চারটি মহৎ গুণ

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, চারটি গুণ এতই মূল্যবান যে, তা যদি তোমার মধ্যে থাকে তাহলে দুনিয়ার আর কী তোমার নেই সে চিন্তারই দরকার নেই।

এই চার গুণ কী

এই চার গুণ হচ্ছে

১. আমানত রক্ষা করা।

২. সত্য কথা বলা।

৩. উত্তম চরিত্রের অধিকারী হওয়া।

৪. রিজিক হালাল হওয়া। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৬৩৬৫

এই চারটি ছিফাত শুনতে সাধারণ ও ছোট ছোট কয়েকটি বাক্য মনে হলেও মূলত এর মাঝে পুরো দ্বীন ও তার সকল গুণাবলি নিহীত রয়েছে।

এবার আমরা এই চার ছিফাতের প্রতিটির উপর পৃথক পৃথক আলোকপাত করব ইনশাআল্লাহ।

প্রথম গুণ : আমানত রক্ষা করা

এ বিষয়ে কুরআন-হাদীসে অত্যন্ত তাকিদ এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন:
(তরজমা) নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে এই আদেশ করেছেন যে, আমানতসমূহ তার হকদারের কাছে পৌঁছে দাও।-সূরা নিসা : ৫৮

হাদীস শরীফে আমানতের খেয়ানত করাকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুনাফিকের খাছলত বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, তিনটা স্বভাব যার মাঝে পাওয়া যাবে সে পাক্কা মুনাফিক। ১. ওয়াদা খেলাফ করা ২. আমানতের খেয়ানত করা ৩. মিথ্যা বলা।

এই তিন মন্দ স্বভাবকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুনাফিকের আলামত বলেছেন। সুতরাং একজন মুসলমানের মাঝে কখনোই এগুলো থাকতে পারে না।

মোটকথা, আমানত এমন একটি গুণ, যার মাধ্যমে একজন মুসলমান প্রকৃত মুসলমান হয়।

নবুওয়তের পূর্বে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কয়েকটি প্রসিদ্ধ গুণ

নবুওয়ত লাভের আগে থেকেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদিক ও আমীন অর্থাৎ সত্যবাদী ও আমানতদার বলে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে বড় দুশমনও তাঁর কাছে আমানত রাখতে প্রস্ত্তত ছিল।

এমনকি তিনি যখন মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করলেন তখনও তাঁর কাছে মক্কাবাসীর আমানত গচ্ছিত ছিল এবং সে আমানত মালিকদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি আলী রা.কে মক্কায় রেখে গিয়েছিলেন। তো এটা ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশেষ গুণ, যা মক্কার কাফেরদের মাঝেও প্রসিদ্ধ ছিল।

সুতরাং তাঁর উম্মত হওয়ার দাবিই হল আমানত রক্ষার বিষয়ে বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া।

আমানত শব্দের অর্থের ব্যাপকতা

সাধারণত আমানতের অর্থ এই মনে করা হয় যে, কেউ আমার কাছে কিছু অর্থ-সম্পদ গচ্ছিত রাখল এবং আমি তা হেফাযত করে রাখলাম। এরপর যখন সে তা ফেরত চাইল তখন তা ফেরত দিলাম। আর খেয়ানত অর্থ এ সম্পদ ফেরত না দিয়ে আত্মসাৎ করে ফেলা।

যেহেতু জেনে বুঝে আমাদের অনেকের ক্ষেত্রে আলহামদুলিল্লাহ এ জাতীয় খেয়ানত হয় না তাই আমরা নিজেদেরকে আমানতদার মনে করে সন্তুষ্ট। অথচ আমানতের অর্থ ও মর্ম অনেক ব্যাপক। অনেক বিষয় এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এক বয়ানে আমি এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম এবং তা ছাপার হরফেও এসে গেছে।

দ্বিতীয় গুণ : সত্য কথা বলা

হাদীসে বর্ণিত দ্বিতীয় গুণ ‘সিদকে হাদীস’ বা সত্য কথা বলা। অর্থাৎ মিথ্যা না বলা, ভুল বর্ণনা করা থেকে বেঁচে থাকা। দেখুন, একটি হচ্ছে সরাসরি মিথ্যা, যাকে সকলেই মিথ্যা মনে করে। যাদের মনে আল্লাহর ফযল ও করমে দ্বীন মোতাবেক চলার ও মিথ্যা থেকে বেঁচে থাকার প্রেরণা আছে তারা সাধারণত এ ধরনের সরাসরি মিথ্যা থেকে দূরে থাকেন। কিন্তু কিছু মিথ্যা এমন আছে, যা প্রচ্ছন্ন এবং এমনভাবে সমাজের রগ-রেশায় মিশে গেছে যে, তা মিথ্যা ও গুনাহর কাজ হওয়ার অনুভূতিটুকুও মানুষের থাকে না।

যেমন, একজনের কথা অন্যজনের কাছে বর্ণনা করার ক্ষেত্রে অসতর্কতা। এর ফলে একজন থেকে অন্যজন পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে তা এমনভাবে বিকৃত হয় যে, আসল কথার সাথে তার কোনো মিলই থাকে না। একটা অবাস্তব কথা ছড়িয়ে পড়ে। এটা কেন হয়? এজন্য হয় যে, পূর্ব থেকেই এই প্রস্ত্ততি ছিল না যে, কথাটি যেভাবে বলা হচ্ছে সেভাবেই তা স্মরণ রাখব এবং নিখুঁতভাবে বর্ণনা করব। বরং এক রকম শোনে, আরেক রকম বোঝে, এরপর বর্ণনার সময় নিজের তরফ থেকে ঝাল-মরিচ লাগিয়ে বর্ণনা করা হয়। এরপর একে মিথ্যাও মনে করা হয় না।

বক্তব্যের বিকৃতির ধরণ

একবার আমার কাছে কয়েক জায়গা থেকে চিঠি এল যে, জনৈক ব্যক্তি বিভিন্ন আলোচনায় আপনার উদ্ধৃতিতে বলছেন, টেপ রেকর্ডারে কুরআন তিলাওয়াত শোনা গান শোনার চেয়েও বড় গুনাহ। অথচ আমার (আমলনামা লিপিবদ্ধকারী) ফেরেশতাদেরও জানা নেই, আমি কখনো এমন মাসআলা বলেছি কি না। আমি চিন্তা করতে লাগলাম যে, এই কথাটা কোত্থেকে এল? তখন আমার মনে পড়ল যে, এক মজলিসে আমি ওয়ায করেছি। তখন এক ব্যক্তি আমাকে প্রশ্ন করেছিল যে, টেপ রেকর্ডারে সিজদার আয়াতের তিলাওয়াত শুনলে সিজদা ওয়াজিব হবে কি না? উত্তরে আমি বলেছিলাম, টেপ রেকর্ডারে যে তিলাওয়াত হয় তা প্রকৃত তিলাওয়াতের মধ্যে পড়ে না। এ কারণে তা শুনলে সাজদায়ে তিলাওয়াত ওয়াজিব হয় না। তো যেহেতু আমি বলেছি যে, টেপ রেকর্ডারের তিলাওয়াত প্রকৃত তিলাওয়াতের মতো নয় তাই সে এখান থেকে বুঝে নিয়েছে যে, প্রকৃত তিলাওয়াত না হওয়ার কারণে এটা হারাম বা নাজায়েয। এরপর আরো এক কাঠি বাড়িয়ে বলতে লাগল, টেপ রেকর্ডারে তিলাওয়াত শোনা গান শোনার চেয়েও খারাপ।

আর তা প্রচার করল আমার উদ্ধৃতিতে। এ ব্যক্তি তো জেনে-বুঝে মিথ্যা বলেনি; বরং অসতর্কতা ও অমনোযোগিতা থেকে নিজের ধারণাকে আমার কথা বলে বর্ণনা করেছে।

একটি স্বপ্ন, যা আমার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে

গত কয়েক দিন আগে জনাব কলীম ছাহেব আমাকে বললেন, কিছু দিন আগে যেখানে ভূমিকম্প হয়েছিল সে এলাকায় এটা ছড়িয়ে পড়েছে যে, আপনি স্বপ্নে দেখেছেন, এখন রমযান মাস বলে ভূমিকম্পের মাত্রা অনেক কম ছিল। ঈদের পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হবে।

বিভিন্ন জায়গা থেকে আমাকে ফোনে প্রশ্নও করা হচ্ছে। আগের কথার তো একটা সূত্র পেয়েছিলাম, কিন্তু এর কোনো সূত্রই তো খুঁজে পাচ্ছি না। আল্লাহ তাআলাই ভালো জানেন, কীভাবে, কোত্থেকে তা বের হল।

বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা

মোটকথা, বর্ণনার ক্ষেত্রে সতর্কতা আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছে। অথচ শরীয়ত এ বিষয়ে কত গুরুত্ব দিয়েছে যে, কারো মুখ থেকে যেন কোনো ভুল কথা বের না হয়। শরীয়ত যত গুরুত্ব দিয়েছে আমরা তত উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছি। ফলে ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি হচ্ছে, অবাস্তব ও ভিত্তিহীন কথাবার্তা ছড়িয়ে পড়ছে।

সুতরাং হয়তো কারো কোনো কথা বর্ণনা করাই বাদ দিন। আর যদি বর্ণনা করতেই হয় তাহলে আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের উপর রহম করুন, কথাটি ভালোভাবে স্মরণ রাখুন এবং সঠিকভাবে বর্ণনা করুন।

একজন মুহাদ্দিসের সতর্কতা

আল্লামা খতীব বাগদাদী রাহ. কিফায়া গ্রন্থে একজন মুহাদ্দিসের কথা আলোচনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ হাদীস বর্ণনা করার সময় বলেন, অমুক আমাকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তিনি একটি হাদীস বর্ণনা করার সময় বলতেন, ‘ছানা’ অর্থাৎ ‘হাদ্দাছানা’ পুরো শব্দ না বলে শুধু শেষ অংশ ছানা বলতেন। শাগরিদরা জিজ্ঞাসা করল, আপনি পুরো হাদ্দাছানা না বলে শুধু ছানা কেন বলেন?

তিনি উত্তরে বললেন, আমি উস্তাদের দরসে পৌঁছতে পৌঁছতে দরস শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমি পৌঁছার আগেই উস্তাদ ‘হাদ্দাছানা’ শব্দের প্রথম অংশ ‘হাদ্দা’ বলে ফেলেছেন। আমি শুধু তার মুখে ‘ছানা’ শব্দটুকু শুনেছি। সুতরাং এই হাদীসটি বর্ণনা করার সময় আমি যদি বলি, আমি আমার উস্তাদকে ‘হাদ্দাছানা‘ বলতে শুনেছি তাহলে তো কথাটা মিথ্যা হয়ে যাবে।

আলহামদুলিল্লাহ, এত সতর্কতার সাথে রাসূলের হাদীস আমাদের নিকট পৌঁছেছে। আর মুহাদ্দিসগণ রাসূলের বাণী সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এত সতর্কতা অবলম্বন করেছেন।

হযরত থানভী রাহ.-এর সতর্কতা

আমার আববাজান রাহ. বলতেন, হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. নিন্দা করে বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত ‘‘সাধারণ নিয়মে বড়’’ এমন কেউ তোমাদের মধ্যে থাকবে ততক্ষণ তার সাথে মাশওয়ারা কর। যখন এমন কেউ থাকবে না তখন সমপর্যায়ের লোকদের সাথে মাশওয়ারা কর। যদি এমন কেউ না থাকে তাহলে ছোটদের সাথে মাশওয়ারা কর। মাশওয়ারা ছাড়া কোনো কাজ করবে না। এরপর তিনি বললেন, ‘‘সাধারণ নিয়মে বড়’’ একথা এজন্য বলেছি যে, বাস্তবে কে বড় কে ছোট তা তো জানেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা। কারণ বড় ছোটর প্রকৃত মাপকাঠি তো তাকওয়া ও আল্লাহর আনুগত্য। কিন্তু সাধারণ নিয়মে পিতা সন্তান থেকে বড়, উস্তাদ শাগরিদ থেকে বড়, শায়েখ তার মুরিদ থেকে বড়। এসব হচ্ছে নিয়মের বড়-ছোট। বাস্তবে কে বড় তা তো আল্লাহই ভালো জানেন।

এরপর আববাজান বললেন, হযরত তো বলতে পারতেন, যতক্ষণ বড়রা থাকেন ততক্ষণ তাদের সাথে মশওয়ারা কর। কিন্তু যেহেতু চিন্তা ও মস্তিষ্কে সতর্কতার নিক্তি ঝোলানো আছে যে, মুখ থেকে যেন কোনো অবস্থাতেই কোনো অবাস্তব কথা বের না হয় তাই সরাসরি বড় না বলে ‘‘সাধারণ নিয়মে বড়’’ বলেছেন।

গাফলত ও উদাসীনতা অতি বড় বিপদ

যখন মানুষের মাঝে সহীহ কথা বলার ফিকির আসে তখন আল্লাহ তার অন্তরে সহীহ শব্দ ঢেলে দেন। সে তখন ঐ সহীহ শব্দ ব্যবহার করে। কিন্তু এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল অসতর্কতা ও উদাসীনতা। এদিকে ভ্রুক্ষেপই না করা যে, আমার মুখ দিয়ে কী কথা বের হচ্ছে। বেপরোয়াভাবে অবাস্তব কথা বলতে থাকা। এই প্রবণতা আমাদেরকে বর্ণনায় অসতর্ক বানিয়ে দিয়েছে।

বর্ণনায় সত্যবাদিতা হল মেপে মেপে কথা বলা এবং একশ ভাগ সহীহ বলতে চেষ্টা করা। কোনো কথা বলতে গিয়ে এমন অতিরঞ্জণ না করা যে, তা মিথ্যার পর্যায়ে চলে যায়। কথা বলতে গিয়ে তো আমাদের কিছু না কিছু অতিরঞ্জণ হয়ে যায়, কিন্তু তা যদি মিথ্যার পর্যায়ে চলে যায়। তাহলে এটা হবে বর্ণনায় সত্যবাদিতার পরিপন্থী। মোটকথা যখনই আমরা কিছু বলব সতর্কতার সাথে বলব।

আমার কথা যদি সর্বদা রেকর্ড করা হত

কথার ক্ষেত্রে কিভাবে আমরা সতর্ক হতে পারি আমার আববাজান রাহ. এর একটা সুন্দর মাপকাঠি বলে দিয়েছেন এবং আলহামদুলিল্লাহ তা আমার দিলে বসে গেছে। তিনি বলেছেন, যখন তুমি কোনো কথা বলবে বা লিখবে তখন চিন্তা করবে যে, এটা আমাকে আদালতে প্রমাণ করতে হবে। আপনারাও এ বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখুন যদি আপনাদেরকে বলা হয় বেলা দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত আপনি যত কথা বলবেন সব রেকর্ড করা হবে এবং তা থানায় পেশ করা হবে। এর ভিত্তিতে আপনাকে গ্রেফতারির বিষয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এখন বলুন, ঐ দুই ঘণ্টা কেমন সতর্কতার সাথে কথা বলবেন? আপনি তো সাবধান থাকবেনই ঐ সময় অন্য কেউ আপনার সাথে কথা বলতে এলে তাকেও বলবেন, ভাই, আমার কথা রেকর্ড হচ্ছে এবং উল্টাপাল্টা কিছু বললে আমার গ্রেফতারির পরোয়ানা আসতে পারে। সুতরাং এ মুহূর্তে আমার সাথে কোনো অপ্রয়োজনীয় কথা বলো না এবং আমার দ্বারাও অপ্রয়োজনীয় ও ত্রুটিপূর্ণ কথা বলো না। মোটকথা, তখন আমাদের মুখ থেকে মাপা মাপা কথা বের হবে এবং শুধু প্রয়োজনীয় ও মূল্যবান কথাই বলা হবে।

সকল কথাই রেকর্ড হচ্ছে

আমার আববাজান রাহ. বলতেন, ভাই! আল্লাহর পক্ষ থেকে সবার সাথেই তো রেকর্ডার লাগানো আছে। কিয়ামতের দিন এই রেকর্ডারের ভিত্তিতে আপনার সম্পর্কে ফয়সালা হবে। সুতরাং দুনিয়ার আদালতের পক্ষ থেকে আপনার কথা রেকর্ড করা হলে যেমন সতর্কতার সাথে কথা বলতেন ঠিক ঐ রকম সতর্কতার সাথেই কথা বলুন। সর্বদা স্মরণ রাখুন, আমার যবান থেকে যা কিছু বের হচ্ছে আখেরাতে এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং বুঝে-শুনে, আল্লাহকে ভয় করে কথা বলা আমার সার্বক্ষণিক কর্তব্য।

যাদের দিলে আল্লাহ তাআলার খওফ ও আযমত আছে তারা সতর্কতার সাথে কথা বলে এবং প্রয়োজন ছাড়া মুখ খোলে না। আল্লাহ তাআলা স্বীয় রহমতে আমাদেরকে আমানতদারি ও সত্যবাদিতার গুণ দান করুন। যাতে আমরা যা কিছু বলি একশ ভাগ সঠিক বলতে পারি।

তৃতীয় গুণ : উত্তম চরিত্র ও সুন্দর ব্যবহার

হাদীসে বর্ণিত তৃতীয় গুণ হল উত্তম চরিত্র ও সুন্দর ব্যবহার।

এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মুমিন হয় উত্তম চরিত্রের অধিকারী। অর্থাৎ সে বদমেজাজী, বিদ্বেষ ভাবাপন্ন ও মানুষের সাথে রুক্ষ আচরণকারী হয় না।

এটা মুমিনের শান নয়। মুসলমান তো অন্যের সাথে নম্র আচরণ করবে, রুক্ষ আচরণ করবে না।

আখলাক কাকে বলে

এখন দেখতে হবে উত্তম আখলাক কী এবং কীভাবে তা অর্জন করা যায়। এটা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। অল্প সময়ে তা আলোচনা করা সম্ভব নয়। এখানে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়, কারো সাথে মুচকি হেসে কথা বলাই উত্তম আখলাক নয়। হ্যাঁ, এটাও উত্তম আখলাকের একটি অংশ। কিন্তু যদি এমন হয় যে, উপরে উপরে মুচকি হেসে কথা বলল, আর মন বিদ্বেষে পরিপূর্ণ থাকল তাহলে সেটা হবে কৃত্রিমতা। এর মাঝে ইখলাস নেই এবং এটা মুমিনের শান নয়।

পশ্চিমা বিশ্ব ও উত্তম ব্যবহার

এখন পশ্চিমা দুনিয়ায় আচার-আচরণ সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হচ্ছে-কীভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবেন, কীভাবে মেলামেশা করবেন, কীভাবে কথা বলবেন এবং কীভাবে মানুষকে নিজের প্রতি আগ্রহী করবেন ইত্যাদি। এ সকল বিষয় এখন পশ্চিমাদের কাছে খুব জনপ্রিয়। কিন্তু এ সকল প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হল অন্যকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করা এবং নিজের মহত্ব অন্যের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত করা। কিন্তু দ্বীন ইসলামে যে উত্তম আখলাকের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে উত্তম আখলাকের কথা বলেছেন তার উদ্দেশ্য কখনোই নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য অন্যকে বশে আনা নয়; বরং ভালো  একজন মুসলমান হিসেবে আমার কর্তব্য, অন্যের সাথে সুন্দর আচরণ করা। তো এ দুই শিক্ষার  মাঝে রয়েছে আসমান-যমীনের ব্যবধান। তাদের ভালো আচরণের উদ্দেশ্য, গ্রাহক আকৃষ্ট করা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি করা। পক্ষান্তরে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে উত্তম আখলাকের শিক্ষা দিয়েছেন তার উদ্দেশ্য পার্থিব স্বার্থ হাসিল করা নয়। বরং এজন্য যে, একজন মুসলিম হিসেবে আমার কর্তব্য, অন্য মুসলিম ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে মিলিত হওয়া এবং ভালো আচরণ করা।

নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তোমরা একে অপরের সাথে হাসিমুখে সাক্ষাত করবে-এটিও ছাদাকাহ“।

ব্যবসায়িক স্বার্থে সুন্দর আচরণ

অনেকে পশ্চিমাদের প্রশংসা করে বলে, তাদের আচার-আচরণ অনেক উন্নত। এমনকি এ মুগ্ধতার কারণে কখনো কখনো তাদেরকে ইসলাম ও মুসলমানদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ মনে করা হয়। তাদের মধ্যে কিছু লোক হয়তো স্বভাবগতভাবেই ভদ্র ও সুশীল, কিন্তু সাধারণভাবে তাদের যে ভদ্রতা ও সৌজন্য তা ব্যবসায়িক। দোকানের সেলসম্যান যদি গ্রাহকদের সাথে হাসিমুখে কথা না বলে এবং ভদ্র ব্যবহার না করে তাহলে কেউ তার কাছে আসবে না। তাই সে নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থে ভালো আচরণ করতে বাধ্য।

কেনো সেলসম্যানের ভদ্রতা ও সৌজন্যে মুগ্ধ হয়ে আপনি যদি মনে করেন সে পণ্যের মূল্যও আপনার কাছে কম রাখবে তাহলে ভুল করবেন। অনুরোধ করে দেখুন, সে আপনাকে সরি বলে ওখান থেকে সরে যাবে। কারণ তার সকল ভদ্রতা ও সৌজন্য তো এ জন্যই ছিল যে, কিভাবে সে আপনাকে আকৃষ্ট করতে পারে এবং আপনার কাছে অধিক মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে পারে। তো এই ভদ্রতা ও সৌজন্যকে কি আখলাক বলে?!

আখলাক তো মানুষের অন্তর থেকে হয়, আল্লাহকে রাজিখুশি করার জন্য এবং আখিরাতের ছওয়াবের জন্য হয়, দুনিয়ার কোনো স্বার্থ এর সাথে জড়িত থাকে না।

উত্তম আখলাকের অধিকারী কীভাবে হওয়া যাবে

এখন প্রশ্ন হল, উত্তম আখলাক কীভাবে পয়দা হবে। গোটা তাসাউফ এবং তাসাউফের সকল মেহনতের উদ্দেশ্য উত্তম আখলাকের অধিকারী হওয়া। এ উদ্দেশ্যে মানুষ বুযুর্গদের সোহবতে যায়। এর একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যবস্থা আছে, যার বিস্তারিত আলোচনা এখন সম্ভব নয়। তবে আমারে মতে যে বিষয়টি উত্তম আখলাকের চাবিকাঠি তা আপনাদেরকে বলে দিচ্ছি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমলের তাওফীক দান করুন।

এই চাবিকাঠি হচ্ছে ‘তাওয়াযূ’ বা বিনয়। এটিই উত্তম আখলাকের মূল।

যার মধ্যে তাওয়াযূ আছে সে কখনো বদ আখলাক ও দুর্ব্যবহারকারী হতে পারে না। এ কারণে আখলাক বিরোধী কোনো আচরণ প্রকাশ পাওয়ার অর্থই হচ্ছে তার মধ্যে তাকাববুর এসেছে। তাওয়াযূ অর্থ অন্যকে নিজের থেকে বড় মনে করা এবং নিজেকে ছোট মনে করা।

যদি কারো অন্তরে এ কথা বসে যায় যে, আমি ছোট আর সবাই আমার চেয়ে বড় তাহলে আর কিছুর দরকার নেই। হয়তো বয়স ও ইলমের দিক থেকে বড় নয়, কিন্তু আল্লাহর কাছে মাকবুলিয়ত ও তাকওয়ার দিক থেকে বড়। হয়তো এই মুহূর্তে বড় নয় কিন্তু ভবিষ্যতে আমার চেয়ে বড় হতে পারে।

তাওয়াযূ ও বিনয়

অন্তরে যেন নিজের বড়ত্বের চিন্তা না থাকে। বরং ভাবুন, আমার যা কিছু আছে সব আল্লাহর দান। যখন ইচ্ছা করেন তিনি তা ছিনিয়েও নিতে পারেন। আমার নিজস্ব কোনো গুণ নেই। আল্লাহ তাআলা অন্যদেরকে অনেক গুণ ও বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। তাই তাদের অনেক কামাল ও যোগ্যতা রয়েছে।

এভাবে নিজেকে বড় মনে না করার নামই তাওয়াযূ বা বিনয়।

যখন কারো অন্তরে তাওয়াযূ থাকবে এবং সে বিশ্বাস করবে যে, আমি ছোট, অন্য সবাই বড় তাহলে সে কি কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারবে? পারবে না। বড়র সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করে না।

মানুষ খারাপ আচরণ করে তখনই যখন সে নিজেকে বড় মনে করে এবং অন্যকে ছোট ও তুচ্ছ মনে করে। সে চিন্তা করে যে, আমি তো বড়, সবার কর্তব্য আমার সম্মান করা ও অনুগত থাকা। কিন্তু ঐ লোকটা আমার যথাযথ সম্মান করেনি। সুতরাং সে অন্যায় করেছে। সে আমার ভালো আচরণ পাওয়ার যোগ্য নয়। তো তাকাববুর ও অহংকারই হচ্ছে সকল মন্দ আচরণের মূল।

তাওয়াযূ দ্বারা মর্যাদা বৃদ্ধি পায়

তাওয়াযূ পয়দা হলে বদআখলাকী হয় না। এজন্যই আমি বলি, সুন্দর ব্যবহারের মূল  হচ্ছে তাওয়াযূ ও বিনয়। পক্ষান্তরে বদ আখলাক ও দুর্ব্যবহারের জড় হল তাকাববুর ও অহংকার।

কেউ যদি উজব (আত্মমুগ্ধতা) ও তাকাববুর (অহংকার) এ দুই প্রবণতার চিকিৎসা করে এবং তাওয়াযূ হাসিলের চেষ্টা করে; কোনো আল্লাহ ওয়ালার সোহবতে থেকে তাওয়াযূ অর্জন করে তাহলে ইনশাআল্লাহ দুর্ব্যবহারের ব্যধি তার কাছেও আসতে পারবে না।

হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

من تواضع لله رفعه الله

অর্থাৎ যে আল্লাহর (সন্তুষ্টির) জন্য নিজেকে নীচু করে আল্লাহ তাকে উঁচু করে দেন।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১১২৯৯

নিজের হাকীকত সম্পর্কে চিন্তা করুন

তাওয়াযূ হাসিলের জন্য আমাকে সবার আগে নিজের হাকীকত সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে। আমি কী? কীভাবে আমার সৃষ্টি? কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা দুই শব্দে মানুষের হাকীকত বলে দিয়েছেন।

من اى شيئ خلقه من نطفة خلقه

যদি মানুষ এটুকু চিন্তা করে যে, তাকে কী থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে তাহলে তার সকল অহংকার দূর হয়ে যাবে। তার সৃষ্টির মূলে এক ফোটা বীর্য।

অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-

الم نخلقكم من ماء مهين

আমি কি তোমাদেরকে এক নিকৃষ্ট ও গান্দা পানি থেকে সৃষ্টি করিনি? যদি মানুষ তার মূল সম্পর্কে চিন্তা করে তাহলে তার মস্তিষ্কে অহংকার আসতে পারে না।

তেমনি যদি তার শেষ পরিণতি নিয়ে ভাবে যে, যখন তার মৃত্যু হবে তখন তার প্রিয়জনেরাও তাকে ঘরে রাখবে না। কারণ ঘরে রাখলে পচে যাবে এবং দুর্গন্ধ বের হবে। সুতরাং কবরে দাফন করে আসবে।

তো এই যখন তোমার শুরু ও শেষ তাহলে কীসের তাকাববুর? কী নিয়ে অহংকার?

শৌচাগার থেকেও শিখতে পারি

হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. বলতেন, কখনো যদি নিজেকে বড় মনে হয় তাহলে বাইতুল খালায় (পায়খানায়) তোমার যে অবস্থা হয় তা নিয়ে একটু চিন্তা কর। ঐ অবস্থায় কেউ যদি তোমাকে দেখে তাহলে কেমন হবে? ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে যাবে এবং দ্রুত সে ঐ স্থান ত্যাগ করবে!

আল্লাহ তাআলা দেহের উপর চামড়ার আবরণ দিয়ে দিয়েছেন। তা যদি সরিয়ে ফেলা হয় তাহলে তো ভিতরে শুধু নাপাকি আর নাপাকি। কোথাও রক্ত, কোথাও পুঁজ, কোথাও পেশাব, কোথাও পায়খানা। আল্লাহর দেওয়া চামড়ার আবরণ তোমার সব নাপাকি ঢেকে রেখেছে। তো এই তো তোমার হাকীকত! অথচ তুমি অহংকার কর-আমি এই, আমি সেই। আমি এই করব, সেই করব। আল্লাহ যদি তোমার মাথার স্ক্রুটা একটু ঢিলা করে দেন তাহলেই সব শেষ, তোমার সকল হম্বিতম্বি খতম। এরপরও কি নিজেকে বড় মনে করা যায়? তো অহংকার হচ্ছে শয়তানের ধোকা। শয়তান তোমাকে তোমার প্রকৃত অবস্থা ভুলিয়ে দিয়েছে। সুতরাং নিজের হাকীকত নিয়ে চিন্তা কর ও ফিরে এস।

নিজেকে সেবক মনে কর

আমাদের হযরত ডাক্তার আবদুল হাই আরেফী রাহ. বড় মূল্যবান কথা বলতেন যে, সকল ঝগড়া-ফাসাদের মূল হল আমরা নিজেকে মাখদুম মনে করি, আমরা চাই, সবাই আমার খাতির-তোয়াজ করুক, আমার খেদমত করুক। ভাই! নিজেকে মাখদুম নয়, খাদেম ও সেবক মনে করুন। আমি সবার খাদেম। ছোটরও খাদেম, বড়রও খাদেম। যদিও খেদমতের ধরন আলাদা আলাদা। তবে খাদেম আমি সবার। উস্তাদ যিনি ছাত্রকে পড়াচ্ছেন তিনি আসলে ছাত্রের খেদমত করছেন। এজন্য উস্তাদের উচিত নিজেকে তালিবুল ইলমের খাদেম মনে করা। তেমনি নিজেকে নিজের বিবি-বাচ্চার খাদেম মনে করুন। ভাই-বোন ও আত্মীয়স্বজনের খাদেম মনে করুন। এভাবে সবার খাদেম হয়ে যান এবং যার সাথেই সাক্ষাত হয়, মনে করুন আমি তার খাদেম।

পদমর্যাদা হিসেবে আচরণ ভিন্ন বিষয়

কর্তা ও প্রতাবশালীর সামনে সবাই বিনয় প্রকাশ করে, তার আদেশ পালন করে কিন্তু প্রকৃত বিনয় ও তাওয়াযূ, যা প্রশংসণীয় তা হল, নিজের সমপর্যায়ের লোকদের সাথে এবং নিজের থেকে ছোটদের সাথে তাওয়াযূর আচরণ করা। এটা ঠিক যে, কখনো কখনো দায়িত্বের কারণে কাউকে শাসন করতে হয়, কখনো কখনো শাস্তিও দিতে হয়। যেমন উস্তাদ শাগরিদকে শাস্তি দেয়, পিতা সন্তানকে শাস্তি দেয়। এ শাসন ও শাস্তিও খেদমত। সেসময়ও দায়িত্বশীলকে ভাবতে হবে যে, কর্তব্যের খাতিরে আমাকে এই কাজ করতে হচ্ছে। এজন্য নয় যে, আমি বড়, সে ছোট। কারণ এমন তো হতে পারে, তার মর্যাদা আল্লাহর কাছে আমার চেয়ে বেশি।

একটি সুন্দর উদাহরণ

হযরত থানভী রাহ. একটি সুন্দর উদাহরণ দিতেন যে, কোনো বাদশা যদি তার কোনো গোলামকে পাহারাদার নিযুক্ত করে বলে, ‘দরজায় দাঁড়াও, অনুমতি ছাড়া কাউকে ভিতরে আসতে দিবে না।’ এখন যদি কোনো শাহযাদাও আসে তাহলে ঐ পাহারাদারের অধিকার আছে, সে বলবে, আগে আপনার পরিচয় দিন, তারপর ভিতরে যাওয়ার অনুমতি পাবেন। শাহযাদা যদি জোর করে ভিতরে প্রবেশ করতে চায় তাহলে ঐ পাহারাদারের বাধা দেওয়ারও অধিকার আছে।

এখানে তো সাদা চোখে গোলাম শাহযাদাকে বাধা দিচ্ছে এবং তার উপর কর্তৃত্ব খাটাচ্ছে, কিন্তু বলুন, এ দুজনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? পাহারাদার যখন শাহযাদাকে বাধা দিচ্ছে তখন সেও ভাবছে না যে, আমি শাহযাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ; বরং ঐ সময়ও সে জানে, শাহযাদাই শ্রেষ্ঠ, তবে কর্তব্যের খাতিরে এখন আমি তাকে বাধা দিতে বাধ্য।

উস্তাদ, শায়েখ ও পিতার শাসন

তো কোনো উস্তাদ যখন শাগরিদকে শাসন করছেন, শায়খ মুরিদকে শাসন করছেন, পিতা পুত্রকে শাসন করছেন তখন তাদেরও কর্তব্য, একথা চিন্তা করা যে, আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি মাত্র। বাস্তবে হয়তো তার মর্যাদা আল্লাহর কাছে আমার চেয়ে অনেক বেশি।

থানভী রাহ.-এর নিয়ম

হযরত থানভী রাহ.-এর খানকায় অবস্থানকারীদেরকে নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলতে হত। কেউ নিয়মের খেলাফ করলে তিনি শাসন ও তিরস্কার করতেন। এ সম্পর্কে তিনি বলতেন, আলহামদুলিল্লাহ, যখন আমি কাউকে তিরস্কার করি তখন চিন্তা করি যে, আমি  পাহারাদার আর সে শাহযাদা। তবে তিরস্কার করা আমার কর্তব্য, তাই তাকে তিরস্কার করছি। নতুবা সে তো আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ।

দ্বিতীয়ত শাসনের সময়ও মনে মনে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করি যে, আল্লাহ, আমি যেভাবে তাকে পাকড়াও করছি, তুমি আমাকে আখিরাতে পাকড়াও করো না।

তো বলুন, যিনি নিজের চেয়ে ছোটদের ক্ষেত্রেও মনে করেন, সে শাহযাদা আর আমি চৌকিদার, তার অন্তরে অহংকার কীভাবে আসতে পারে।

আল্লাহ আমাদেরকেও এমন তাওয়াযূ হাসিল করার তাওফীক দান করুন।

তাওয়াযূ আসে বুযুর্গদের সোহবত দ্বারা

সোহবতের দ্বারা তাওয়াযূ পয়দা হয়। বিনয়ীদের সোহবত ইখতিয়ার করুন আপনার মাঝে বিনয় আসবে। অহংকারীর সংশ্রবে থাকলে আপনার মাঝেও অহংকার আসবে। সুতরাং যাদেরকে আল্লাহ তাআলা তাওয়াযূ দান করেছেন তাদের সোহবতে থাকুন এবং নিজের হাকীকত নিয়ে চিন্তা করুন এবং একথা ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করুন যে, আখিরাতের পুরস্কার অহংকারীর জন্য নয়। আখিরাতের পুরস্কার তারই প্রাপ্য, যে বিনয়ী, যে অবনতমস্তক, যে নিজেকে বড় মনে করে না।

চতুর্থ গুণ : রিযিক হালাল হওয়া

চতুর্থ যে গুণের কথা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন তা হল-

عفة في طعمة

রিযিকের পবিত্রতা তথা রিযিক হালাল হওয়া। ‘ইফফাত’ শব্দের অর্থ নিষ্কলুষ হওয়া, সর্বপ্রকার পঙ্কিলতামুক্ত হওয়া। এখানে ‘ইফফাত’ শব্দ আনার দ্বারা এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, প্রত্যক্ষ হারাম থেকে তো বেঁচে থাকবেই, যেখানে হারামের সম্ভাবনা আছে, সন্দেহ আছে, তা থেকেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।

কখনো কখনো কোনো জিনিস ফতোয়ার বিচারে হালাল হয়, কিন্তু সন্দেহ থেকে যায়। এই সন্দেহের অবস্থায় বাস্তবেও যদি জিনিসটা হারাম হয় তাহলেও তা খেলে আপনার গুনাহ হবে না। কারণ আপনি ফতোয়া অনুযায়ী আমল করেছেন। এতকিছুর পরও বাস্তবেই যদি ঐ জিনিসটা হারাম হয়ে থাকে তাহলে তার বদ আছর তো আখলাকের উপর পড়বেই।

হারামের কালিমা ও তার মন্দ প্রভাব

আমাদের তো দিলের অনুভূতি-শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। এজন্য আমরা হারাম খেয়ে নিই, সন্দেহপূর্ণ জিনিস খেয়ে নিই। কিছুই খবর থাকে না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা যাদেরকে সহীহ অনুভূতি-শক্তি দান করেছেন তারা হালাল-হারামের পার্থক্য অনুভব করতে পারেন। হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতুবী রাহ. বলতেন, আমি একবার এক দাওয়াতে গেলাম। আর আগে থেকে আমার জানা ছিল না যে, ঐ ব্যক্তির উপার্জন হারাম। না জানার কারণে এই ভেবে চলে গিয়েছিলাম যে, সে তো একজন মুসলমান। সুতরাং তার উপার্জন হালাল হবে-এটাই স্বাভাবিক।  কিছু খানা খেয়েও ফেললাম। একপর্যায়ে জানতে পারলাম, তার উপার্জন হারাম। তখন সাথে সাথে খানা ছেড়ে উঠে গেলাম। কিন্তু ঐ যে না জেনে কয়েক লোকমা খেয়েছিলাম, তার বদ আছর কয়েক মাস পর্যন্ত অনুভব করতাম। আর তা হল, বারবার মনে গুনাহর ইচ্ছা জাগত যে, অমুক গুনাহ করি, অমুক গুনাহ করি। অথচ ফতোয়ার দৃষ্টিতে তো ঐ খানা হালাল ছিল। কারণ হারামের বিষয়টি জানা ছিল না। আর সে তো মুসলমান, মুসলমানের খানা হালাল হবে-এটাই স্বাভাবিক।

হালাল খানার নূর ও নূরানিয়ত

একটু চিন্তা করুন, আমরা কী হালতে আছি। আমাদের খবরই নেই যে, কিসের মাঝে নূর আর কিসে যুলমত বা অন্ধকার।

হযরত নানুতুবী রাহ. একটি ঘটনা বলতেন। দেওবন্দে এক ব্যক্তি ছিল, যে ঘাস কেটে কেটে বাজারে বিক্রি করত এবং সে উপার্জন দিয়েই চলত। তার এই সামান্য উপার্জন থেকেই দু এক পয়সা করে বাঁচিয়ে তা দিয়ে দেওবন্দের বড় বড় উস্তাদদের দাওয়াত করত। সে দাওয়াতে সে শুকনো রুটি ও ডাল পাকাত। হযরত নানুতুবী রাহ. বলেন, আমি মাসের পর মাস ঐ আল্লাহর বান্দার দাওয়াতের প্রতিক্ষায় থাকতাম। কবে সে দাওয়াত করবে। কারণ যেদিন তার দাওয়াত খেতাম সেদিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত অন্তরে তার খানার নূর অনুভব করতাম।

মোটকথা, যদি খানার পবিত্রতা ও নূরানিয়ত লাভ করতে হয় তাহলে সন্দেহপূর্ণ খানা থেকেও যথাসম্ভব বিরত থাকতে হবে।

আল্লাহ আমাকে এবং আপনাদের সকলকে এই চারটি মহৎ গুণ অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

চরিত্র,

Leave a Comment

Your email address will not be published.