দরসে তাওহীদ : কবরের তওয়াফ, সিজদা ইত্যাদি প্রসঙ্গ

অজ্ঞ লোকেরা কবরে সিজদা করে,কবরের তাওয়াফ করে,এর চৌকাঠে চুমু খায়-এই সকল কর্মকাণ্ড শরীয়তে না-জায়েয। আমাদের আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামগণ এসব কাজকে স্পষ্ট ভাষায় হারাম ও না-জায়েয বলেছেন। কারণ তাওয়াফ,সিজদা,রুকু,হাত বেঁধে দাঁড়ানো-এইগুলো ইবাদত-উপাসনার বিভিন্ন রূপ। আমাদের শরীয়ত কবরের এরূপ সম্মানের অনুমতি দেয়নি,যা পূজা ও উপাসনার পর্যায়ে পৌঁছয়।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতেন,আগের উম্মতের পথভ্রষ্টতার কারণ ছিল অতিশয়তা। তাই তিনি আপন উম্মতকে এসকল কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকার তাকীদ করে গেছেন।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর অন্তিম দিনগুলোতে বলেছেন-

لعن الله اليهود والنصارى، اتخذوا قبور أنبياءهم مساجد

ইয়াহুদ ও নাসারার উপর আল্লাহ অভিশাপ। ওরা ওদের নবীগণের কবরসমূহকে সিজদাগাহ বানিয়েছে।
-সহীহ বুখারী, হাদীস ১৩৯০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫২৯

অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে,

ألا وإن من كان قبلكم كانوا يتخذون قبور أنبياءهم وصالحيهم مساجد. ألا فلا تتخذوا القبور مساجد، إني أنهاكم عن ذلك .

তোমাদের আগের লোকেরা নিজেদের নবী-ওলীগণের কবরকে সিজদাগাহ বানাতো। সাবধান! তোমরা যেন কবরকে সিজদার জায়গা বানাবে না। আমি তোমাদের নিষেধ করে যাচ্ছি।
-সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৩২/২৩; মিশকাত পৃ. ৬৯

আরেক হাদীসে আছে-

اللهم لا تجعل قبري وثنا يعبد، اشتد غضب الله على قوم اتخذوا قبور أنبياءهم مساجد.

ইয়া আল্লাহ! আমার কবরকে ‘মূর্তি’তে পরিণত কোরেন না, যার পূজা অর্চনা হবে! ঐ জাতির উপর আল্লাহ চরম ক্রুদ্ধ, যারা নিজেদের নবীর কবরকে সিজদাগাহ বানায়। -মুয়াত্তা মালেক, হাদীস ৮৫

সাহাবী কায়স ইবনে সা‘দ রা. বলেন, আমি ‘হীরা’ গিয়েছিলাম। ওখানে দেখলাম, লোকেরা তাদের সর্দারকে সিজদা করে। আমি মনে মনে বললাম, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই তো সিজদা পাওয়ার বেশি উপযুক্ত! আমি যখন তাঁর কাছে এলাম আমার ধারণা তাঁকে জানালাম। তিনি বললেন-

أ رأيت لو مررت بقبري أ كنت تسجد له

বল তো তুমি যদি আমার কবরের কাছ দিয়ে গমন করতে তাকে কি সিজদা করতে?

আমি বললাম, لا

‘জি না’

তিনি বললেন –

لا تفعلوا لو كنت آمرا أحدا أن يسجد لأحد لأمرت النساء أن يسجدن لأزواجهن لما جعل الله لهم عليهن من حق

(জীবিত অবস্থায়ও সিজদা) করো না। আমি যদি কাউকে আদেশ করতাম কোনো মাখলুককে সিজদা করার তাহলে নারীদের আদেশ করতাম যেন নিজের স্বামীদের সিজদা করে। স্বামীর ঐ হকের কারণে, যা আল্লাহ স্ত্রীর উপর আরোপ করেছেন।
-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২১৪০; মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ২৭৬৩; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ১৪৭০৫

চিন্তা করে দেখুন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ উম্মতের ব্যাপারেও কবর-পূজার আশঙ্কা কত গভীরভাবে করেছেন! ফলে কত স্পষ্টভাষায় তা নিষেধ করেছেন! কবরে সিজদাকারীকে অভিশাপ করেছেন এবং ঐ কবরকে وثنا ‘মূর্তি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন! এ গর্হিত কর্মকে আল্লাহর ক্রোধ প্রজ্বলিত হওয়ার কারণ সাব্যস্ত করেছেন!

এই সকল হাদীসের কারণে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আলিমগণের সিদ্ধান্ত, কবরে সিজদা করা ‘শিরকে জলী’ (প্রকাশ্য শিরক)।

মোল্লা আলী ক্বারী রাহ.  لعن الله اليهود والنصارى (ইয়াহুদ-নাসারার উপর আল্লাহর অভিশাপ)-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘ইয়াহুদ ও নাসারার উপর অভিশাপ হওয়ার কারণ হয়ত এই যে, নবীগণের ভক্তি-সম্মানার্থে ওরা তাঁদের কবরে সিজদা করত। এটা শিরকে জলী। কিংবা এই যে, ওরা নবীগণের সমাধিতে আল্লাহ তাআলার জন্যই নামায পড়ত। তবে নামাযে কবরের দিকে মুখ করত ও তার উপর সিজদা করত। ওদের ধারণা ছিল, ওরা একসাথে দু’টি পুণ্যের কাজ করছে- আল্লাহর ইবাদত এবং নবীগণের চ‚ড়ান্ত সম্মান। এটা শিরকে খফী। প্রচ্ছন্ন র্শিক। কারণ এতে মাখলুকের এমন তাজিম আছে, যার অনুমতি নেই। সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ উম্মতকে এ কাজ করতে নিষেধ করেছেন হয়ত এ কারণে যে, এটা ইহুদীদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাজ কিংবা একারণে যে, এতে ‘শিরকে খফী’ (প্রচ্ছন্ন শিরক) রয়েছে। -মিশকাতুল মাসাবীহ, টীকা পৃ. ৬৯

হযরত শাহ ওলিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. ‘আলফাউযুল কাবীর’ কিতাবে বলেন, তোমরা যদি মুশরিকদের আকীদা-আমলের পূর্ণ ছবি দেখতে চাও তাহলে এ যুগের আওয়াম ও জাহিলদের দেখ, ওরা মাযারে-মাযারে এবং নিদর্শনের স্থানসমূহে কত ধরনের শিরকে কীভাবে লিপ্ত হয়! অতীতের এমন কোনো বিপদ নেই যাতে এ যুগের কোনো না কোনো গোষ্ঠী অনুরূপ বিশ্বাস নিয়ে লিপ্ত হয়নি। এহেন আমল-আকীদা থেকে খোদা তাআলা আমাদের রক্ষা করুন।

হযরত কাযী ছানাউল্লাহ পানিপথী রাহ. বলেন-

سجدہ کردن سوۓ قبور اولياء وطواف گرد قبور کردن ودعا از آنہا خواستن و نذر براۓ آنہا قبول کردن  حرامست، بلکہ چيزہا  ازاں بکفر میر ساند۔ پیغمبر صلی اللہ علیہ وسلم برآنہا لعنت گفتہ، وازاں منع فرمودند، وگفتہ قبر مرا بت نہ کنند

অর্থ, ওলীদের কবরে সিজদা করা, কবরের তাওয়াফ করা, তাদের কাছে প্রার্থনা করা, তাদের জন্য মান্নত গ্রহণ করা হারাম। এসবের অনেক কিছুই কুফর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে থাকে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম এসবের উপর অভিশাপ দিয়েছেন এবং এসব কাজে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন, আমার কবরকে মূর্তি বানিও না। (মা-লাবুদ্দা মিনহু পৃ. ৮৮)

ইরশাদুত তালিবীন, কিতাবে তিনি বলেন-

وگرد قبور گردیدن جائز نیست کہ طواف بیت اللہ حکم نماز دارد، قال رسول اللہ صلی اللہ علیہ و سلم: طواف البیت صلوۃ ،طواف بیت اللہ حکم نماز دار .

অর্থ, ‘কবরের চারপাশে প্রদক্ষিণ করা জায়েয নয়। কারণ বাইতুল্লাহর তওয়াফ নামাযের হুকুম রাখে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, বাইতুল্লাহর তওয়াফ নামায।’

ফাতাওয়া আলমগীরীতে আছে-

قال برهان الترجماني : لا نعرف وضع اليد على المقابر سنة ولا مستحسنا، ولا نرى به بأسا، وقال عين الأئمة الكرابيسي: هكذا وجدناه من غير نكير من السلف. وقال شمس الأئمة المكي: بدعة. كذا في القنية، ولا يمسح القبر ولا يقبله فإن ذلك من عا دة النصارى

বুরহান তুরজুমানী বলেন, আমরা কবরে হাত রাখাকে সুন্নতও মনে করি না, ভালো কাজও না। তবে কেউ হাত লাগালে গুনাহও মনে করি না। আইনুল আইম্মা কারাবীছি বলেন, ‘আমরা সালাফ থেকে এভাবেই কোনো আপত্তি ছাড়া পেয়েছি।’ শামসুল আইম্মা মক্কী বলেন, এ বিদআত। (কিনয়া) কবরে হাত বুলাবে না, চুমু খাবে না। কারণ এ খ্রিস্টানদের রীতি। (খ. ৫ পৃ. ৩৫১)

এ ফতোয়ার সারকথা এই যে,সুন্নত বা ভালো কাজ মনে না করলে কবরে হাত দিয়ে স্পর্শ করায় দোষ নেই। তবে হাত বুলানোকে বরকতের কারণ মনে করা, চুমু দেওয়া বিদআত। এটা সালাফে সালেহীনের তরীকা না, খ্রিস্টানদের রীতি।

(‘ইখতিলাফে উম্মত আওর সিরাতে মুস্তাকীম’ থেকে অনুবাদে : আবু মুহাম্মাদ)

Leave a Comment

Your email address will not be published.