনাবাসীর আমল:

ইমাম মালিক রাহ. বলেন,

ليس ذلك بمعمول به ببلدنا إنما هو الدعاء، أدركت أهل بلدنا على ذلك.

অর্থ: জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়ার কোনো প্রচলন আমাদের এ শহরে (মাদীনায়) নেই। জানাযা হল দুআ করা। আমি আমার শহরের অধিবাসীদের এর উপরেই পেয়েছি। -আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা ১/১৬৭

কুফাবাসীর আমল:

ইমাম তিরমিযী রাহ. বলেন,

وقال بعض أهل العلم : لا يقرأ في الصلاة على الجنازة إنما هو الثناء على الله والصلاة على نبيه صلى الله عليه وسلم والدعاء للميت وهو قول الثوري وغير واحد من أهل الكوفة.

অর্থ: আর কতক আহলে ইলম বলেন : ‘জানাযার নামাযে (কুরআন) পড়া হবে না এ তো শুধু আল্লাহর প্রশংসা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর দরূদ এবং মাইয়েতের জন্য দুআ। এটা সুফিয়ান ছাওরী রাহ. এবং কুফার একাধিক মনীষীর কওল-অভিমত। -জামে তিরমিযী ১০১১ নং হাদীসের অধীনে

উপরের আলোচনায় আমরা বেশ কয়েকজন সাহাবী ও তাবেয়ীর আছর উল্লেখ করলাম যারা কেউই জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার প্রবক্তা নন। সেই সাথে এটাও জানতে পারলাম যে, ইসলামের দুই কেন্দ্রভূমি মদীনা মুনাওয়ারা এবং কুফা নগরীতে জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ার কোনো প্রচলন ছিল না। এতদসত্তে¡ও আমাদের গাইরে মুকাল্লিদ বন্ধুদের এই কথা বলা যে, ‘সূরা ফাতিহা ছাড়া জানাযার নামায হয় না’- বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু নয়।

এটা ঠিক যে, ইবনে আব্বাস রা.সহ দু’একজন সাহাবী জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা পড়েছেন। কিন্তু ‘সূরা ফাতিহা না পড়লে জানাযার নামায হয় না’ এমন কোনো ফাতোয়া তাঁরা দিয়েছেন বলে আমাদের জানা নেই।

ঐ বন্ধুদের ব্যাপারে আমাদের অনুযোগ এটিই যে, তাঁরা সাহাবা-যুগ থেকে চলে আসা একাধিক পদ্ধতি সম্বলিত বিষয়গুলোতে একটি পদ্ধতিকে গ্রহণ করেন এবং অন্য পদ্ধতিকে বাতিল, ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। অথচ জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা না পড়ার নিয়ম খাইরুল কুরূন তথা সাহাবা-তাবেয়ীযুগে ব্যাপকভাবে চর্চিত ও অনুসৃত ছিল। মদীনা মুনাওয়ারা এবং কুফা নগরীতে সূরা ফাতিহা পড়ার কোনো প্রচলনই ছিল না। এতে বোঝা যায় জানাযার নামাযে সূরা ফাতিহা না পড়ার নিয়মটিই অধিক শক্তিশালী।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published.