ফরয সালাতের পর ইজতেমায়ি দোয়া সম্পর্কে ওলামায়ে দেওবন্দের আকিদা

ওলামায়ে দেওবন্দের মত আলোচনা করার আগে সকলকে একটা বিষয় স্পষ্ট করে দেওয়া দরকার যে আহলে হাদীসদের শায়খগণ এ ব্যাপারে ওলামায়ে দেওবন্দের নামে খেয়ানতের সাথে মিথ্যাচার করে আসছে। ওলামায়ে দেওবন্দের বিভিন্ন কিতাব থেকে এক অংশ প্রকাশ করে আলোচনার ফলাফলকে চেপে রাখে। এটা তাদের নতুন কোন পদ্ধতি না। সাধারণ মানুষ যেহেতু বড় বড় আরবী কিতাব মুতালায়া করে তাদের মত যাচাই করতে পারে না তাই দলিলের চিপায় ফেলে সাধারণ মানুষদের আই ওয়াশ করে আসছে। তারা যে অংশটুকু গোপন করে আসল বিষয় সে অংশের মধ্যেই বিদ্যমান থাকে। আলোচনা করতে গিয়ে আমি সে গোপন করা অংশটুকুই প্রকাশ করবো ইনশাল্লাহ।

ফরয সালাতের পর ইজতেমায়ি দোয়া সম্পর্কে ওলামায়ে দেওবন্দের মত
************************************************************************
হযরত মাওলানা ইউসুফ বিন্নোরী (রাহঃ) মুনাযাত সম্পর্কীয় হাদীস উল্লেখ পূর্বক বলেন, –
“মুনাজাত অধ্যায়ে যে সকল হাদীশ পেশ করা হল, এগুলোই যথেষ্ট প্রমান যে, ফরয সালাতের পর সম্মিলিত মুনাজাত জায়িয। এ হাদীস সমূহের ভিত্তিতেই আমাদের ফুকাহায়ে কেরাম উক্ত মুনাজাতকে মুস্তাহাব বলেন।” (মা’আরিফুস সুনান ৩/১২৩)

আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রাহঃ বলেন –
“নামাযের পর মুনাজাত প্রসঙ্গে হাদীস সমূহ ব্যাপকতা সম্পন্ন। এ হাদীস সমূহে মুনাজাতের কোন ক্ষেত্র উল্লেখ নেই। অতএব হাদীস সমূহের ব্যাপকতার ভিত্তিতে নামাযের পর সর্বক্ষেত্রের/ধরনের মুনাযাতই মুস্তাহাব বলে বিবেচিত হবে। মূলভিত্তি সহীহ হাদীসে বিদ্যমান থাকার পর বেদায়াতের প্রশ্নয় উঠে না।” (ফাইযুল বারী ২/ ৪৩১)।

হযরত মাওলানা যাফর আহমাদ উসমানী (রাহঃ) বলেন –
“আমাদের দেশে যে সম্মিলিত মুনাযাতের প্রথা চালু আছে যে, ইমাম কোন কোন নামাযের পর কেবলামুখী বসে দ’য়া করে থাকেন,এটা কোন বেদায়াত কাজ নয় বরং হাদীসে এর প্রমান রয়েছে। তবে ইমামের জন্য উত্তম হল ডানদিক বা বামদিক ফিরে মুনাজাত করা ” (ই’লাউস সুনান ৩/১৬৩)
তিনি আরো বলেন – “হাদীস সমূহের দ্বারা এটা প্রমানিত হল যে প্রত্যেক ফরয সালাতের পর হাত উঠিয়ে দোয়া করা মুস্তাহাব। যেমন আমাদের দেশে এবং অন্যান্য মুসলিম দেশে প্রচলিত আছে।” (ই’লাউস সুনান ৩/১৬৭)

শাইখুল ইসলাম আল্লামা ত্বাকী উসমানি দা,বা বলেন-
“ উভয় দিক বিবেচনার পর সঠিক অবস্থান এটা যে – (ফরয সালাতের পর) ইজতেমায়ি দোয়া সুন্নতও নয় এবং নিষেধ করার মতো বিষয়ও নয়। বরং এটা এবাদাতের বিভিন্ন বৈধ পদ্ধতি হতে একটি (several permissible ways of perforoming supplication)। ” (Contemprary fatwah – 32)

বাংলাদেশের অন্যতম বিদ্যাপিঠ ‘জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া’ এর দারুল ইফতা থেকে প্রকাশিত একটি প্রশ্নের উত্তরে –মুফতী মনসূরুল হক সাহেব দা,বা– হুজ্জত ও উসূলের উপর ভিত্তি করে প্রমান করেছেন ফরয সালাতের পর ইজতেমায়ি দোয়া করা মুস্তাহাব। এরপর তিনি বলেন –
—-“এ সকল বর্ণনা দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, নামাযের পর ইমাম, মুক্তাদী সকলের জন্য সম্মিলিতভাবে মুনাযাত করা মুস্তাহাব। এ মুনাজাতকে বেদায়াত বলার কোন যুক্তিই নেই। কারণ-বিদায়াত বলা হয় সে আমলকে শরীয়তে যার কোন অস্তিত্বই নেই। মুনাজাত সেই ধরনের মূল্যহীন কোন আমল নয়। তবে যেহেতু মুনাজাত ‘মুস্তাহাব আমল’ তাই এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা অনুচিত। মুস্তাহাব নিয়ে বাড়াবাড়ি করা নিষিদ্ধ।
অতএব, কেউ মুনাজাতের ব্যাপারে যদি এমন জোর দেয়, মুনাজাত তরককারীকে কটাক্ষ বা সমালোচনা করতে থাকে, বা মুনাজাত না করলে তার সাথে ঝগড়া ফাসাদ করতে থাকে তাদের জন্য বা সেরূপ পরিবেশের জন্য মুনাজাত করা নিঃসন্দেহে মাকরুহ ও বিদআত হবে। মুনাজাত বিদায়াত হওয়ার এই একটি মাত্র দিক আছে। আর এটা কেবল মুনাজাতের বেলায় নয় বরং সমস্ত মস্তাহাবের বেলায় এ হুকুম। অতএব মুনাজাতও পালন করতে পারবে এবং বেদায়াত থেকেও বাঁচতে পারবে। আর এ জন্য সুষ্ঠ নিয়ম আমাদের জন্য এই যে , মসজিদের ইমাম সাহেবান মুনাজাতের আমল জারী রেখে মুনাজাতের দর্জা সম্পর্কে মুসল্লীগণকে ওয়াজ নসিহতের মাধ্যমে বুঝাবেন এবং ফরয-ওয়াজিব ও সুন্নত মুস্তাহাবের দর্জা-ব্যাবধান বুঝিয়ে দিয়ে বলবেন যে ফরয নামাযের পর মুনাজাত করা যেহেতু মুস্তাহাব সুতরাং যার সুযোগ আছে সে মুস্তাহাবের উপর আমল করে নিবে। আর যার সুযোগ নেই তার জন্য মুস্তাহাব তরক করার অবকাশ আছে। এমনকি কেউ যদি ইমামের সাথে মুনাজাত শুরু করে, তাহলে ইমামের সাথে শেষ করাও জরূরী নয়। কারণ, সালাম ফিরানোর পর ইকতিদা শেষ হয়ে যায়। সুতরাং কেউ চাইলে ইমামের আগেই মুনাজাত শেষ করে দিতে পারে। আবার কেউ চাইলে ইমামের মুনাজাত শেষ হওয়ার পরও দীর্ঘক্ষণ একা একা মুনাজাত করতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা শরীয়তে নিষেধ। এভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার পর ইমাম সাহেবান প্রত্যেক ফরয সালাতের পর দায়িমীভাবে মুনাজাত করলেও তাতে কোন ক্ষতি নেই।” (ফাতওয়ায়ে রাহমানিয়া ১/ ৩২৬- ৩২৭)

বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রধান বিদ্যাপীঠ আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পটিয়া এর প্রধান মুফতী ও মুহাদ্দিস আল্লামা মুফতি হাফেয আহমাদুল্লাহ দোয়ার উপর একটি সতন্ত্র কিতাব লিখেছেন। কিতাবটির নাম “ বিশুদ্ধ হাদীস শরীফ ও ইজমার আলোকে ফরজ নামাযের পর দোয়া ও মুনাজাত…” কিতাবটির ২৩ পৃষ্ঠায় তিনি লেখেন
–– “ সে জন্য আমাদের দেওবন্দের ওলামায়া কেরামের মুরুব্বি হাকিমুল উম্মত মুজাদ্দাদে মিল্লাত আশরাফ আলী থানভী রাহঃ এই মাসয়ালা সম্পর্কে অর্থাৎ ফরজ সালাতের পর সম্মিলিতভাবে, হাত উঠিয়ে দোয়া করা সুন্নত ও মুস্তাহাব হওয়া সম্পর্কে আমাদের চার মাযহাবের ইমামদের ইজমা নকল করত কোরআন হাদীস এবং নির্ভরযোগ্য ফিকাহ ফতোয়ার কিতাবাদি থেকে অনেক দালায়িল একত্রিত করে একটি কিতাব লিখেছেন যার নাম ‘استحباب الدعوات عقيب الصلوات ’ । কিতাবটি কয়েক জায়গায় মুদ্রিত হয়ে ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সবজায়গায় প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তা থানভী রাহঃ এর প্রসিদ্ধ ফতোয়া গ্রন্থ ‘উমদাদুল ফাতওয়া’র প্রথম খন্ডের শেষে যুক্ত করে ছাপানো হয়েছে। এরকম তদানিন্তন অখন্ড ভারতের ফতোয়া বিষারদ মুফতিয়ে আজম হযরত মাওলানা কেফায়াতুল্লাহ সাহেব রাহ” ও ফরয সালাতের পর সম্মিলিত দোয়া ও মুনাজাত মুস্তাহাব হওয়া সম্পর্কে পৃথকভাবে একটি কিতাব লিখেছেন যার নাম ‘النفاءس المرغوبت في مسءلة الدعاء بعد المتو بة’। সে কিতাবটিও অনেকবার মুদ্রিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এরকম আরো বহু দেওবন্দি ওলামায়ে কেরাম এ বিষয়ে উর্দু ও বাংলা ভাষায় অনেক কিতাব লিখেছেন। ” (পৃ-২৩)

আমাদের আহলে হাদীস ভায়েরা দেওবন্দের আলেমদের যে সকল কওল দিয়ে বুঝাতে চায় যে দেওবন্দের আলেমগণ ফরয সালাতের পর ইজতেমায়ি দোয়া করতে নিষেধ করেছেন সে সকল কওল সমূহের মূল কথা হল –
“রসূলুল্লাহ স. বা সাহাবায়ে কিরাম এ আমলটি স্থায়ীভাবে করেছেন মর্মে কোন পরিষ্কার বর্ণনা আমরা হাদীসে খুঁজে পাইনি। তাই হাদীসের মর্মানুসারে ফরয নামাযের পরে হাত উত্তোলন করে ইজতিমাঈ দুআ মাঝে-মধ্যে ছেড়ে দেয়া উত্তম। যাতে সাধারণ মানুয়ের মধ্যেও এ বুঝ সৃষ্টি হয় যে, এটা নফল পর্যায়ের আমল; সুতরাং করা উত্তম হলেও না করাতে কোন দোষ নেই।”

আর আমরা এটা আগেই বলে এসেছি। তবে তারা দেওবন্দের ঐ একই আলেমগণের অন্যমত প্রকাশ করে না। সে মত হল- “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীসগুলো দ্বারা নামাযের পরে দুআ, দুআর সময় হাত উত্তোলন করা, ইজতিমাঈ দুআ, একজন দুআ করা আর অন্যদের আমীন বলা, ঈদের নামাযের পরে সম্মিলিত দুআ, এমনকি সাহাবার আমল দ্বারা ফরয নামাযের পরে ইজতিমাঈ দুআও প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং ফরয নামাযের পরে হাত উত্তোলন করে ইজতিমাঈ দুআকে ভিত্তিহীন বলার কোন সুযোগ নেই।”

তাই শেষ কথা হল এলম গোপন করা তাদের অভ্যাস হতে পারে আমাদের নয়। আমরা এ ব্যাপারে শরীয়তের হুজ্জত ও উসুলের উপর ভিত্তি করে যে এতেদাল নির্ভর মতের উপর আমল করি তা একত্রিত করলে এরকম হয় – “রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম থেকে বর্ণিত হাদীসগুলো দ্বারা নামাযের পরে দুআ, দুআর সময় হাত উত্তোলন করা, ইজতিমাঈ দুআ, একজন দুআ করা আর অন্যদের আমীন বলা, ঈদের নামাযের পরে সম্মিলিত দুআ, এমনকি সাহাবার আমল দ্বারা ফরয নামাযের পরে ইজতিমাঈ দুআও প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং ফরয নামাযের পরে হাত উত্তোলন করে ইজতিমাঈ দুআকে ভিত্তিহীন বলার কোন সুযোগ নেই। রসূলুল্লাহ স. বা সাহাবায়ে কিরাম এ আমলটি স্থায়ীভাবে করেছেন মর্মে কোন পরিষ্কার বর্ণনা আমরা হাদীসে খুঁজে পাইনি। তাই হাদীসের মর্মানুসারে ফরয নামাযের পরে হাত উত্তোলন করে ইজতিমাঈ দুআ মাঝে-মধ্যে ছেড়ে দেয়া উত্তম। যাতে সাধারণ মানুয়ের মধ্যেও এ বুঝ সৃষ্টি হয় যে, এটা নফল পর্যায়ের আমল; সুতরাং করা উত্তম হলেও না করাতে কোন দোষ নেই।”।

আল্লাহ তায়ালা আমাদের বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির থেকে হেফাযত করুন।–আমিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published.