হাদীস ও আছারের আলোকে রমযান : ফাযাইল ও মাসাইল

বছরের অন্যতম ফযীলতপূর্ণ মাস হল রমযান। প্রত্যেক মুসলিমের জীবনে রমযানের গুরুত্ব অপরিসীম। রমযান হল পূণ্য অর্জনের শ্রেষ্ঠ মৌসুম। দীর্ঘ এক মাসের রোযা, তারাবী, তাহাজ্জুদ, কুরআন তেলাওয়াত ও অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নৈকট্য অর্জন করে এবং সব ধরনের গুনাহ থেকে বিরত থেকে অর্জন করে হৃদয় ও আত্মার পরিশুদ্ধি। মাসজুড়ে তাকওয়ার অনুশীলনের মাধ্যমে তৈরি হয় বছরের বাকি দিনগুলো পাপ-পঙ্কিলতামুক্ত থাকার যোগ্যতা। বান্দার এই অনুশীলনকে যথার্থ ও তার সংযমকে স্বার্থক করার জন্য প্রয়োজন যথাযথভাবে এ মাসের বন্দেগীগুলো আগ্রহের সঙ্গে সঠিকভাবে আদায় করা। এ লক্ষ্যেই রমযানকে সামনে রেখে কুরআন হাদীস ও আছারের আলোকে রমযানের কিছু ফাযাইল ও মাসাইল নিম্নে উল্লেখ করা হল। ফাযাইল প্রসঙ্গ রোযার প্রতিদান স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দিবেন রোযা একমাত্র আল্লাহর জন্য। শুধু আল্লাহর ভয়েই বান্দা পানাহার থেকে বিরত থাকে। নইলে পৃথিবীর কোন শক্তি এমন আছে যা তাকে গোপনে এক ঢোক পানি পান করা থেকে বিরত রাখতে পারে? রোযাদার পিপাসায় কাতর হয়, ওযুর জন্য মুখে পানি নেয়, কিন’ এক কাতরা পানি হলকের নিচে নামতে দেয় না। কার ভয়ে, কার মুহাব্বতে? একমাত্র আল্লাহ তাআলার ভয়ে, আল্লাহ তাআলার মুহাব্বতে। কেউ দেখছে না, কিন’ আল্লাহ দেখছেন। কেউ জানছে না, কিন’ আল্লাহ জানছেন। আহা! জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যদি এই অনুভূতি লাভ করতে পারতাম! এজন্যই তো রোযার প্রতিদান দিবেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তাঁর শান অনুযায়ী। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, বনী আদমের প্রতিটি আমলের প্রতিদান বহু গুণে বৃদ্ধি হতে থাকে, ১০ গুণ থেকে ৭০০গুণ, এমনকি আল্লাহ চাইলে তার চেয়েও বেশি দেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তবে রোযার বিষয়টি ভিন্ন। কেননা, রোযা একমাত্র আমার জন্য এবং আমি স্বয়ং এর প্রতিদান দিব। বান্দা একমাত্র আমার জন্য পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণ থেকে বিরত থাকে। রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দ : এক. ইফতারের মুহূর্তে দুই. রবের সঙ্গে সাক্ষাতের মুহূর্তে। আর রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৫১ রোযাদারের জন্য জান্নাতের বিশেষ দরজা হযরত সাহ্ল ইবনে সাদ থেকে বর্ণিত, জান্নাতে রাইয়ান নামে একটি দরজা আছে। এই দরজা দিয়ে শুধু রোযাদাররা প্রবেশ করবে। ঘোষণা করা হবে, রোযাদাররা কোথায়? তখন তারা উঠে দাঁড়াবে। যখন তাঁরা প্রবেশ করবে তখন ঐ দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং তা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করবে না।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৮৯৬ অন্য রেওয়াতে আছে, জান্নাতে একটি দরজা আছে, যার নাম রাইয়ান। শুধু রোযাদারগণ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। আর যে তাতে প্রবেশ করবে সে কখনো পিপাসার্ত হবে না।-জামে তিরমিযী ৭৬৫; ইবনে মাজাহ : ১৬৪০ রোযা রোযাদারের জন্য সুপারিশ করবে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘রোযা এবং কুরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, আমি তাকে দিনের বেলায় পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা মেটানো থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন। কুরআন বলবে, আমি তাকে রাতে ঘুম থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং আমার সুপারিশ কবুল করুন। তখন দু’জনের সুপারিশই গ্রহণ করা হবে।-মুসনাদে আহমদ হাদীস : ৬৫৮৯; তবারানী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/৪১৯ রোযাদারের দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তিন ব্যক্তির দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না : ১. রোযাদারের দুআ ইফতার করা পর্যন- ২. ন্যায়পরায়ণ বাদশাহের দুআ ও ৩. মাজলুমের দুআ। আল্লাহ তাআলা তাদের দুআ মেঘমালার উপরে উঠিয়ে নেন এবং এর জন্য আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেওয়া হয়। আর আল্লাহ তাআলা বলেন, আমার ইজ্জতের কসম! বিলম্বে হলেও আমি অবশ্যই তোমাকে সাহায্য করব।- মুসনাদে আহমদ হাদীস : ৯৭৪৩; জামে তিরমিযী হাদীস : ৩৫৯৮; ইবনে হিব্বান হাদীস : ৩৪২৮; ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৭৫২ রোযাদারের জন্য মাগফিরাতের পুরষ্কার পূর্ণ এক মাস বান্দা রোযা রাখল। প্রতিদিন ঘোষণা হচ্ছিল, ‘কে আছ ক্ষমাপ্রার্থী, আমার কাছে ক্ষমা চাও। আমি ক্ষমা করে দিব।’ মাস শেষ। বান্দা তার মালিকের হুকুম পালন করেছে। এবার তাঁর পক্ষ থেকে আসছে ক্ষমার ঘোষণা। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় রমযানের রোযা রাখবে আল্লাহ তাআলা তার পূর্বের সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০১; জামে তিরমিযী হাদীস : ৬৮৩; ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৩২৬ সেহরী ও ইফতার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সেহরী খাও, সেহরীতে বরকত রয়েছে।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯২৩; সহীহ মুসলিম হাদীস : ১০৯৫ অন্য হাদীসে আছে, আমাদের রোযা ও আহলে কিতাবীদের রোযার মাঝে পার্থক্য হল সেহরী খাওয়া (আমরা সেহরী খাই তারা খায় না)।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ১০৯৬ শেষ ওয়াক্তে সেহরী খাওয়া সুন্নত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার উম্মত কল্যাণের মাঝে থাকবে যতদিন তারা সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করবে ও শেষ ওয়াক্তে সেহরী খাবে।-মুসনাদে আহমদ ৫/১৭৪ হাদীস : অন্য হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেহরী খাওয়া ও আযানের মাঝের সময়ের ব্যবধান ছিল পঞ্চাশ আয়াত তেলাওয়াত পরিমাণ।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯২১; সহীহ মুসলিম হাদীস : ১০৯৬ ইফতারের সময় দুআ কবুল হয় ইফতারের সময় হওয়ার কিছু পূর্বেই দস-রখানে বসা উচিত। কত সুন্দর দৃশ্য! সামনে কত রংবেরঙের খাবার, কিন’ বান্দা সেদিকে হাত বাড়াচ্ছে না শুধু রবের অনুমতির অপেক্ষায়। আহা! দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতিও যদি রবের অনুমতি ছাড়া হাত না বাড়াতাম! ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে বেশি বেশি দুআ ও ইসি-গফার করা উচিত। হাদীস শরীফে এসেছে, ইফতারের সময় রোযাদারের দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।-ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৭৫৩ এই হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ রা. ইফতারের সময় নিম্নোক্ত দুআ পড়তেন : অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আপনার ঐ রহমতের ওছিলায় প্রার্থনা করছি, যা সকল বস’তে পরিব্যাপ্ত, আমাকে ক্ষমা করে দিন।-ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৭৫৩; আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলাহ হাদীস : ৪৮১ হযরত আয়েশা রা.কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শবে কদরে পড়ার জন্য একটি দুআ শিখিয়েছেন। শেষ দশকের রাতে এই দুআ বেশি বেশি পড়া উচিত। ইফতারের পূর্বেও তা পড়া যায়। অর্থ : ‘হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল। ক্ষমা করতে ভালবাস। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও। প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেওয়া হয় হযরত জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, প্রতিদিন ইফতারের সময় অসংখ্য জাহান্নামীকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং এটা প্রতি রাতে।-ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৬৪৩ সময় হওয়ার সাথে সাথে ইফতার করুন হাদীস শরীফে আছে, মানুষ যতদিন সময় হওয়ার সাথে সাথে দ্রুত ইফতার করবে ততদিন তারা কল্যাণের মাঝে থাকবে।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ১০৯৮; জামে তিরমিযী হাদীস : ৬৯৯ ইফতারের দুআ ‘পিপাসা নিবারিত হল, শিরা উপশিরা সতেজ হল আর সওমের ছাওয়াব প্রাপ্তির খাতায় লিখিত হয়ে গেল।-সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ২৩৫৭; আমালুল ইয়াওমি ওয়াল লাইলা হাদীস : ৪৭৮ ‘হে আল্লাহ! আপনার সন’ষ্টির উদ্দেশ্যেই রোযা রেখেছি এবং আপনার দেওয়া রিযিক দিয়ে ইফতার করছি।-সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ২৩৫৮ খেজুর বা পানি দিয়ে ইফতার শুরু করুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন কেউ ইফতার করে সে যেন খেজুর দ্বারা ইফতার করে। কেননা, তা বরকতের খাদ্য। যদি তা না থাকে তাহলে পানি দ্বারা। কেননা তা পবিত্র বস’।-জামে তিরমিযী হাদীস : ৬৯৫; সুনানে আবু দাউদ হাদীস : ২৩৫৫ কীভাবে রমযান মাসকে অধিক ফলপ্রসূ করা যায় রমযান মাসের সর্বোত্তম আমল যে রোযা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ রোযার ব্যাপারেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন স্বয়ং আমি এর প্রতিদান দিব। রোযা ঢাল; এ ঢাল যেন অক্ষুণ্ন থাকে হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোযা ঢাল স্বরূপ।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৫১; ইবনে মাজাহ হাদীস : ১৬৩৯ অন্য হাদীসে আছে, যুদ্ধে ব্যবহৃত ঢালের মতো রোযা জাহান্নাম থেকে ঢাল। রোযা যেহেতু জাহান্নাম থেকে ঢাল সুতরাং তা আমাকে অক্ষুণ্ন রাখতে হবে এবং কী করলে তা ভেঙ্গে যায় তাও জানতে হবে। এক হাদীসে এসেছে, রোযা ঢাল যতক্ষণ না তা বিদীর্ণ করে ফেলা হয়।-মুসনাদে আহমদ হাদীস : ১৬৯০ কীভাবে এই ঢালকে বিদীর্ণ হওয়া থেকে রক্ষা করা যায়? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, রোযা হচ্ছে ঢাল। যখন তোমাদের কেউ রোযা থাকে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে এবং মূর্খের ন্যায় কাজ না করে। কেউ যদি তাকে গালি দেয় বা ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত হয় তাহলে সে যেন বলে, আমি রোযাদার, আমি রোযাদার।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০৪; সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৫১ অন্য হাদীসে আছে, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও মন্দ কাজ বর্জন করল না তার পানাহার বর্জনে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০৩ নিয়মিত তারাবীহ পড়-ন এ মাসের বিশেষ আমলের মধ্যে তারাবী নামায অন্যতম। এ নামায সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে ছওয়াবের আশায় রমানের রাতে দণ্ডায়মান হয় তার পূর্ববর্তী গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।-সহীহ বুখারী হাদীস : ২০০৯ বেশি বেশি কুরআন তেলাওয়াত করুন কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, (অর্থ) রমযান মাস, মাসে কুরআন নাযিল করা হয়েছে। যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং হক বাতিলের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।-সূরা বাকারা : ১৮৫ হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত জিবরীল আ. রমযানের প্রতি রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসতেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাতেন।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০২ যথাসাধ্য দান করুন দান করার অর্থ অন্যকে দেওয়া নয়, নিজের জন্য আখিরাতের সঞ্চয় করা। সুতরাং দান করি আর হিসাব করি যে, আখেরাতের জন্য কী পরিমাণ সংরক্ষণ করলাম। আর এর জন্য সর্বোত্তম সময় হল রমযান মাস। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়ার সকল মানুষ অপেক্ষা অধিক দাতা ছিলেন। রমযানে তাঁর দানের হাত আরো প্রসারিত হত।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১৯০২ তাহাজ্জুদের সুযোগকে কাজে লাগান এবং তা অভ্যাসে পরিণত করুন হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘ফরয নামাযের পরে সর্বোত্তম নামায হল রাতের নামায (অর্থাৎ তাহাজ্জুদ)।’-সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৬৩; মুসনাদে আহমদ হাদীস : ৮৫৩৪; জামে তিরমিযী হাদীস : ৪৩৮ রমযান মাসে যেহেতু সেহরীর জন্য ওঠা হয়। তাই একটু আগে উঠে দুই চার রাকাত তাহাজ্জুদ পড়া খুবই সহজ। এজন্য এই বিষয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত। পাশাপাশি ফিকির করা উচিত যে, এটাকে যেন আগামীর জন্য অভ্যাসে পরিণত করতে পারি। পরিবারের লোকদেরকেও উঠিয়ে দিই। বেশি বেশি দুআ ও ইসে-গফার করুন এক হাদীসে এসেছে, ‘রোযাদারের দুআ ফিরিয়ে দেওয়া হয় না।’ অন্য রেওয়ায়েতে আছে, রমযানে রোযাদারকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। বিশেষ করে শেষ রাত দুআ ও ইসে-গফারের সবচেয়ে উপযোগী সময়। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যখন রাতের এক তৃতীয়াংশ বাকি থাকে তখন আল্লাহ তাআলা নিকটবর্তী আসমানে নেমে আসেন এবং ঘোষণা করতে থাকেন, কে আমাকে ডাকছ আমি তার ডাকে সাড়া দিব। কে প্রার্থনা করছ আমি তাকে দান করব। কে আছ ক্ষমাপ্রার্থী আমি তাকে ক্ষমা করে দিব।-সহীহ বুখারী হাদীস : ১১৪৫; সহীহ মুসলিম হাদীস : ৭৫৮ শবে কদরের অন্বেষণে থাকুন কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, (অর্থ) নিশ্চয়ই আমি তা (কুরআন) নাযিল করেছি লাইলাতুল কদরে। আপনি কি জানেন লাইলাতুল কদর কী? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।-সূরা কদর : ১-৩ হাদীস শরীফে এসেছে, ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ছওয়াবের আশায় কদরের রাতে নামাযে দণ্ডায়মান থাকবে তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ৭৬০; সহীহ বুখারী হাদীস : ২০১৪ সুতরাং এই ফযীলত লাভে সচেষ্ট হওয়া কর্তব্য। অন-ত ইশা ও ফজর যদি জামাতের সাথে হয় তবুও সারারাত নামায পড়ার সমান ছওয়াব পাওয়া যাবে এবং শবে কদরের ন্যূনতম ফযীলত লাভ করা যাবে। কারণ এক হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি ইশা ও ফজর জামাতের সাথে পড়ল সে যেন সারারাত দাঁড়িয়ে নামায পড়ল।-সহীহ মুসলিম হাদীস : ৬৫৬; মুসনাদে আহমদ হাদীস : ৪০৮ শেষ দশকে ইতিকাফ করুন শবে কদর লাভ করার সবচেয়ে উত্তম উপায় হল শেষ দশকে ইতিকাফ করা। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা শেষ দশকে শবে কদর অন্বেষণ কর।’ অন্য রেওয়ায়েতে আছে, ‘তোমরা শেষ দশকের বেজোড় রাত্রিগুলোতে শবে কদর তালাশ কর।’-সহীহ বুখারী হাদীস : ২০১৭; ২০২০ নির্দিষ্টভাবে সাতাশের রাতকে শবে কদর বলা ঠিক নয়। কারণ হাদীসে শেষ দশকে শবে কদর অন্বেষণ করতে বলা হয়েছে। তাই শেষ দশকের সব রাতেই যথাসম্ভব বেশি বেশি ইবাদাত করা চাই। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের মাঝের দশ দিন ইতিকাফ করতেন। এক বছর এভাবে ইতিকাফ শেষ করার পর যখন রমযানের একুশতম রাত এল তখন তিনি ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি আমার সাথে ইতিকাফ করেছে সে যেন শেষ দশকে ইতিকাফ করে। কারণ আমাকে শবে কদর সম্পর্কে অবগত করা হয়েছিল (যে তা শেষ দশকের অমুক রাতে)। এরপর তা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। … সুতরাং তোমরা শেষ দশকে শবে কদর খোঁজ কর।’-সহীহ বুখারী হাদীস : ২০২৭; সহীহ মুসলিম হাদীস : ১১৬৭ সুতরাং বুঝা গেল যে, শেষ দশকে যে ইতিকাফ করবে তার শবে কদর নসীব হবে। মাসনূন ইতিকাফ দশ দিন। যাদের দশ দিন ইতিকাফ করার সুযোগ নেই বা সাহস হয় না তারা দুই তিন দিন নফল ইতিকাফ করতে পারেন। হাদীস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার সন’ষ্টির উদ্দেশ্যে একদিন ইতিকাফ করবে আল্লাহ তাআলা তার এবং জাহান্নামের মাঝে তিন খন্দক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন। অর্থাৎ আসমান ও যমীনের দূরত্ব থেকে অধিক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিবেন।-শুআবুল ঈমান হাদীস ”: ৩৯৬৫ মাসাইল প্রসঙ্গ রোযার হুকুম, সময় ও শর্ত ১. রমযানের চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রোযা রাখা ফরয। দেখুন : সূরা বাকারা : ১৮৩ ও ১৮৫; সহীহ মুসলিম ১/৩৪৭ ২. প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ও সুস’মসি-ষ্ক ব্যক্তির উপর রমযানের রোযা ফরয। ৩. রোযার সময় হচ্ছে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস- পর্যন-। দেখুন : সূরা বাকারা : ১৮৭; সহীহ মুসলিম ১/৩৪৯ ৪. রোযার নিয়ত করা জরুরি। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, সকল আমলই নিয়তের উপর নির্ভরশীল। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২ ৫. সুবহে সাদিকের পূর্বেই রোযার নিয়ত করে নেওয়া উচিত। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৬৬ যেসব কারণে রোযা ভঙ্গ হয় না ১. ভুলে কোনো কিছু খেলে বা পান করলে। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৯; সহীহ মুসলিম ১/৩৬৪; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৭৩ ২. ভুলে স্ত্রী সহবাস করলে। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৯; শরহে মুসলিম, নববী ১/৩৫৪; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৭৪ ৩. দিনের বেলা স্বপ্নদোষ হলে। দেুখন : জামে তিরমিযী ১/১৫২ ৪. চোখে সুরমা ব্যবহার করলে। দেখুন : জামে তিরমিযী ১/১৫৪; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/২০৭-২০৮ ৫. অনিচ্ছাকৃত মুখভর বমি হলে। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৬০; জামে তিরমিযী ১/১৫২; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/২১৫ ৬. ধুলাবালি, ধোঁয়া, মশা-মাছি ইত্যাদি যা পরিহার করা সম্ভব নয় অনিচ্ছায় হলকের (কণ্ঠনালি) ভিতরে চলে গেলে। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৯; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৪৯ ৭. জুনুবী অবস’ায় সুবহে সাদিক হয়ে গেলে। দেখুন : সূরা বাকারা : ১৮৭; সহীহ বুখারী ১/২৫৮; সহীহ মুসলিম ১/৩৫৩-৩৫৪; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৭৯; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/২৮০ রোযা অবস’ায় যা করা মাকরূহ নয় ১. সকাল কিংবা সন্ধ্যায় মিসওয়াক করা। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৮-২৫৯; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/২০০; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৭৩ ২. শীতলতা লাভের জন্য মাথা, দেহে পানি ঢালা। আবু বকর ইবনে আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা বিজয়ের দিন রোযা অবস’ায় বাইরে বের হলেন। যখন ‘আরাজ’ নামক স’ানে পৌঁছলেন তখন রোযা তাঁর জন্য কষ্টকর হয়ে দাড়াল। ফলে তিনি মাথায় পানি ঢেলেছিলেন।-মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/২০৬ ৩. সুরমা ব্যবহার করা।-প্রাগুক্ত। যেসব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় তবে কাফফারা ওয়াজিব হয় না ১. কানে ঔষধ বা তেল ঢাললে। তেমনিভাবে নাকে ঔষধ দিয়ে টেনে ভিতরে নিয়ে গেলে। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৯ ২. ইচ্ছা করে মুখভরে বমি করলে। আলী রা. বলেন, কেউ বমি করলে রোযা কাযা করতে হয় না। তবে ইচ্ছা করে বমি করলে তাকে কাযা করতে হবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৮০; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/২১৫; মুসতাদরাকে হাকেম ১/৪২৭ ৩. রাত্র বাকি আছে মনে করে সময়ের পরে সেহরী খেলে। সাঈদ ইবনে জুবায়র রা. বলেন, কেউ (সুবহে সাদিক হয়নি মনে করে) সুবহে সাদিকের পর কিছু খেলে অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকবে এবং অন্য একদিন তা কাযা করে নিবে। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৪৯ ৪. সূর্য অস- গিয়েছে মনে করে সময়ের আগেই ইফতার করে ফেললে। হযরত আলী ইবনে হানযালা রাহ. তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, আমি রমযানে হযরত ওমর রা.-এর কাছে ছিলাম তখন তাঁর সামনে পানীয় পেশ করা হল। কিছু লোক সূর্য ডুবে গিয়েছে মনে করে ইফতার করে ফেললেন। এরপর মুআযযিন এসে বললেন, আমীরুল মু’মিনীন! সূর্য তো এখনো অস- যায়নি। তখন ওমর রা. ঘোষণা করলেন, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শিরক থেকে নিষেধ করেছেন। দুই বার কিংবা তিন বার তিনি একথা বলেছেন। এরপর বললেন, যারা ইফতার করেছে তারা যেন এই দিনের পরিবর্তে অন্য একদিন রোযা রাখে। আর যারা ইফতার করেনি তারা যেন সূর্যাস- পর্যন- তাদের রোযা পূর্ণ করে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৫০ ৫. ভুলক্রমে পানাহারের পর ইচ্ছাকৃত পানাহার করলে।-প্রাগুক্ত। যেসব কারণে রোযা ভেঙ্গে যায় এবং কাফফারা দেওয়া ওয়াজিব হয় ১. ইচ্ছাকৃত পানাহার করা। দেখুন : সহীহ বুখারী ১/২৫৯; সহীহ মুসলিম ১/৩৪৯; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৯৭ ২. ইচ্ছাকৃত স্ত্রী সহবাস করলে। দেখুন : প্রাগুক্ত; সহীহ মুসলিম ১/৩৫৪; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/৩৪৬; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৮৮ রোযা অবস’ায় যা করা মাকরূহ ১. মুখে পানি নিয়ে গড়গড়া করলে। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৮৫ ২. নাকে বেশি বেশি পানি দেওয়া। আছেম ইবনে লাকীত ইবনে ছাবিরা তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নাকে ভালো করে পানি দাও। তবে যদি তুমি রোযাদার হও। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/৩৩৩ ৩. বিনা প্রয়োজনে কোনো কিছু চাবানো। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/১৭৯; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/২০৩ রোযার দিন অবশিষ্ট সময় যা করা উচিত ১. অসুস’তা, বার্ধক্য ইত্যাদি শরীয়তসম্মত কোনো ওযরের কারণে কেউ রমযানের রোযা রাখতে সক্ষম না হলে সে পানাহার করতে পারবে। তবে রোযাদারদের অগোচরে পানাহার করা উচিত। ২. মুসাফির যদি দিনের বেলা সফর থেকে বাড়ি ফিরে আসে তাহলে অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকবে। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/২২১ ৩. তদ্রূপ দিনের বেলা কোনো মহিলার হায়েয বন্ধ হলে অবশিষ্ট দিন পানাহার থেকে বিরত থাকবে। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৬/২২০; মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক ৪/১৭০ কিছু সমসাময়িক মাসআলা উল্লেখিত মাসআলাগুলো ছাড়াও বর্তমান ফকীহগণ কুরআন, হাদীস ও আছারের আলোকে সূক্ষ্ম গবেষণা ও গভীর চিন-া-ভাবনা করে রমযান মাসে সমকালীন চিকিৎসা বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান প্রদান করেছেন। প্রয়োহনীয় কিছু বিষয় নিম্নে উল্লেখ করা হল। ১. এণ্ডোসকপি : রোযা অবস’ায় এণ্ডোসকপি পরীক্ষা করানো যায়। তবে পরীক্ষা করার সময় যদি নলের ভিতর দিয়ে পানি বা কোনো ঔষধ ভিতরে প্রবেশ করানো হয় তাহলে রোযা নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যথায় নষ্ট হবে না। এণ্ডোসকপির মতোই মলদ্বার দিয়ে নল ঢুকিয়ে যে পরীক্ষা করা হয় তার হুকুমও অভিন্ন। ২. এনজিওগ্রাম : সাধারণ পদ্ধতির এনজিওগ্রাম-এর কারণে রোযা নষ্ট হয় না। ৩.ইনেজকশন ও ইনসুলিন : ইনজেকশন ও ইনসুলিন গ্রহণের কারণে রোযা নষ্ট হয় না। তবে যেসব ইনজেকশন খাদ্যের কাজ দেয় তা জটিল ওযর ছাড়া গ্রহণ করা মাকরূহ। ৪. নাইট্রোগ্লিসারিন : এরোসোল জাতীয় এ ঔষধটি ব্যবহার করলে রোযা নষ্ট হয় না। ৫. ভেন্টোলিন ইনহেলার : রোযা অবস’ায় এই ইনহেলার ব্যবহার করলে রোযা নষ্ট হয়ে যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published.