প্রশ্ন
আল্লাহ ও রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলী ইত্যাদি মাযহাব অনুসরণ করার হুকুম দেননি, এই সবই পরবর্তীতে সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে এসব কিছুকে ছেড়ে দেয়া জরুরী।
উত্তর
بسم الله الرحمن الرحيم
এই ওয়াসওয়াসটিকে সাধারণ মুসলমানদের কাছে খুবই শক্তিশালী ও ওজনী মনে হয়ে থাকে। আসলে এ বক্তব্যটির কোন সার নেই। নেই কোন ভিত্তিও।
চার মাযহাবই হকের উপর প্রতিষ্ঠিত। চার মাযহাবই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের অন্তর্ভূক্ত। চার মাযহাবের পরস্পরে কিছু শাখাগত মাসায়েলে ইজতিহাদগত পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু মৌলিক কোন বিষয়ে পার্থক্য নেই। এই ইজতিহাদী পার্থক্যের কারনে এক মাযহাবের অনুসারীরা অপর মাযহাবের অনুসারীদের গোমরা বা পথভ্রষ্টও মনে করে না। বরং সবাই একথা বিশ্বাস করে যে, কুরআন ও হাদীসের সঠিক অর্থ বুঝতে ইজতিহাদী বিষয়ে শুধুমাত্র ইজতিহাদী পার্থক্য এটি। গন্তব্য সবারই এক। কিন্তু যাওয়ার পথ একাধিক হয়ে গেছে। সবার দলীলও এক। চার মাযহাবের দলীলই চারটি। যথা কুরআন, হাদীস ও ইজমা কিয়াস। এ কারণে ব্যক্তির নামে প্রসিদ্ধি লাভ করলেও মূল বিষয় সবারই এক। তবে ইজতিহাদে ভুল হলেও যেহেতু একটি সওয়াব, আর সঠিক হলে দুটি সওয়াব। তাই কোন মাযহাবের অনুসারীই ইজতিহাদী মতভেদের কারনে অপর মাযহাবের অনুসারীকে পথভ্রষ্ট বলে না। বরং সবাই স্বীয় মাযহাবের উসূল অনুপাতে কুরআন ও সুন্নতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর উপর আমল করে থাকে।
চার মাযহাব মূলত চারটি বিভক্তি নয়। বরং গন্তব্যে পৌঁছার চারটি রাস্তা। এ কারনেই একে মাযহাব বলা হয়। মাযহাব মানেই হল রাস্তা। রাস্তাগুলো আবিস্কার করে দিয়েছেন চার ইমামগণ। রাস্তাগুলোর স্রষ্টা নন, বরং রাস্তাগুলোর আবিস্কারক।
যেমন কোথাও যদি মাটির নিচে পানি থাকা অবস্থায়, যদি কোন ব্যক্তি এসে সেখানে কুপ খনন করে দেয়, আর উক্ত কুপের পানি সবাই পান করে উপকার পায়। আরেক স্থানে আরেকজন কুপ খনন করে দিল, সেই পানির দ্বারা সেখানকার মানুষের উপকার পেতে থাকলো। তখন উক্ত কুপসমুহের নাম অনেক সময়ই কুপ খননকারীর নামে হয়ে যায়, যেমন বলা হয়ে আব্দুল্লাহের কুপের পানি। আরমানের কুপের পানি। এর মানে কি এই যে, উক্ত কুপের পানির স্রষ্টা আব্দুল্লাহ ও আরমান?
কস্মিনকালেও নয়। বরং স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা। কিন্তু পানি যেহেতু এ দুইজন প্রকাশ করে দিয়েছেন, বের করে দিয়েছেন, আবিস্কার করে দিয়েছেন, তাই তাদের নামে উক্ত কুপের নাম হয়ে গেছে।
এখন আব্দুল্লাহ ও আরমানের কুপের পানি দিয়ে মানুষ অজু করে, গোসল করে নামায আদায় করে, ইবাদত পালন করে। এখন যদি কেউ এসে বলল, আরমানের কুপ বলা শিরক, আব্দুল্লাহের কুপের পানি দিয়ে অজু করলে নামায হবে না, কারন এটি আব্দুল্লাহের পানি, আল্লাহর নয়। তাহলে উক্ত ব্যক্তিকে আমরা কি বলবো?
নিশ্চয় আহমক বলবো। ঠিক তেমনি কথিত আহলে হাদীস ভাইয়েরা সেই আহমক খেতাব পাওয়ার কাজটিই করে যাচ্ছেন। কারণ তারা ফিক্বহে হানাফী, শাফেয়ী, মালেকী ও হাম্বলীকে ইমামদের নিজস্ব শরীয়ত মনে করছেন।
প্রচার করে বেড়াচ্ছে, “এসব আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শরীয়ত নয়, বরং ইমামদের শরীয়ত। ইমামদের আবিস্কৃত এসব মাযহাবের অনুসরণ করে অজু, গোসল, নামায পড়া জায়েজ নয়। কারণ এ পদ্ধতি আল্লাহ ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নয়, বরং মাযহাবের ইমামদের।”
অথচ মাযহাবের ইমামগণ শরীয়তের মাসায়েলের স্রষ্টা তথা নির্দেশদাতা নয়, বরং তারা হলেন আবিস্কারক। আবিস্কারককে বানিয়ে দিল স্রষ্টা। আবিস্কারককে স্রষ্টা যে বলে তার নাম আহলে হাদীস নয় আহমক।
যেখানে যে কুপ রয়েছে, যে কুপের পানি যাদের জন্য সহজভাবে সংগ্রহ করা সুবিধা, সে এলাকার জনগণ সেখানকার কুপ থেকে পানি সংগ্রহ করে পান করবে, গোসল করবে, অজু করবে এটাই আমাদের মত।
ঠিক তেমনি যে এলাকায় যে মাযহাব প্রসিদ্ধ, যেখানে যে মাযহাবের কিতাবাদী সর্বত্র পাওয়া যায়, কিতাব পাঠসূচিতে অন্তর্ভূক্ত, এবং সেই মাযহাবের মুফতী, আলেম, মুহাদ্দিস অজস্র, আমরা উক্ত এলাকায় উক্ত মাযহাবের অনুসরণকে আবশ্যকীয় মনে করি শৃংখলা রক্ষার জন্য।
যেমন এই উপমহাদেশে যখন থেকে ইসলাম এসেছে, তখন থেকেই হানাফী মাযহাব অনুযায়ী দ্বীনী সকল বিষয় পালন করা হয়। শ্রীলংকায় প্রসিদ্ধ শাফেয়ী মাযহাব, মক্কায় প্রসিদ্ধ হাম্বলী মাযহাব, মদীনায় প্রসিদ্ধ মালেকী মাযহাব। ব্যস, যে ব্যক্তি যেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা, যেখানে আমলী মুতাওয়াতির সূত্রে যে মাযহাব অনুযায়ী দ্বীনী বিষয় পালিত হয়ে আসছে, উক্ত এলাকায় সেই হিসেবেই আমল করা হবে। এটাই মাযহাব অনুসরণের মূল থিউরী।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, ১২৪৬ হিজরীতে এসে আব্দুল হক বানারসীর মাধ্যমে, মুহাম্মদ হুসাইন বাটালাবীর রানী ভিক্টোরিয়ার কাছে আবেদন করে কথিত “আহলে হাদীস” নামে একটি নতুন ফিরক্বার জন্ম হল। যারা হানাফী মাযহাবের উপর একতার প্লাটফর্মে থাকা মুসলিম জনতাকে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করার জন্য সহীহ হাদীসের জিগির তুলে শুরু করে দিল ফিতনা। যা বর্তমানে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তাদের অপপ্রচারের মাধ্যমে। মুখে একতার স্লোগান। কাজে বিভক্তির চাল। এই বিভ্রান্তি আর বিভক্তির নাম দিচ্ছে আবার কুরআন ও সহীহ হাদীসের অনুসরণ! বড়ই সেলুকাস!
উপরোক্ত ওয়াসওয়াসটির মত আমরাও তাদের মতই তাদেরকে কিছু পাল্টা প্রশ্ন করতে পারি-
১
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসকে, বুখারী, মুসলিম, তিরমিজী, নাসায়ী, মুয়াত্তা, আবু দাউদ, মুসনাদে আহমাদ ইত্যাদির হাদীস নামে বিভক্ত করার নির্দেশ না আল্লাহ দিয়েছেন, না রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়েছেন। তাই এ বিভক্তি ছেড়ে দিয়ে সব ক’টি হাদীসকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীস বলে সমান মর্যাদা দেয়া উচিত নয় কি?
২
বুখারীকে অন্য কিতাবের প্রাধান্য দেয়ার নির্দেশ আল্লাহ তাআলা বা তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোথাও দেননি। বুখারীকে “আসহহুল কুতুবি বাদা কিতাবিল্লাহ” বলা শুরু হয়েছে গ্রন্থগুলো সংকলনের অনেক পর থেকে। তাই বুখারীকে আসহহুল কুতুবি বাদা কিতাবিল্লাহ বলা ছেড়ে দিতে হবে না?
৩
হাদীসকে সহীহ লিজাতিহী, সহীহ লিগাইরিহী, হাসান লিজাতিহী, হাসান লিগাইরিহী, জঈফ, মারফূ, মাকতু, মুরসাল ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত করার নির্দেশ আল্লাহ ও তার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দেননি। এসব বিভক্তি পরবর্তীতে সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে এসব বিভক্তি ছেড়ে দেয়া জরুরী নয় কি?!
৪
সিহাহ সিত্তা ও গায়রে সিহাহ সিত্তা নামের কোন বিভক্তির নির্দেশ না আল্লাহ দিয়েছেন, না রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর হাদীসকে এভাবে বিভক্ত করেছেন পরবর্তীরা। তাই এ বিভক্তি ছেড়ে দেয়া উচিত নয় কি?
৫
সাংগঠনিকভাবে আহলে কুরআন বা আহলে হাদীস নামের কোন দল গঠন করার নির্দেশ না আল্লাহ তাআলা দিয়েছেন না রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়েছেন। সংগঠনিক এসব দল পরবর্তীতে সৃষ্টি হয়েছে। আহলে কুরআন সাবায়ীদের দ্বারা। আর আহলে হাদীস ইংরেজদের দ্বারা।
সুতরাং এসব ভ্রান্ত ফিরক্বার বিভক্তি ছেড়ে দেয়া কি জরুরী নয়?
কথিত আহলে হাদীসদের কয়েকটি দল
১) জমিয়তে আহলে হাদীস বাংলাদেশ।
২) আহলে হাদীস আন্দোলন বাংলাদেশ।
৩) আহলে হাদীস যুব আন্দোলন।
৪) ফিরক্বায়ে গুরাবায়ে আহলে হাদীস।
৫) কানফারেন্স আহলে হাদীস।
৬) আমীরে শরীয়ত সূবাহ বাহার।
৭) ফিরক্বায়ে সানাবিয়্যাহ।
৮) ফিরক্বায়ে আতায়িয়্যাহ।
৯) ফিরক্বায়ে শরীফিয়্যাহ।
১০) ফিরক্বায়ে গজনবিয়্যাহ।
১১) ইন্তিখাবে মৌলবী মুহীউদ্দীন।
১২) জামাআতুল মুসলিমীন।
এভাবে আহলে হাদীস নাম দিয়ে দলে দলে বিভক্ত হওয়ার নির্দেশ না আল্লাহ দিয়েছেন, না রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দিয়েছেন। তাই এসব আহলে হাদীস নামধারীরা কেন পরিত্যজ্য নয়?
শুধু দলে দলে বিভক্তই হয়নি ওরা। বরং একদল আরেক দলকে গোমরাহ, মুশরিক ইত্যাদি বলে গালাগালিও করে থাকে। যা তাদের লেকচার ও বিভিন্ন লেখা বই পড়লে যেকোন পাঠকই বুঝতে পারবেন। এভাবে বিভক্তির দিকে আহবানকারীর মুখে একতার কথা মানায় কি না? এটি আম তৌহিদী জনতার হাতেই ছেড়ে দিলাম এর বিচারের ভার।
আল্লাহ তাআলা একতার নামে বিভক্তির দিকে আহবানকারী ভ্রান্ত আহলে হাদীস ফিরক্বা থেকে মুসলিম জাতিকে হিফাযত করুন।
والله اعلم بالصواب