তাকওয়ার দুই স্তর, মুত্তাকীর দুই শ্রেণী-১

পাপ-পুণ্য মানব-জীবনের এক সাধারণ অনুষঙ্গ। মানুষের মাঝে পাপীও আছে, পুণ্যবানও আছে। তবে অধিকাংশ মানুষের পরিচয় এই যে তাদের আমলনামা পাপ-পুণ্যে মিশ্রিত। অতএব এ বিষয়েও পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।

কুরআন মাজীদ এ বিষয়ে আমাদের সঠিক ধারণা প্রদান করে। এটি কুরআন মাজীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকলে মানুষ নানা ধরনের বিচ্যুতি ও বিভ্রান্তির শিকার হয় যা তার কর্ম ও আচরণকেও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মাঝে এ বিষয়ে বহু ভ্রান্তি ও প্রান্তিক ধারণাও ছিল, এখনও আছে। কিছু মুসলিম ফেরকা ও উপদল, যেগুলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর বাইরে, তাদেরও নানা বিভ্রান্তি আছে। এ সকল বিভ্রান্তিই কুরআনের বর্ণনা দ্বারা ভ্রান্তি ও বিচ্যুতি হিসাবে চিহ্নিত। কিন্তু এ সকল দিক আমাদের এ দরসের বিষয়বস্তু নয়। সাধারণ মানুষের সাধারণ কিছু ভুল ধারণার উপর আলোকপাত করাই আজকের আলোচনার উদ্দেশ্য।

মুত্তাকী’ ও ‘পরহেযগা’র শব্দ দুটি আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। কিন্তু কাকে বলে মুত্তাকী? কী কী বৈশিষ্ট্যের দ্বারা মানুষ আল্লাহর কাছে মুত্তাকী বলে গণ্য হয়? মুত্তাকী মানে কি মাসুম ও নিষ্পাপ হওয়া? ভুল-ত্রুটির উর্ধ্বে হওয়া? কখনো কোনো গোনাহ হয়ে গেলে কি মানুষের নাম মুত্তাকীর তালিকা থেকে বাদ পড়ে যায়? কিংবা পাপী ও গুনাহগারদের জন্যে কি খোলা নেই মুত্তাকী হওয়ার দরজা?

অন্যদিকে শুধু ঈমান আনার দ্বারাই কি পাপাচারের কুফল থেকে মুক্ত থাকা যায়? পাপাচার কি মানুষের জন্যে কোনো আশঙ্কাই তৈরি করে না? পাপের কোনো পর্যায়ই কি এমন নেই, যা মানুষকে আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করে? আজকের দরসে আমরা এসকল প্রশ্নের জবাব পাবার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

সূরা আ‘রাফে(৭ : ২০১-২০২) আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنَّ الَّذِينَ اتَّقَوْا إِذَا مَسَّهُمْ طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ تَذَكَّرُوا فَإِذَا هُمْ مُبْصِرُونَ . وَإِخْوَانُهُمْ يَمُدُّونَهُمْ فِي الْغَيِّ ثُمَّ لَا يُقْصِرُونَ
আল্লাহ তাআলা এ দুই আয়াতে মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য ও ‘ইখওয়ানুশ শায়াতীন’-এর বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন। অন্য ভাষায় বলা যায়, ‘ইবাদুর রাহমান’ ও ‘ইবাদুশ শাইতান’ তথা আল্লাহর বান্দা ও শয়তানের বান্দাদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। এ দুই আয়াত আমাদের জন্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের মতো গোনাহগার, যারা শয়তানের ধোঁকায় পড়ে যাই, গোনাহে লিপ্ত হয়ে যাই- এই সকল মানুষের জন্য এ দুই আয়াতে যেমন আছে গভীর সান্ত্বনা, তেমনি আছে অতি প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ।

আল্লাহ পাক হলেন রাহমানুর রাহীম। অতি দয়ালু, পরম করুণাময়। দয়া ও করুণার কারণে তিনি কুরআন মাজীদে এমন সব বিবরণ, এমন সব নির্দেশনা ও উপস্থাপনা রেখেছেন যার উপলব্ধি অর্জিত হলে কোনো কিছুই বান্দাকে আল্লাহ পাকের সামনে সমর্পিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারবে না।

এই দুই আয়াতে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই যারা আল্লাহকে ভয় করে যখন তাদেরকে স্পর্শ করে শয়তানের পক্ষ থেকে কোনো কিছু; কুমন্ত্রণা বা ওয়াসওয়াসা, তখন তারা স্মরণ করে; আল্লাহকে স্মরণ করে। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ স্মরণ করে। ফলে তাদের চোখ খুলে যায়, করণীয় স্পষ্ট হয়ে যায়। এ হচ্ছে মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য।

মুত্তাকী মানে কী? মুত্তাকী মানে কি মাসুম বা নিস্পাপ? না। মাসুম বা নিস্পাপ তো ছিলেন নবী রাসূলগণ। আল্লাহ যাদের তৈরিই করেছেন এমনভাবে যেন তাঁরা গোটা মানবজাতির জন্যে আদর্শ হতে পারেন। তাঁরাই যদি গোনাহে লিপ্ত হতেন (নাউযুবিল্লাহ) তাহলে তো মানুষ আরো বেশি গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়বে। তো মাসুম হওয়া নবী-রাসূলের বৈশিষ্ট্য। তেমনি তা ফিরিশতাদের বৈশিষ্ট্য। ফিরিশতাদের সম্পর্কে আল্লাহ পাক কুরআনে কারীমে বলেছেন-

لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ
অর্থাৎ তারা আল্লাহ পাকের কোনো আদেশ অমান্য করেন না। আর আল্লাহ পাক তাদের যে আদেশ করেন তা পালন করেন । -সূরা তাহরীম ৬৬ : ৬

মুত্তাকী হলেন আল্লাহ পাকের ঐসকল বান্দা, যাদের অন্তরে আল্লাহ পাকের ভয় আছে এবং যারা গোনাহ থেকে বেঁচে থাকেন। আল্লাহকে স্মরণ করার এক পর্যায় হল, গুনাহের পরিস্থিতি তৈরি হলে আল্লাহকে স্মরণ করা এবং গুনাহে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকা। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى
পক্ষান্তরে যে স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় করে এবং প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাস।’
-সূরা নাযিআত ৭৯ : ৪০-৪১

গুনাহের পরিস্থিতি অনেক রকম হতে পারে। যেমন ক্রোধের পরিস্থিতি। কারো প্রতি ক্রোধ জাগ্রত হয়েছে, এ অবস্থায় আল্লাহর ভয়ে সীমালঙ্ঘন থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর কাছে মুত্তাকী হিসাবে গণ্য হয়। বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম মুজাহিদ রাহ. আলোচিত আয়াতের طَائِفٌ مِنَ الشَّيْطَانِ ‘শয়তানের পক্ষ হতে কুমন্ত্রণাকে’ ‘ক্রোধ’ শব্দের দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন। এটি একটি ক্ষেত্র। এ রকম আরো অনেক ক্ষেত্র হতে পারে। অন্যান্য গুনাহের পরিস্থিতিতেও আল্লাহর ভয়ে নিজকে নিয়ন্ত্রণ করার দ্বারা ‘তাকওয়ার’ পরিচয় পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর শব্দটি ব্যাপক। তিনি طائف من الشيطان -এর ব্যাখ্যা করেছেন اللمة من الشيطان অর্থাৎ ‘শয়তানের প্ররোচনা’।

মোটকথা গুনাহের পরিস্থিতি তৈরি হলে আল্লাহকে স্মরণ করা এবং গুনাহ ত্যাগ করা তাকওয়ার একটি প্রকার। এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার কাছে মুত্তাকী হিসাবে গণ্য।

আল্লাহকে স্মরণ করার দ্বিতীয় পর্যায় হল গুনাহ হয়ে যাওয়ার পর স্মরণ করা। মুত্তাকী বান্দার কখনো কোনো গোনাহ হয় না, তা নয়। স্খলন হতে পারে, ভুল হতে পারে, কিন্তু তার বৈশিষ্ট্য হল, গুনাহ হয়ে গেলে মনে অনুতাপ জাগে, আল্লাহর ভয় জাগে এবং এই উপলব্ধি জাগে যে, আমি আমার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছি। আর তখন সে তার করণীয় স্পষ্ট দেখতে পায় যে, আমাকে এই অবস্থা থেকে ফিরতে হবেই। সে ব্যাকুল হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে যায়। এটিও তাকওয়ার একটি সত্মর এবং মুত্তাকীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এদের সম্পর্কেও আছে জান্নাতের সুসংবাদ। সূরা আলে ইমরানে, যেখানে আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, সেখানে আছে-

اَلَّذِيْنَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَنْ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَى مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ
‘এবং যারা কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া কে পাপ ক্ষমা করবে? আর তারা যা করে ফেলে জেনে বুঝে তাতে অটল থাকে না।’
-সূরা আলে ইমরান : ৩ : ১৩৫

তো এ আয়াতে তাকওয়ার এ পর্যায়টির কথা পাওয়া যায়। আমাদের আলোচ্য আয়াত এ পর্যায়কেও শামিল করে। ইমাম সুদ্দী রাহ. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি ঐ আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন, إذا زلوا تابوا অর্থাৎ যখন তাদের পদস্খলন ঘটে তখন তওবা করে।

জামে তিরমিযীতে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. থেকে হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,

– سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: ما من رجل يذنب ذنبا , ثم يقوم فيتطهر ثم يصلي ثم يستغفر الله إلا غفر الله له ثم قرأ هذه الآية: والذين إذا فعلوا فاحشة… وهم يعلمون …
আমি আল্লাহর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে কেউ যখন কোনো গুনাহ করে ফেলে এরপর (তার বোধোদয় হয় এবং সে ) উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করে, এরপর নামায পড়ে, এরপর আল্লাহর কাছে মাফ চায়, আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন। এরপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেন।
-জামে তিরমিযী, হাদীস ৪০৬

যখন কোনো বান্দা আল্লাহর দিকে ফিরতে শুরু করে তখন আল্লাহ কত খুশি হন হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

لله أشد فرحا بتوبة عبده حين يتوب إليه من أحدكم كان على راحلته بأرض فلاة، فانفلتت منه، وعليها طعامه وشرابه، فأيس منها، فأتى شجرة فاضطجع في ظلها قد أيس من راحلته، فبينا هو كذلك إذا هو بها قائمة عنده، فأخذ بخطامها ثم قال من شدة الفرح : اللهم أنت عبدي وأنا ربك أخطأ من شدة الفرح
অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি কোনো মরুভূমিতে সফর করছে। যে উটে সফর করছে তাতেই তার পাথেয় ও সামানা। কোথাও হয়ত যাত্রা বিরতির জন্য একটু নেমেছে। এদিকে সুযোগ পেয়ে উটটি পালিয়ে গেল। এখন এই ধূ ধূ মরুভূমিতে মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। এই প্রান্তর পায়ে হেঁটে পাড়ি দেওয়া সম্ভব নয়, আর পানি ও পাথেয় ছাড়া বেঁচে থাকাও সম্ভব নয়। অতএব মৃত্যুর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে এক গাছের নিচে এসে শুয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দেখে, তার সেই উট সব পাথেয়সহ তার সামনে উপস্থিত। আনন্দের আতিশয্যে ভুলে বলে ফেলেছে اللهم أنت عبدي وأنا ربك (হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা, আমি তোমার রব!) রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, এ বান্দা ঐ মুহূর্তে তার উট ফিরে পেয়ে যে পরিমাণ আনন্দিত হয়, আল্লাহ পাক তার ফিরে আসা বান্দার প্রতি তারচেয়েও বেশি খুশি হন।
-সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৪৬

শেষাংশ অংশ:
তাকওয়ার দুই স্তর, মুত্তাকীর দুই শ্রেণী-২

1 Comment

  1. Pingback: তাকওয়ার দুই স্তর, মুত্তাকীর দুই শ্রেণী-২ - ইসলাম বার্তা

Leave a Comment

Your email address will not be published.