আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেন, আমি নবী করিম সাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামকে রোজা রাখার জন্য এত বেশি আগ্রহী হতে দেখিনি, যতটা দেখেছি এ আশুরার দিন এবং এ মাস অর্থাৎ রমজান মাসের রোজার প্রতি। (বোখারি)।
হাদিসে আছে, আশুরার দিন রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, তিনি পূর্ববর্তী ১ বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন। (মুসলিম)
বরকতময় মাস মহররম। হিজরি সনের প্রথম মাস। কোরআনুল কারিমে বলা হয়েছে, আশহুরুল হুরুম। হারামকৃত মাস। পবিত্র মাস। সম্মানিত মাস। চারটি মাসকে একসঙ্গে আশহুরুল হুরুম বলা হয়। জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব। কোরআনে এ চারটি মাসে নিজের প্রতি জুলুম করতে নিষেধ করা হয়েছে। এখানে জুলুম মানে গোনাহ। অন্য মাসে তো গোনাহ করবেই না, এ মাসগুলোতে আরও বাড়তি গুরুত্বের সঙ্গে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকবে। আল্লাহ সৃষ্টিকুল থেকে খাঁটি ও উৎকৃষ্টগুলোকে বাছাই করেছেন; কিছু ফেরেশতাকে দূত হিসেবে বাছাই করেছেন। তদ্রƒপ কিছু মানুষকেও বিশেষভাবে বাছাই করেছেন। কোরআনকে তার কথা হিসেবে বাছাই করেছেন। জমিন থেকে বাছাই করেছেন মসজিদগুলোকে। মাসগুলো থেকে বাছাই করেছেন রমজান ও সম্মানিত চারটি মাসকে। দিনগুলো থেকে বাছাই করেছেন জুমার দিনকে। রাতগুলো থেকে লাইলাতুল কদরকে বাছাই করেছেন। মহররম মাসকে আল্লাহর মাস বলা হয়েছে।
মহররম মাসে অধিক রোজার ফজিলত
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হচ্ছে আল্লাহর মাস মহররম মাসের রোজা। নবীজি (সা.) মদিনায় এসে দেখলেন, ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখছে। জানতে চাইলেন, তারা উত্তর দিলÑ এটি একটি ভালো দিন। এ দিনে আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাইলকে দুশমন থেকে রক্ষা করেছেন। এ জন্য শুকরিয়াস্বরূপ মুসা (আ.) রোজা রেখেছেন। নবীজি (সা.) বললেন, মুসাকে অনুসরণের ব্যাপারে আমি তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। অতঃপর তিনি রোজা রেখেছেন এবং রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। (বোখারি)। আশুরার দিন নুহ (আ.) এর কিস্তিও জুদি পর্বতে স্থির হয়ে ছিল। নুহ (আ.) শুকরিয়াস্বরূপ এদিন রোজা রেখেছিলেন। জাহেলি যুগেও আরব সমাজে আশুরার রোজা রাখার প্রচলন ছিল। কোরাইশরা সম্ভবত ইবরাহিম (আ.) এর শরিয়তের ওপর নির্ভর করেই এ আমলটা করত। ইহুদিরা তো আশুরার দিনকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। খায়বরের অধিবাসীরা (ইহুদিরা) এদিন নিজ স্ত্রীদের অলঙ্কারাদি ও ব্যাজ পরিধান করাত।
আশুরার রোজার ফজিলত
আবদুল্লাহ বিন আব্বাস (রা.) বলেন, আমি নবী করিম (সা.) কে রোজা রাখার জন্য এত বেশি আগ্রহী হতে দেখিনি, যতটা দেখেছি এ আশুরার দিন এবং এ মাস অর্থাৎ রমজান মাসের রোজার প্রতি। (বোখারি)। হাদিসে আছে, আশুরার দিন রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশা করি, তিনি পূর্ববর্তী এক বছরের পাপ ক্ষমা করে দেবেন। (মুসলিম)। তবে এ গোনাহ হবে সগিরা। কবিরা গোনাহ তো তওবা ছাড়া মাফ হয় না। আবার এমন ধারণা করাও ঠিক নয়, আমার তো গোনাহ মাফ হয়েই গেছে, তাহলে আবার নেমে পড়ি?
এটাও স্মর্তব্য, নফল রোজা না রেখে, কাজা আদায় করাই ভালো। তবে কাজা রোজা দায়িত্বে থাকা অবস্থায়ও অতিরিক্ত নফল রোজা রাখা যাবে।
আশুরার সঙ্গে নবম দিনকে মিলিয়ে রোজা রাখাও মুস্তাহাব। তাহলে ইহুদিদের সঙ্গে মিল থাকে না। তারা তো ১০ তারিখে রোজা রাখে। নবীজি (সা.) একবার বলেছিলেন, আমি আগামী বছর বেঁচে থাকলে, ১০ তারিখের সঙ্গে নবম বা একাদশ দিনের রোজাও মিলিয়ে রাখব। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পরের বছর মহররম আসার আগেই নবীজি (সা.) ইন্তেকাল করেন। সাহাবায়ে কেরাম আশুরার রোজার সঙ্গে আরেকটি (৯ বা ১১ তারিখের) রোজা গুরুত্বের সঙ্গে রাখতেন। এটাকে তারা মুস্তাহাব মনে করতেন। আর শুধু আশুরার দিন রোজা রাখাকে মাকরুহ মনে করতেন।
যে কাজগুলো বর্জনীয়
কিছু লোক এ মাসে, বিশেষ করে আশুরার দিন মাতম করে। বেপরোয়া শোক প্রকাশ করে। এটা গোনাহ। ইসলাম সব সময় সবর ও ইস্তিকামতের শিক্ষা দেয়। চিৎকার করে বুক চাপড়ে কান্নাকাটি করা, পরিধেয় জামা-কাপড় ছিঁড়ে ফেলার সঙ্গে ইসলামের দূরতম সম্পর্কও নেই। ইসলামের বিধান হলো, একজন মারা যাওয়ার তিন দিন পরে শোক প্রকাশ করা যাবে না। শুধু মহিলাদের জন্য স্বামী মারা যাওয়ার পর ৪ মাস ১০ দিন পর্যন্ত শোক পালন করা আবশ্যক। স্বামী ছাড়া আর কারও জন্য শোক পালন করা জায়েজ নেই, বাবা-ভাই-ছেলে হলেও না। কিছু লোক হোসাইনের (রা.) জন্য শোক পালন করে। মহররম মাসে ভালো পোশাক পরে না। স্ত্রীর কাছে যায় না। চেয়ার উল্টে রাখে। এছাড়া আরও নানা রকম রুসুম-রেওয়াজ পালন করে। অথচ হোসাইন (রা.) এর শাহাদতের পর ১৪০০ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে।
তিনি যখন শাহাদতবরণ করেছেন, তখন তার জন্য শোক প্রকাশ করা ঠিক ছিল। তাই বলে আজীবন শোক প্রকাশ করা তো শরিয়ত অনুমোদন করে না। শোকসভা করা, সেটা হোসাইনের (রা.) জন্যই হোক বা অন্য কারও জন্যই হোক, জায়েজ নেই। কারণ, শরিয়ত সবরের আদেশ করে। এর বিপরীতে শোক সৃষ্টি করা গোনাহ।
মুফতি শফী (রহ.) বলেন, ইসলামের পুরো ইতিহাসটাই তো শহীদানের মিছিলে ভর্তি। এক আবু বকর (রা.) ছাড়া তিন খলিফাই তো শহীদ। আমরা যদি শহীদানের তালিকা করি তাহলে তালিকা পুরো বছরের ৩৬৫ দিন ছাড়িয়ে আরও লম্বা হয়ে যাবে। শুধু ওহুদেই তো ৭০ জন সাহাবা শহীদ হয়েছেন। ১২ জনের মতো বদরে শহীদ হয়েছেন। প্রতিটি ঘণ্টায়ও যদি একজন শহীদের জন্য শোক করা তবুও তো তালিকা ফুরাবে না। ওমর, উসমান, আলী, হাসান (রা.) কয়জনের জন্য শোক প্রকাশ করব?
তাহলে যারা ইসলামের জন্য, নবীজির (সা.) জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন তাদের জন্য শোক করা কি গোনাহ? উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য এটাই তো গর্বের বিষয় যে, যিনি শহীদ হয়েছেন, তিনি অনেক উচ্চ মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন। তারা আল্লাহর দেয়া জানের হক আদায় করেছেন। দ্বীনের জন্য জীবন দেয়া অনেক বড় এক সাফল্য। একজন সাহসী মানুষের বৈশিষ্ট্য হলো সত্যের জন্য জীবন বিলিয়ে দেয়া। কত কারি, কত হাফেজ, কত আলেম দ্বীনের তরে জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। এটা তারা করেছেন দ্বীনের খাতিরে। এর প্রতিদান আল্লাহর কাছে। কবর লেপামোছা জায়েজ। কিন্তু এ কাজের জন্য মহররম মাসকে নির্ধারণ করা বৈধ নয়। যখনই সুযোগ হবে কবর লেপেমুছে রাখবে। কবর জেয়ারত করা সওয়াবের কাজ, এর দ্বারা মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়। কিন্তু কিছু মানুষ কবর জেয়ারতের জন্য ১০ মহররমকেই নির্ধারণ করে রাখে। পুরো বছরে স্রেফ এ একদিনই কবর জেয়ারতের জন্য যায়। অন্য সময় ভুলেও এমুখো হয় না। এটা ঠিক নয়। কিছু মানুষ আশুরার দিন কবরের ওপর গাছের সবুজ ডাল পুঁতে রাখে। তারা মনে করে, এতে আজাব বন্ধ থাকবে। এ কাজকে অবশ্যক মনে করার মাঝে কিছু খারাপ দিক আছে। এক. অনাবশ্যক কাজকে আবশ্যক মনে করা হয়। দুই. কিছু লোক মনে করতে শুরু করে, কাঁচা ডাল রাখলে নিশ্চিতই আজাব দূর হয়ে যাবে। এজন্যই এসব করা ঠিক নয়।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সকলপ্রকার বিদাআত থেকে হেফাজত করে সঠিকভাবে আমল করার তাওফিক দিক।
আমীন