বিবাহ মানবজীবনের এক অপরিহার্য অনুষংগ। মানব প্রজন্মের সুরক্ষা, সুষ্ঠু ও সুস্থ পরিবার গঠন এবং সামাজিক শান্তি-শৃংখলার জন্য বিবাহ এক নির্বিকল্প ব্যবস্থা। এর উপকার বহুমাত্রিক। ব্যক্তিজীবনের শৃংখলা, ব্যক্তির মানসিক ও দৈহিক সুস্থতা এবং ধৈর্য, সাহসিকতা, সহমর্মিতা প্রভৃতি গুণাবলীসহ তার সুপ্ত প্রতিভার বিকাশসাধনে বিবাহের ভূমিকা অভাবনীয়। বিবাহই জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে কঠোর পরিশ্রম এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে মিতব্যয় ও মিতাচারের প্রধান চালিকাশক্তি। এটা স্বভাবগত কাম-চাহিদার নিষ্কলুষ সমাধান, মানুষের দুঃখ-কষ্ট লাঘব ও শ্রান্তিমোচন এবং দেহে সজীবতা ও মনে শান্তি সঞ্চারের মোক্ষম দাওয়াই। পরিবারে-পরিবারে, খান্দানে-খান্দানে ও বংশ-গোত্রে প্রীতিবন্ধনের এক চমৎকার ব্যবস্থা নর-নারীর এই শরীআতী সম্মিলন। সর্বোপরি এটা আখিরাতের কল্যাণ লাভেরও এক উৎকৃষ্ট অবলম্বন। সুতরাং বিবাহ ইসলামের অন্যতম প্রধান সামাজিক বিধান এবং মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এক গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত।
মানবসভ্যতার জন্য অপরিহার্য ও অতি কল্যাণময় এ ব্যবস্থাটিকে স্বভাবধর্ম ইসলাম খুবই সহজসাধ্য করেছে, যাতে এর কল্যাণ থেকে কেউ বঞ্চিত না হয় এবং সর্বস্তরের মানুষই এর সুফল ভোগের সুযোগ পায়। সুতরাং এর জন্য খুব বেশি আচার-বিচার, উদ্যোগ-আয়োজন ও জাঁকজমকের দরকার হয় না। নেই কঠিন কোন শর্ত ও দুর্ভর ব্যয়ের ঝক্কি। খরচ বলতে কেবল স্ত্রীর মোহর।
আর আচার-অনুষ্ঠান বলতে কেবল সাক্ষীদের সামনে বর-কনের পক্ষ হতে ইজাব-কবূল। ব্যস এতটুকুতেই বিবাহ হয়ে যায়। অতপর ওলীমা করা সুন্নত ও পুণ্যের কাজ বটে, কিন্তু বিবাহ সিদ্ধ হওয়ার জন্য তা শর্ত নয়। এছাড়া প্রচলিত কিছু কাজ কেবলই জায়েয পর্যায়ের। তা করা না করা সমান। করলেও কোন অসুবিধা নেই, না করলেও দোষ নেই। কেননা বিবাহ শুদ্ধ হওয়া-না হওয়া কিংবা উত্তম-অনুত্তম হওয়ার সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।
কিন্তু আফসোস, মানুষ এমন কল্যাণকর অথচ সহজসাধ্য একটা বিষয়কে চিন্তা- চেতনা ও ব্যবহারিক বাড়াবাড়ির কঠিন গেড়াকলে আবদ্ধ করে ফেলেছে। যদ্দরুন সাধের বিবাহ আজ রীতিমত আতঙ্কের যূপকাষ্ঠ। বিবাহের নামোচ্চারণ মাত্র পাত্রপক্ষের চোখে ভেসে ওঠে এলোমেলো অর্থশ্রাদ্ধের মহামচ্ছব আর কন্যাপক্ষের তো নামই পড়ে গেছে কন্যাদায়গ্রস্ত।
মূল সমস্যা চিন্তা- চেতনাগত। মানুষ বিবাহকে দেখছে কেবলই পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে। আরও সত্যি করে বলতে গেলে বাণিজ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে। অথচ ইসলামী বিবাহ পার্থিব বিষয়মাত্র নয়। এর সাথে আখিরাতের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। এর আছে ইবাদতের মহিমা, যে কারণে এ প্রশ্নও উঠেছে যে, বিবাহ করে সাংসারিক জীবন-যাপন উত্তম, না সংসারবিমুখ হয়ে নামায-রোযা-যিকর ইত্যাদির জন্য নিজেকে উৎসর্গিত রাখা উত্তম। অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে সাংসারিক জীবন যাপনই উত্তম। তার ফলে প্রত্যক্ষ ইবাদতের মাহাত্ম্য অনেক বেড়ে যায়।
এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি বিবাহ করল সে তার দ্বীনের অর্ধেক পূর্ণ করে ফেলল, এখন বাকি অর্ধেকের জন্য সে আল্লাহকে ভয় করুক। (বায়হাকী, শুআবুল ঈমান, হাদীস : ৫৪৮৬)
বিবাহের ফযীলত সম্পর্কে আরও অনেক হাদীস আছে। এটা সমস্ত নবীর আদর্শ। এরই মাধ্যমে মানব প্রজন্মের সূচনা ও বিস্তার ঘটেছে। এটা সদাকায়ে জারিয়ার মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন ছওয়াব লাভের প্রকৃষ্ট মাধ্যম। কিন্তু বর্তমান সমাজ বিবাহকে তার এ মহিমা থেকে অনেক নিচে নামিয়ে ফেলেছে। বিবাহের ব্যাপারে চিন্তা-চেতনার ঘটেছে দারুণ অবক্ষয়। মানুষ শিকার হয়ে পড়েছে শৈথিল্যমূলক প্রান্তিক ভাবনার। তারা এর পারলৌকিক যোগসূত্রকে ছিন্ন করে ফেলেছে। এর দ্বারা পুণ্যার্জনের কোন চেতনা তারা পোষণ করছে না। এক্ষেত্রে দুনিয়াই তাদের মুখ্য। বরং কেবল দুনিয়াবী লাভ-লোকসানেই নজর রাখা হচ্ছে। মেয়েপক্ষ দেখছে কেবলই ছেলের বা তার বাবার অর্থকড়ি, তার অবর্তমানে বড় চাকরি, তাও না থাকলে এমন কোন যোগ্যতা যার দৌলতে আশুদিনে অনেক কামাতে পারবে। ছেলেপক্ষের কাছেও বিচার্য মেয়ের বাবার অর্থ-সম্পদ বা কী মেয়ের নিজের উপার্জন-ক্ষমতা। যৌতুকের বহর কি হবে সেদিকে তো নজর থাকছেই। এসব বৈষয়িক ও অনৈতিক ভাবনার উৎপত্তি হয়েছে বিবাহ সম্পর্কে চিন্তাগত অবক্ষয় থেকেই এবং এ অবক্ষয় থেকেই বিবাহের সাথে যুক্ত হয়েছে আরও অনেক উপসর্গ। তা না হবে কেন? যে কাজের সাথে পারলৌকিক কোন সম্বন্ধ চিন্তা করা হয় না, তার সাথে বৈধ-অবৈধ নির্বিশেষে ভোগবাদিতার সব উপাদান যুক্ত হতে বাধ্য। সুতরাং বর্তমান সমাজের বিবাহগুলো তার সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত বিচিত্র ভোগলোলুপতায় ঠাসা। কারও বিবাহ যেন আর সকলের অবাধ-উদ্দাম-উৎকর্ষই ফূর্তির উপলক্ষ। চোখের হোক আদেখ দেখার বাহারী আয়োজন। কানে হোক বর্জ্য-অশ্রাব্যের ধারাবরিষণ। বল্গাহারা আনন্দে-নৃত্যে দেহমনের মৌজ-মৌতাতে সব একশা-একাকার হয়ে যাক, তবেই না এটা বিবাহ।
এভাবেই ভাবনার দৈন্যে মুসলিম-জীবনের এক পবিত্র সূচনা আজ রকমারি পাপের মচ্ছবে পর্যবসিত। দৃষ্টিভংগীগত এ প্রান্তিকতা থেকে উৎপন্ন মোটাদাগের কয়েকটি অনর্থ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক, যার প্রত্যেকটি বৈবাহিক মধ্যপন্থার চরম সীমালংঘন।
পরবর্তী অংশসমূহ=
পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে ইসলামে মধ্যমপন্থা ও পরিমিতবোধের গুরুত্ব
মোহর নির্ধারণে ইসলামে মধ্যমপন্থা ও পরিমিতবোধের গুরুত্ব
পরিমিতবোধ ও মধ্যমপন্হার উপর অন্যান্য উপস্হপনা সমূহ:
আয় ব্যয় এর ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ
Pingback: পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে ইসলামে মধ্যমপন্থা ও পরিমিতবোধের গুরুত্ব | ইসলাম বার্তা
Pingback: বিবাহে অভিভাবকের ভূমিকা-১ | ইসলাম বার্তা