খৃষ্টধর্ম না পৌলবাদ-৪

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পাপমোচন  The Atonement

পাপমোচনের বিশ্বাসটি খৃস্টধর্মে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। মিস্টার ডেনিয়েল উইলসনের মতে এ বিশ্বাসটিই খৃস্টধর্মের প্রাণ। এ ধর্মের অন্যান্য আকীদার মত এটিও অত্যন্ত জটিল আকীদা। শায়খুল-ইসলাম তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম খৃষ্টধর্মের বিখ্যাত পন্ডিত ও দার্শনিক সেন্ট অগাষ্টাইনসহ অন্যদের বরাতে এ বিশ্বাসের যে ব্যাখ্যা দান করেছেন সংক্ষেপে তা নিম্নরূপ, এ বিশ্বাসটির পেছনে ঐতিহাসিক ও দৃষ্টিভঙ্গিগত অনেকগুলো বিষয় আছে, যা ভালোভাবে না বুঝলে এর প্রকৃত অর্থ হৃদয়ংগম করা সম্ভব নয়। আমরা সে বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করছি।

(এক) যেসব ধারণার উপর এ বিশ্বাসটির ভিত্তি স্থাপিত, তার মধ্যে সর্বপ্রথম ধারণা হল-প্রথম মানুষ হযরত আদম আলাইহিস সালামকে ইচ্ছাশক্তির স্বাধীনতা দিয়ে সবরকমের সুখ-শান্তি দেওয়া হয়েছিল। তবে তাকে গন্ধম খেতে নিষেধ করা হয়েছিল। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির ফলে চাইলে তিনি যে-কোনো হুকুম পালনও করতে পারতেন এবং আমান্যও করতে পারতেন।

(দুই) হযরত আদম আলাইহিস সালাম তার ইচ্ছাশক্তির অনুচিত ব্যবহার করেন এবং নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে মহাপাপ করে বসেন। এটাই ছিল মানুষের কৃত প্রথম পাপ, যা সর্বপ্রথম আনুগত্যের স্থলে অবাধ্যতার জন্মদান করে। এর আগে মানুষ কোনো অবাধ্যতা করেনি। আনুগত্য যেমন সমস্ত পুণ্যের মূল, তেমনি অবাধ্যতা সমস্ত পাপের ভিত্তি। সর্বপ্রথম হযরত আদম আলাইহিস সালামই পাপের ভিত্তিস্থাপন করেন।

(তিন) এ পাপের ফলে হযরত আদম আলাইহিস সালাম স্থায়ী মৃত্যু বা স্থায়ী আযাবের উপযুক্ত হয়ে গেলেন। কেননা আল্লাহ তা’আলা নিষিদ্ধ গাছ দেখিয়ে বলে দিয়েছিলেন, ‘যেদিন তুমি তার ফল খাবে সেই দিন নিশ্চয়ই তোমার মৃত্যু হবে’ (পয়দায়েশ ২ : ১৭)।

সেই সংগে হযরত আদম আলাইহিস সালামকে ইচ্ছাশক্তির যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল তা তার থেকে কেড়ে নেওয়ার ফলে পাপ যেহেতু তার উপর জয়লাভ করেছে তাই তার পুণ্য করার ক্ষমতা লোপ পেয়ে গেছে। এখন পাপ করার জন্য তো তিনি স্বাধীন, কিন্তু পুণ্যের জন্য স্বাধীন নন।

(চার) পাপে লিপ্ত হওয়ার ফলে যেহেতু আদি মানব-মানবীর পুণ্য করার স্বাধীনতা লোপ পেয়ে গেছে এবং পাপের জন্য তারা স্বাধীন থেকে গেছেন তাই তার পরিণামে পাপ তাদের স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়। পরিভাষায় একে ‘আদিপাপ’ বলা হয়।

(পাঁচ) আদি মানব-মানবীর পর যত মানুষের জন্ম হয়েছে এবং ভবিষ্যতে জন্ম হবে তারা সকলে যেহেতু তাদেরই সন্তান তাই ‘আদিপাপ’ পুরুষ পরম্পরায় মানুষের ভেতর সংক্রমিত হয়ে আসছে। এখন দুনিয়ায় যে ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করে সে মায়ের পেট থেকেই পাপী হয়ে জন্ম নেয়। কেননা তার পিতামাতার ‘আদিপাপ’ তার স্বভাবেও প্রবিষ্ট রয়েছে। এই আদিপাপই সমস্ত পাপের মূল।

(ছয়) সমস্ত আদম-সন্তান যেহেতু আদিপাপে পঙ্কিল আর আদিপাপই অন্যসব পাপের মূল, তাই পিতামাতার মত সমস্ত মানুষই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থেকে বঞ্চিত। ফলে তারা একের পর এক পাপ করে যেতে থাকে। আর এভাবে আদিপাপ ছাড়া অন্যান্য পাপের এক বিরাট বোঝা তাদের উপর চেপে যায়, যা আদিপাপের কারণে তারা নিজেরাই সম্পাদন করে।

(সাত) পাপের কারণে সমস্ত আদম-সন্তান তাদের পিতামাতার মত একদিকে স্থায়ী শাস্তির উপযুক্ত হয়ে যায় অন্যদিকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি থেকেও হয়ে পড়ে বঞ্চিত। ফলে তাদের ক্ষমা ও মুক্তিলাভের কোনো উপায়  থাকে না। কেননা পাপ থেকে মুক্তিলাভ হয় কেবল সৎকর্মের মাধ্যমে, কিন্তু ইচ্ছাশক্তি-রহিত হওয়ার কারণে তারা তো সৎকর্ম করতেও সক্ষম নয়।

(আট) এ মসিবত থেকে মানুষের মুক্তিলাভের উপায় কী? আল্লাহ কি বিনাশাস্তিতে ক্ষমা করে দেবেন? তা হয় না। কেননা তিনি ন্যায়বিচারক। তিনি আদিপাপের শাস্তি স্থির করে রেখেছিলেন ‘স্থায়ীমৃত্যু’। কাজেই মৃত্যুদন্ড না দিয়ে ক্ষমা করলে সেটা তার ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হয়।

(নয়) তবে কি এই মসিবতের মধ্যে ফেলে রাখবেন? না তাও সংগত নয়। যেহেতু তিনি পরম দয়ালু। তাই তিনি এমন এক ব্যবস্থা করলেন, যাতে বান্দাদের প্রতি দয়াও হয় আবার ন্যায়বিচারও অক্ষুণ্ণ থাকে।

সে ব্যবস্থায় আসল ধরন তো এ রকম হওয়ার কথা ছিল যে, সমস্ত মানুষকে একবার মৃত্যুদান করবেন, যাতে তাদের পাপের শাস্তি হয়ে যায়। তারপর আবার জীবিত করে তুলবেন, যাতে আদিপাপের ফলে যে ইচ্ছাশক্তি রহিত হয়ে গিয়েছিল, নতুন জীবনে তা আবার ফিরে পায় এবং স্বাধীনভাবে সৎকর্ম করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সমস্ত মানুষকে মৃত্যুদান করে পুনরায় জীবিত করা ছিল প্রাকৃতিক বিধানের পরিপন্থী। কাজেই দরকার হয়ে পড়ল এমন এক নিষ্পাপ ব্যক্তির, যে সমস্ত মানুষের পাপ নিজ কাঁধে বহন করবে। তারপর আল্লাহ একবার তার মৃত্যু ঘটিয়ে পুনরায় জীবন দান করবেন। এভাবে তার একার শাস্তি দ্বারা গোটা মানবজাতির পাপমোচন হয়ে যাবে এবং তারা সকলে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ফিরে পাবে।

(দশ) সেই মহা উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে আল্লাহ নিজ পুত্রকে বেছে নিলেন। ঈশ্বর-পুত্র মানবাকৃতি ধারণ করে দুনিয়ায় আসলেন এবং সমস্ত মানুষের পাপ নিজের কাঁধে নিয়ে শূলবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন। তার মৃত্যুতে সমস্ত মানুষের পাপমোচন হয়ে গেল। কেবল সেই আদিপাপই নয়; বরং সে কারণে আরও যত পাপ করেছে তাও মাফ হয়ে গেল। তিনদিন পর ঈশ্বর-পুত্র পুনরায় জীবিত হলেন এবং এর ফলে গোটা মানবজাতি নতুন জীবন লাভ করল। ফলে সে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির মালিক হয়ে গেল। এখন সে চাইলে সেই ইচ্ছাশক্তির ব্যবহার করে যত ইচ্ছা পুণ্যার্জন করতে পারবে।

(এগার) কিন্তু ঈসা মসীহের এই ত্যাগ কেবল সেই ব্যক্তির কাজে লাগবে, যে তাঁর প্রতি ঈমান এনে তার উম্মত হয়ে যাবে। তার প্রতি ঈমানের আলামত হল তরিকাবন্দী (ব্যাপ্টাইজ) পালন করা।

যে ব্যক্তি তরিকাবন্দী পালন করবে না আদিপাপের বোঝা তার কাঁধে থেকেই যাবে। যদ্দরুন তাকে স্থায়ী শাস্তি ভোগ করতে হবে।

সংক্ষেপে এই হল পাপমোচন তত্ত্ব, যার উপর গোটা খৃস্টধর্মের বুনিয়াদ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এ তত্ত্বটি আদৌ যুক্তিসঙ্গত নয়। কোনো বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন লোকের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এটা শোনামাত্রই যে-কারও অন্তরে হাজারও প্রশ্ন জন্ম নেবে।  যেমন

১. হযরত আদম (আ) একজন নিষ্পাপ নবী। তাঁর ভুলটি কি পাপের পর্যায়ে ছিল? এবং তাকে পাপ বলাটা

কি সঠিক?

২. পাপ হয়েও থাকলে আল্লাহ তা’আলা  তো তাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। সুতরাং সে পাপ তার বংশধরে সংক্রমিত হবে কেন?

৩. ক্ষমা না হলেও তার পাপের কারণে সন্তান পাপী হবে কোন যুক্তিতে?

৪. যদি সে কারণে সন্তানও পাপী হয়, তবে হযরত মসীহ (আ)-এরও তো পাপী হওয়ার কথা, তিনিও মানুষ্যপুত্র হয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং তাকে পাপী বলা হবে না কি কারণে?

৫. যদি তিনিও পাপী হন, তবে তার মৃত্যুতে অন্যরা পাপ থেকে উদ্ধার পাবে কি করে?

৬. যদি পাপী না হন, তবে সমস্ত মানুষের পাপের কারণে একজন নির্দোষকে শাস্তি দেওয়াটা কি অবিচার নয়?

৭. পাপের কারণে কেউ শাস্তিযোগ্য হতে পারে, কিন্তু তার ইচ্ছাশক্তিও কেন কেড়ে নেওয়া হবে। এটা লঘুপাপে গুরুদন্ড অপেক্ষাও গুরুতর নয় কি?

৮. তাও পিতার ক্ষেত্রে না হয় হল, কিন্তু পিতার পাপে সন্তানের পাপী হওয়াটা তো অনিচ্ছাকৃত। সেই অনিচ্ছাকৃত পাপের  কারণে সে কেন শাস্তিযোগ্য হবে এবং তাও ইচ্ছাশক্তি রহিত হওয়া সহকারে?

৯. গুনাহের পর তওবা করলেও কি শাস্তিদান অপরিহার্য? এটা কি বাইবেলের ঘোষণার পরিপন্থী নয়? বাইবেলে তো বলা হয়েছে, যদি কোনো দুষ্টলোক তার সব গুনাহ থেকে ফিরে আসার সব নিয়ম-কানূন পালন করে আর ন্যায় ও ঠিক কাজ করে তবে সে বাঁচবে, মরবে না। সে যেসব অন্যায় কাজ করেছে তা অমি মনে রাখব না (ইহিস্কেল ১৮ : ২১-২২)। এবং তোমার সমস্ত গুনাহ তিনি মাফ করেন (যবূর ১০৩ : ৩)।

১০. পাপমোচনের এ তত্ত্ব অনুসারে কি এটা অনিবার্য হয়ে যায় না যে, সমস্ত নবী-রাসূলও পাপী হিসেবেই জীবন কাটিয়েছেন (নাউযুবিল্লাহ)?

মোটকথা এ জাতীয় অজস্র প্রশ্ন দ্বারা এ তত্ত্বটি বেষ্টিত, যা থেকে এর ত্রাণ অসম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে হযরত মসীহ (আ) নিজে এ সম্পর্কে কী বলেছেন?

পাপমোচন তত্ত্ব ও হযরত মসীহ (আ)

এ সম্পর্কে শায়খুল-ইসলাম তাকী উসমানীর মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, আপনি হয়ত ধারণা করছেন, চার ইন্জীলে হযরত মসীহ (আ)-এর বিভিন্ন উক্তি দ্বারা এটা (পাপমোচনের বিশ্বাসটি) স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে এবং তিনি ও তার হাওয়ারীগণ উত্তমরূপে এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে দিয়েছেন। আপনি এটা মনে করতেই পারেন এবং এর পূর্ণ অধিকার আপনার আছে। কেননা কোনো ধর্ম বা মতবাদের ভিত্তি যেসব বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর স্থাপিত হয়, তা সে ধর্ম বা মতবাদের মৌল রচনাবলীতে ও তার প্রবর্তকদের লেখাজোখায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। ধর্মের প্রাথমিক গ্রন্থসমূহে তো এসব বিষয় প্রমাণের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মকেই ধরুন না। এর বুনিয়াদী আকীদা হল তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। এবার কুরআন মজীদ খুলুন। দেখবেন সমগ্র কুরআন এ বিশ্বাসগুলির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও এর দলীল-প্রমাণের আলোচনায় পূর্ণ।

কিন্তু খৃস্টধর্মের হাল এর সম্পূর্ণ বিপরীত। যেসব চিন্তাধারা এ ধর্মের মূল বিষয়; বরং যে সবের কারণে এ ধর্ম অন্য ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে গেছে ইনজীলসমূহে তার কোন আলোচনা নেই। হযরত মাসীহ ও তার শিষ্যদের পক্ষ হতে তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না- ত্রিত্ববাদ ও অবতারত্বের অবস্থা তো দেখলেন। পাপমোচনের বিশ্বাসটিও তথৈবচ। হযরত মসীহ (আ)-এর কোনো উক্তি দ্বারাই এটা প্রমাণিত হয় না (খৃষ্টধর্মের স্বরূপ পৃ. ৯৫)।

হযরত মসীহ (আ) থেকে এ বিশ্বাসের সমর্থনে কোনো বক্তব্য তো পাওয়াই যায় না; বরং তার এমন কিছু বক্তব্য পাওয়া যায়, যা এ বিশ্বাসটির ভিত্তিহীনতাই প্রমাণ করে। যেমন তিনি বলেন, আমাকে কেবল ইসরাঈল বংশের হারানো মেষদের কাছেই পাঠানো হয়েছে। (মথি ১৫ : ২৪)। পাপমোচনের তত্ত্ব সঠিক হলে তার এ কথাটির কোনো অর্থ আছে কি? পাপমোচনই যদি তার আগমনের লক্ষ্য হয় তবে ইসরাঈলের পথহারা লোকগুলির কাছেই কেন, তার আগমন তো  গোটা মানবজাতির কাছেই হওয়ার কথা! এমনিভাবে তিনি বলেন, ‘সুস্থদের জন্য ডাক্তারের দরকার নেই; বরং অসুস্থদের জন্য দরকার আছে। আমি ধার্মিকদের ডাকতে আসিনি, বরং পাপীদেরই ডাকতে এসেছি’ (মার্ক ২৫ : ২৭)। পাপমোচনের তত্ত্ব অনুযায়ী সব মানুষই তো পাপী। অথচ মসীহ (আ) মানুষকে দুই ভাগ করেছেন-ধার্মিক ও পাপী, আর তার আগমন হয়েছে পাপীদের ডাকার লক্ষ্যে। এরকম আরও বহু উক্তি আছে, যা এ তত্ত্বটি ভিত্তিহীন হওয়ার সাক্ষ্য বহন করে।

পাপমোচন ও সেন্ট পৌল

হযরত ঈসা (আ) থেকে তো নয়ই এমন কি তাঁর শিষ্যদের থেকেও এ বিশ্বাস সম্পর্কে উক্তি পাওয়া যায় না। বস্ত্তত সেনট পৌল এ তত্ত্বের উদ্ভাবক। তিনিই সর্বপ্রথম দর্শনসহকারে এটি উপস্থাপন করেছেন। সুতরাং রোমীয়দের নামে লেখা চিঠিতে তিনি বলেন, ‘একটি মানুষের মধ্য দিয়ে গুনাহ দুনিয়াতে এসেছিল ও  সেই গুনাহের মধ্য দিয়ে মৃত্যুও এসেছিল। সব মানুষ গুনাহ করেছে বলে এভাবে সকলের কাছেই মৃত্যু উপস্থিত হয়েছে। মূসার শরীয়ত দেবার আগেই দুনিয়াতে গুনাহ ছিল, কিন্তু শরীয়ত না থাকলে তো গুনাহকে গুনাহ বলে ধরা হয় না। তবুও আদমের সময় থেকে শুরু করে মূসার সময় পর্যন্ত সকলের উপরেই মৃত্যু রাজত্ব করছিল। এমনকি আল্লাহর হুকুম অমান্য করে যারা আদমের মত গুনাহ করেনি তাদের উপরেও মৃত্যু রাজত্ব করছিল। যার আসবার কথা ছিল আদম ছিলেন একদিক থেকে সেই ঈসা মসীহেরই ছবি, কিন্তু আদমের গুনাহ যে রকম আল্লাহর বিনামূল্যের দান সেই রকম নয়। যখন একজন লোকের গুনাহর ফলে অনেকে মরল তখন আল্লাহর রহমতের এবং আর একজন মানুষের দয়ার মধ্য দিয়ে যে দান আসল, তা সেই অনেকের জন্য আরও কত না বেশি করে উপচে পড়ল। সেই আর একজন মানুষ হলেন ঈসা মসীহ। আল্লাহর দান আদমের গুনাহের ফলের মত নয়। কারণ একটা গুনাহের বিচারের ফলে সব মানুষকেই শাস্তির যোগ্য বলে ধরা হয়েছে। কিন্তু ধার্মিক বলে আল্লাহর গ্রহণযোগ্য হওয়ার এই যে রহমতের দান, তা অনেক গুনাহের ফলে এসেছে। একজন মানুষের গুনাহের দরুন মৃত্যু সেই একজনের মধ্য দিয়েই রাজত্ব শুরু করেছিল।  কিন্তু  যারা  প্রচুর পরিমাণে আল্লাহর রহমত ও ধার্মিক বলে তার গ্রহণযোগ্য হওয়ার দান পায় তারা সেই একজন মানুষের অর্থাৎ ঈসার মধ্য দিয়ে জীবনের পরিপূর্ণতা নিয়ে নিশ্চয়ই রাজত্ব করবে। তাহলে একটা গুনাহের মধ্য দিয়ে যেমন সব মানুষকেই শান্তির যোগ্য বলে ধরা হয়েছে, তেমনি একটা ন্যায় কাজের মধ্য দিয়ে সব মানুষকেই ধার্মিক বলে গ্রহণ করার ব্যবস্থাও করা হয়েছে এবং তার ফল হল অনন্ত জীবন। যেমন একজন মানুষের অবাধ্যতার মধ্য দিয়ে অনেককেই গুনাহগার বলে ধরা হয়েছিল, তেমনি একজন মানুষের বাধ্যতার মধ্য দিয়ে অনেককেই ধার্মিক বলে গ্রহণ করা হবে। (রোমীয় ৫ : ১২-১৯)।

আরও ব্যাখ্যার সাথে বলেন, এই কথা কি জান না যে, আমরা যারা মসীহ ঈসার মধ্যে তরিকাবন্দী নিয়েছি আমরা তার মৃত্যুর মধ্যে অংশগ্রহণ করেই তা নিয়েছি? আর সেজন্য সেই তরিকাবন্দীর দ্বারা মসীহের সংগে মরে আমাদের দাফনও করা হয়েছে, যেন পিতা তার মহাশক্তি দ্বারা যেমন মসীহকে মৃত্যু থেকে জীবিত করেছিলেন, তেমনি আমরাও যেন নতুন জীবনের পথে চলতে পারি। মসীহের সংগে মরে যখন তাঁর সংগে আমরা যুক্ত হয়েছি, তখন তিনি যেমন মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠেছেন ঠিক তেমনি করে আমরা তার সংগে জীবিতও হব। আমরা জানি যে, আমাদের গুনাহ-স্বভাবকে অকেজো করবার জন্যই আমাদের পুরানো ‘আমি’-কে মসীহের সংগে ক্রুশে হত্যা করা হয়েছে। যেন গুনাহের গোলাম হয়ে আর আমাদের থাকতে না হয় কারণ যে মরেছে সে গুনাহের হাত থেকে ছাড়া পেয়েছে। (রোমীয় ৬ : ৩-৭)।

এই হল পাপমোচন সম্পর্কে সেন্ট পৌলের দর্শন, যা আরও পরে সেন্ট অগাস্টাইন প্রমুখ খৃস্টীয় তাত্ত্বিক পুরুষগণ অধিকতর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সাথে সুবিন্যস্ত আকারে পেশ করেছেন এবং ভক্তির আতিশয্যে খৃষ্টসম্প্রদায় অন্ধভাবে একে নিজেদের বুনিয়াদী বিশ্বাসরূপে গ্রহণ করে নিয়েছে। ষ

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

Leave a Comment

Your email address will not be published.