পূর্বের অংশ সমূহ=
ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম-১
ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম-২
ধর্মনিরপেক্ষতা বসালে লাভ কী?
আমাকে কেউ বলেছিল, মহান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সংবিধানে থেকেই বা লাভ কী? সংবিধানে তো ইসলাম বিরোধী অনেক কিছুই আছে। দেশে তো আর ইসলামী হুকুমত নেই, কখনো ছিলও না। তাহলে অতটুকু কথা বাদ দিলেই বা কী এসে যায়? আপনি কেন এর বিরোধিতা করছেন? আমি বলি, ঠিক যে কারণে ওরা সংবিধান থেকে বিষয়টি তুলে দিতে চায়। মহান আল্লাহ তাআলার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস যদি কোনো কাজেই না আসত তাহলে কেন তারা এটি সরিয়ে দিতে চায়? ওটা সরিয়ে দেওয়ার কারণে কি কোনো বদনাম হতে হচ্ছে না। তারপরও তারা এ ঝুঁকি নিল কেন?। কিছু কথা আছে খুব সহজেই বুঝে আসে। অনেক দূরে গিয়ে বোঝার দরকার হয় না। সরকার কেন ওটাতে হাত দিচ্ছে? এতেই বুঝা যায় যে, এতটুকু বাক্য সংবিধানে থাকারও কিছু মূল্য আছে।
সুতরাং কালো এবং সাদার পার্থক্য বুঝতে হবে। আলো-অন্ধকারকে একাকার করা যাবে না। যদিও সেটা হয় আলোর রেখাপাতমাত্র। ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা মতলববাজরা যা দেওয়ার দিক, আলেম-ওলামাদেরকে থাকতে হবে সতর্ক। কিছুতেই বলা চলবে না ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়; বরং বিষয়টি দেখতে হবে বাস্তবতার নিরিখে, সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি দিয়ে। আমরা মনে করি যে, আমাদের এখন যে আলেমপ্রজন্ম আছে এরা গলদ বুঝ নিয়ে ওদিকে অগ্রসর না হোক। তাদেরকে ভবিষ্যতে এ বিষয়গুলোর সম্মুখীন হতে হবে আরো বেশি।
২০০৬-২০০৮ তত্ত্বাবধায়ক সময়ের একটি ইসলামী দল ও একটি ধর্মনিরপেক্ষ দলের জোটবদ্ধ হওয়া এবং ঐ ইসলামী দলটি কর্তৃক ধর্মনিরপেক্ষতার গলদ ব্যাখ্যা দেওয়ার পরই মনে হয়েছিল যে, সেক্যুলারিজম সম্পর্কে মাদরাসাগুলোতে পড়াশোনা থাকা দরকার এবং এ বিষয়ে আমাদের আরো সচেতন হওয়া উচিত।
তুরস্ক এর উদাহরণ
ধর্মনিরপেক্ষতার বাতিক একটি জাতিকে কত উঁচু থেকে কত নীচুতে নিক্ষেপ করতে পারে তার নযীর আপনি দেখতে পারেন একসময়কার সালতানাতে উসমানিয়ার রাজধানী তুরস্কে। এটি ঐ তুরস্ক, যে শাসন করেছিল হারামাইন শরীফাইনসহ পৃথিবীর একটি বিশাল অংশ। শত শত বছরের সে উসমানী খেলাফতের কেন্দ্রবিন্দুই শেষের দিকের সুলতানদের অযোগ্যতা-অদক্ষতা ও অপরিণামদর্শিতার কারণে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। কামাল আতাতুর্ক হলেন ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের আদর্শ ব্যক্তি, যিনি এই তুরস্কেই সেক্যুলারিজমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন। আতাতুর্ক সাহেব তুরস্কে কী কী ঘটিয়েছিলেন হয়ত অনেকেরই জানা থাকবে। বিশেষ করে যাদের ইতিহাস নিয়ে নাড়া-চাড়ার অভ্যাস রয়েছে।
খুব সহজ একটা উদাহরণ হল আযান। আযানের ভাষাও ওখানে বদল করে দেওয়া হয়েছিল। মাইকে দেওয়া তো নিষিদ্ধই ছিল। তুর্কি ভাষায় আযান দেওয়া হত। দারুল খিলাফা হওয়ার কারণে সেখানে অসংখ্য মাদরাসা ছিল। সেগুলো সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। মানুষ গর্তের ভিতরে থেকে থেকে কুরআন শিক্ষা চালু রেখেছিল। ওদের বর্ণমালা ঠিক আরবীর মতোই ছিল। এখনো তুর্কী ভাষায় লেখা বই-পত্র পাওয়া যায়। কিন্তু আতাতুর্ক সে বর্ণমালাকে নিষিদ্ধ করে রোমান অক্ষর চালু করেছেন। এখন সেখানে রোমান লিপি চলে। অর্থাৎ ইংরেজী অক্ষরে তুর্কী ভাষা লেখা হয়। এই ভদ্রলোক শুধু ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান তৈরি করে এবং ইসলামী শিক্ষা বন্ধ করেই ক্ষান্ত হননি; বরং সে দেশের প্রতিরক্ষা তথা আর্মি ও আদালতকে কড়া সেক্যুলার বানিয়ে গেছেন। কঠোরহস্তে সেখানে সেক্যুলারিজমের ধর্ম ও ধর্মওয়ালাদের বিরুদ্ধে একপক্ষীয় যুদ্ধ করা হয়েছে। কেননা ধর্মের পক্ষের লোকজন ছিল অস্ত্রশস্ত্রহীন। হাজার হাজার লোককে প্রহসনের বিচার করে-বিনা বিচারে মেরে ফেলা হয়েছে। এভাবে সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে সেক্যুলারিজম। আর আর্মি ও আদালতকে এত কড়া সেক্যুলার বানানো হয়েছিল যে, তারা কোনো ধার্মিক তো দূরে থাক কোনো ধর্মীয় দলকে ক্ষমতা দেওয়া তো দূরের কথা, কোনো দাড়িওয়ালা বা কোনো হিজাব পড়ুয়া মহিলার স্বামীকেও রাষ্ট্রপতি হিসেবে গ্রহণ করেনি; যদিও তাদের কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনেই ঐ ব্যক্তিরা জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছে। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত দলকে নিষিদ্ধ করে দিতে কোনো দ্বিধাই করেনি ঐ শক্তিগুলো।
এসব থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে। অন্যদেরকে সতর্ক করতে হবে এবং যারা মজলুম তাদের জন্য আশার বাণী হচ্ছে, তুরস্কের বর্তমান পরিস্থিতি। যেখানে ঐ অপশক্তিগুলোর হুংকার কমে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু সেটি ঘটেছে অসংখ্য শহীদের রক্ত, মজলুমানের কান্না, অসীম ধৈর্য্য ও অক্লান্ত পরিশ্রমের পর। এ তুর্কিতেই একসময় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হত পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে। পার্লামেন্ট নির্বাচনে সেক্যুলার আর্মি বড় বড় অফিসাররা পাহারাদারি করত। প্রায় বিশ-ত্রিশজন বড় বড় আর্মি অফিসারের রাঙ্গানো চোখের সামনে দিয়ে ভোট দিতে হত। ভোটের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বসে থাকত লোকগুলো। এভাবে তারা যতদিন পেরেছে নিয়ন্ত্রণ করেছে।
বর্তমান সরকার অনেক ধৈর্য ও কৌশলের বিনিময়ে ক্ষমতায় বসেছে। বিভিন্ন কারণে কয়েকবারই দলের নাম পরিবর্তন করতে হয়েছে। কখনো দেশের সংবিধানের সাথে মিল নেই বলে, কখনো দেশের মেযাজের সাথে মিল নেই বলে, এই সেই বলে পুরো দলকেই অযোগ্য ঘোষণা করে দিয়েছে আদালত ও আর্মিরা। তারপরও তারা ধৈর্য হারায়নি। চেষ্টা ও মেহনত অব্যাহত রেখেছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলার মেহেরবানিতে এখন সেখানে পরিবর্তন ঘটছে। ২ বছর আগের তুরস্ক সফরে সেখানকার মুসলিম ভাইবোনদের অবস্থা কিছুটা দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছিল। সেখানকার ধর্মপ্রাণ হাজার হাজার নরনারীর এখনকার আনন্দাশ্রু দেখে আমার মনে হয়েছে, এটি আসলে আতাতুর্কের দুঃখের কান্না। এতদিন লোকটি বেঁচে থাকলে তার মিশনের সমাপ্তি দেখে যে কান্নায় জড়াত সেটিরই প্রতিচ্ছবি হয়তো এই খুশির কান্না। তবুও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। ধৈর্য, কৌশল ও মেহনত এবং সর্বোপরি আল্লাহর রুজ্জুকে আকড়ে রাখার হাতিয়ার ছেড়ে দিলেই বিপদ।
প্রসঙ্গ মিসর
ঐতিহ্যবাহী দেশ মিসরের সর্বপ্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুরসী। রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তাকে ভোট দিয়েছে। এর আগে মিসরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিল না। আগের সরকারগুলো রাষ্ট্রীয় ফরমান, সামরিক ফরমান জারি করে ক্ষমতায় ছিল। ড. মুহাম্মাদ মুরসী পশ্চিমা লোকদের বড় বড় আস্থাভাজন, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বড় বড় ব্যক্তিদের মোকাবেলা করে নির্বাচিত হয়েছেন। এভাবে নির্বাচিত হওয়ার পরও অনেক চড়াই উৎরাই এবং প্রাণহানির পর ক্ষমতায় বসেছেন। কিন্তু একটি দিনের জন্যও তাঁকে শান্তিতে রাষ্ট্র চালাতে দেওয়া হয়নি। আদালত ও সামরিক বাহিনীর নগ্ন হস্তক্ষেপ এবং সেক্যুলার ও বেদ্বীন তথাকথিত সুশীলদের বহুমুখি ষড়যন্ত্র চলেছে সমান্তরালে এবং শেষ পর্যন্ত বন্দুকের জোরে ক্ষমতাচ্যুত করে অন্ধকার কারাবাসে পাঠানো হয়েছে। এসব কী? এসবই হল সেক্যুলারিজমের বদ-আছর। এভাবেই সেক্যুলার শক্তিগুলো যুগে যুগে দেশে দেশে ষড়যন্ত্র ও দমন-পীড়নের মাধ্যমে মুসলমান ও ইসলামপন্থীদের দমিয়ে দিচ্ছে। তাদের গণতন্ত্র-মানবাধিকার এক্ষেত্রে অন্য কোনো অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
পরবর্তী অংশ=
ধর্মনিরপেক্ষতা, সংবিধান ও ইসলাম-৪