তাকওয়া হাসিলের উপায়-২

পূর্ববর্তী অংশ=
তাকওয়া হাসিলের উপায়-১

পীর-মুরিদীর স্বরূপ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগ থেকেই সোহবতের সিলসিলা চলে আসছে। দ্বীন শেখার জন্য মানুষ বুযুর্গানে দ্বীনের সোহবতে যায়, ইসলাহী তাআল্লুক কায়েম করে।

কিন্তু এখন তো পীর-মুরিদীকে এক ধাঁধাঁর বিষয় বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এ বিষয়ে আসল কথা এই যে, মানুষ তার নিজের রোগ নিজে চিহ্নিত করতে পারে না। তাকে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। যেমন অহংকার একটি রোগ। শরীয়তে তা হারাম। এতে কারো দ্বিমত নেই। কিন্তু কোনো অহংকারী ব্যক্তি কখনোই স্বীকার করে না যে, আমি অহংকারী। আরবী সাহিত্যে এর চমৎকার একটি উদাহরণ রয়েছে। উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় কেউ দাঁড়ালে তার কাছে নিচের সবকিছুই ছোট ছোট মনে হবে। মানুষ, ঘরবাড়ি, গাছপালা সবকিছুই দেখা যাবে অনেক ছোট। এখন তার কাছে মনে হবে দুনিয়ার সবকিছুই ছোট, শুধু আমি অনেক বড়। পক্ষান্তরে নিচের লোকজনও পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ানো লোকটিকে আকারে ছোট দেখতে পাবে।

তেমনিভাবে অহংকারী ব্যক্তি মনে করে, দুনিয়ার সবাই ছোট, শুধু আমি বড়। অথচ অন্যদের দৃষ্টিতে সে তুচ্ছ হয়ে ধরা পড়ে। যদিও মানুষ তার প্রভাব-প্রতিপত্তির ভয়ে তার সামনে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে, মুখে কিছুই বলে না। কিন্তু মনে মনে তার প্রতি বিরক্ত থাকে। অহংকারী নিজে বুঝতেই পারে না যে, আমি ভয়ানক এক রোগে আক্রান্ত।

অহংকার এক ভয়াবহ রোগ

অহংকার বড় ভয়ানক ব্যাধি। এই ব্যাধি থেকে আরো অনেক রোগ সৃষ্টি হয়। ক্রোধ, হিংসা-বিদ্বেষ, অত্যাচার ইত্যাদি সবকিছুর মূলে অহংকার। অথচ অহংকারী নিজে তা অনুভব করে না।

এখন এই রোগ চিহ্নিত করে এর চিকিৎসা কে করবে? এজন্যই শায়খের দরকার। এটাই পীর-মুরিদির আসল প্রয়োজন এজন্যই।

টাখনুর নিচে পোশাক পরা

হাদীস শরীফে এসেছে, টাখনুর নিচে পোশাক পরিধানকারী জাহান্নামী হবে। অনেকেই বলে থাকেন যে, অন্য হাদীসে এর কারণ হিসেবে অহংকারের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ অহংকারবশত টাখনুর নিচে পোশাক পরলে জাহান্নামে যেতে হবে, কিন্তু আমরা তো অহংকার করে পরি না। ফ্যাশন হিসেবে পরি। এতে তো কোনো দোষ নেই!

আমি তাদেরকে প্রশ্ন করি, ভাই! বলুন তো পৃথিবীতে এমন কে আছে, যে দৃঢ়তার সাথে বলতে পারে যে, আমার অন্তরে সামান্য অহংকারও নেই? নিশ্চয়ই নেই। তেমনিভাবে অন্যের ব্যাপারেও নিশ্চিতভাবে কেউ এ দাবি করতে পারে না যে, তার মনে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। শুধু দোজাহানের সর্দার প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে বলা যাবে যে, তিনি সম্পূর্ণ অহংকারমুক্ত ছিলেন। অন্য কারো সম্পর্কেই একথা বলা যায় না। অথচ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো কখনো টাখনুর নিচে কাপড় পরেননি। তো আমাদের উচিত তাঁর অনুসরণ ও অনুকরণ করা।

দ্বিতীয় কথা হল, এমন একজন অহংকারী খুঁজে বের করুন, যে তার অহংকারের কথা স্বীকার করে! তাহলে এ দাবি কীভাবে করা যায় যে, আমার মাঝে অহংকার নেই, তাই আমি টাখনুর নিচে পোশাক পরতে পারি?

অবশ্য কারো যদি ওযর বা অপারগতা থাকে তাহলে ভিন্ন কথা। যেমন আবু বকর রা. সম্পর্কে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর কাপড় আপনা আপনি নিচে ঝুলে পড়ত। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আরজ করলে তিনি তাঁর অপারগতা দেখে বললেন, অসুবিধা নেই, তুমি তো আর স্বেচ্ছায় অহংকারবশত করছ না।

যাহোক, যেভাবে রোগী নিজে তার দৈহিক রোগ-ব্যাধি নির্ণয় করতে পারে না, তাকে অভিজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হয় তেমনিভাবে অন্তরেরও অনেক রোগ-ব্যাধি আছে, যা রোগী নিজে নির্ণয় করতে পারে না। যেমন হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার, রিয়া, যশ-খ্যাতির লোভ, সম্পদের মোহ ইত্যাদি।

এই রোগ-ব্যাধি নির্ণয় ও নিরাময়ের জন্য বুযুর্গানে দ্বীনের শরণাপন্ন হতে হয়। তিনি এর চিকিৎসা করেন। কুরআন মজীদের ভাষায় একেই বলে তাযকিয়া। আর এটিই তাসাওউফের মূল কথা।

আগের যুগে মানুষ ইসলাহে নফসের জন্য কোনো বুযুর্গের শরণাপন্ন হলে মাসের পর মাস তার সাহচর্যে থেকে রিয়াযত-মোজাহাদা করতে হত। এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনা আপনারাও হয়তো কিতাবপত্রে পড়েছেন। এখন এই যুগে যদি আমাকে-আপনাকে বলা হয়, অন্তরের ইসলাহের জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে খানকায় গিয়ে এত মাস পড়ে থাকতে হবে, কঠিন রিয়াযত-মুজাহাদা করতে হবে তাহলে আমাদের জন্য তা সম্ভব হবে না। তাই আমাদের দুর্বলতার কারণে বুযুর্গানে দ্বীন ইসলাহে নফসের এমন তরীকা বাতলে দিয়েছেন, যা আমরা সহজেই অনুসরণ করতে পারি। খুব বেশি মেহনতও করতে হয় না। আবার উদ্দেশ্যও অর্জিত হয়ে যায়।

আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য হল, আল্লাহ তাআলার সাথে আমাদের তাআল্লুক যেন কায়েম হয়ে যায় এবং মজবুত হয়ে যায়। তাই হযরত হাকীমুল উম্মত রাহ. এমন কিছু সহজ ‘নুসখা’ বলে দিয়েছেন, যা ঠিকমতো মেনে চললে আগের যুগের দীর্ঘ মেহনত দ্বারা যা হাসিল হত এখন অল্প মেহনতেই তা হাসিল হবে এবং আল্লাহ তাআলার সাথে তাআল্লুক মজবুত হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

প্রথম আমল : দুআ

অর্থাৎ আল্লাহর কাছে চাওয়া এবং চাইতেই থাকা। এর একটি উপায় হল, জীবনের সকল কাজে মাসনূন দুআর ইহতিমাম করা। যেমন ঘুম থেকে উঠে দুআ পড়া, ইস্তিঞ্জাখানায় যেতে ও বের হতে দুআ পড়া, ফজরের সময় মসজিদে যেতে দুআ পড়া, ঘরে ঢুকতে ও বের হতে দুআ পড়া, খাবারের শুরুতে ও শেষে দুআ পড়া। মোটকথা, জীবনের প্রতিটি কাজে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে দুআ শিখিয়েছেন তা পাঠ করা। মানুষ একে সামান্য আমল মনে করে। আসলে তা অসামান্য আমল।

কারণ এ সকল দুআর মাঝে একটি দুআও যদি কবুল হয়ে যায় তাহলেও মানুষের জীবন সার্থক। যেমন মসজিদে প্রবেশ করার সময় পড়তে হয়-

اللهماللهم افتح لي أبواب رحمتك

افتحليأبوابرحمتك

অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমার জন্য আপনার রহমতের সকল দরজা খুলে দিন।

এই একটি দুআই যদি কবুল হয়ে যায় তাহলে আমার দুনিয়া-আখেরাতের কোন প্রয়োজনটি অপূর্ণ থাকবে?

ফজরের নামাযে মসজিদে যাওয়ার সময় পড়তে হয়,

اللهماجعلفيقلبينورا،وفيلسانينورا،واجعلفيسمعينورا،واجعلفيبصرينورا،واجعلمنخلفينورا،ومنأمامينورا،واجعلمنفوقينورا،ومنتحتينورا،اللهمأعطنينورااللهم اجعل في قلبي نورا، وفي لساني نورا، واجعل في سمعي نورا، واجعل في بصري نورا، واجعل من خلفي نورا، ومن أمامي نورا، واجعل من فوقي نورا، ومن تحتي نورا، اللهم أعطني نورا.

 

অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমার অন্তরে নূর দান করুন। আমার দৃষ্টিতে নূর দান করুন। আমার ডানে-বায়ে, সামনে-পিছনে, উপরে-নিচে সবদিকে নূর দান করুন এবং আমাকে নূরে নূরান্বিত করুন।’

ভেবে দেখুন, এই দুআটি যদি কবুল হয়ে যায় তাহলে কল্যাণের আর কী বাকি থাকে?

মোটকথা, প্রতিটি মাসনূন দুআই এত গভীর অর্থবহ যে, একটি দুআও যদি কবুল হয়ে যায় তাহলে জীবনের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

মাসনূন দুআর দ্বিতীয় ফায়েদা হচ্ছে, এর দ্বারা আল্লাহ তাআলার সাথে সার্বক্ষণিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সকল কাজে মাসনূন দুআর ইহতিমামের ফলে সর্বাবস্থায় আল্লাহ   তাআলাকে   স্মরণ করার সৌভাগ্য অর্জিত হয়। আমি উদাহরণ দিয়ে থাকি যে, আগে মানুষ সফরে গেলে পরিবারের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকত না। এখন মোবাইল ফোন আবিষ্কৃত হয়েছে। ফলে মানুষ যেখানেই থাকুক, সর্বদা ঘরের সাথে, ছেলেমেয়ের সাথে তার যোগাযোগ থাকে। বিচ্ছিন্নতার মধ্যে সময় কাটাতে হয় না। তেমনিভাবে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে যেসব দুআ শিক্ষা দিয়েছেন তার দ্বারা আল্লাহ তাআলার সাথে বান্দার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ স্থাপিত হয়।

এজন্য ভাই! মাসনূন দুআ কোনো মামুলি বিষয় নয়। এ এক অমূল্য সম্পদ। অজ্ঞতা ও উদাসীনতার কারণে মানুষ এই দুআগুলি মুখস্থও করে না। সময়মতো পড়ারও ইহতিমাম করে না। আরো আফসোসের কথা হচ্ছে, আমরা যারা তালিবে ইলম, হাদীসের কিতাবে এ দুআগুলো পড়ে থাকি, আমরাও খেয়াল করে এগুলো পড়ি না।

আমাদের হযরত আরেফী রাহ. বলতেন-(মাসনূন দুআ তো আছেই) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যত কাজ করতে হয় প্রত্যেক কাজের শুরুতে আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ কর। ঘর থেকে বের হচ্ছ, মনে মনে দুআ কর-‘আয় আল্লাহ! সহজে যানবাহনের ব্যবস্থা করে দাও।’ বাহন পাওয়া গেল তো বল-‘আল্লাহ! নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে দাও।’ রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম লেগে আছে, দুআ কর, ‘হে আল্লাহ! রাস্তা পরিষ্কার করে দাও।’ মোটকথা সকল কাজে সকল অবস্থায় আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ কর। সারাদিনই কোনো না কোনো কাজ থাকে। সকল কাজে আল্লাহ তাআলার কাছে চাইতে থাক। আল্লাহর দুয়ারের ভিখারী হয়ে যাও, তাঁর রহমতের কাঙাল বনে যাও এবং বারবার চাইতে থাক। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জুতার ফিতা ছিঁড়ে গেলেও আল্লাহ তাআলার কাছে চাও।

এ নির্দেশনার মধ্য দিয়ে পেয়ারা নবী যেন উম্মতকে বললেন, ওহে মানুষ! তোমার তো অভাবের শেষ নেই, সব সময় কোনো না কোনো প্রয়োজন লেগেই থাকে। অতএব সব সময় আল্লাহর কাছে চাইতে থাক। মাখলুকের সহায়তা নেওয়ার আগে খালিকের কাছে চাও। তিনিই তো প্রকৃত প্রয়োজন পূরণকারী।

হযরত আরেফী রাহ. আরো বলতেন, মুখে উচ্চারণ করে বলতে না পার, মনে মনে বল। আল্লাহ তো তোমার মনের খবরও জানেন। এভাবে সব সময় কিছু না কিছু চাইতে থাক। তারপর দেখ, জীবনে কেমন বরকত হয়।

দুআ করতে তো পয়সাকড়ি খরচ করতে হয় না। বাড়তি সময় লাগে না। কোনো পরিশ্রমও করতে হয় না। কত সহজ আমল!

অনেকে বলে, কত দুআ করব, দুআ তো কবুল হয় না। মনে রাখবেন, বান্দার প্রতিটি দুআই কবুল হয়। কোনো দুআই ব্যর্থ হয় না। প্রতিটি দুআর কমপক্ষে তিনটি ফায়েদা সম্পূর্ণ নিশ্চিত। এর মধ্যে দুটি তো সাথে সাথে পাওয়া যায়।

প্রথম ফায়েদা হল, দুআ একটি ইবাদত। প্রার্থিত বস্ত্ত পাওয়া যাক বা না যাক দুআর কারণে সাথে সাথে নেকি লেখা হয়। দুআর দ্বারা বান্দার আমলনামা ভারি হতে থাকে।

দ্বিতীয় ফায়েদা হচ্ছে, দুআর দ্বারা বান্দা আল্লাহ তাআলার নিকটবর্তী হয়।

তৃতীয় ফায়েদা হল, বান্দার জন্য প্রার্থিত বিষয় যদি কল্যাণকর হয় তাহলে প্রার্থিত বস্ত্তই তাকে দান করা হয়। অন্যথায় এর বিনিময় আল্লাহ তাআলা তাকে অন্যভাবে দান করেন।

দেখুন, অবুঝ শিশু যদি ধারালো ছুরি নিয়ে খেলতে চায় তাহলে পিতামাতা তার ইচ্ছা পূরণ করেন না। সে যতই কান্নাকাটি করুক, বাবা-মা কখনোই তা দেন না। অন্য কিছু দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করেন। তেমনিভাবে বান্দা অনেক সময় না বুঝে অকল্যাণকর জিনিস চেয়ে বসে। কিন্তু মেহেরবান মালিক তা না দিয়ে অন্যভাবে তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন।

অতএব কোনো দুআই নিষ্ফল হয় না। এত বড় নেআমতকে মানুষ মামুলি মনে করে। ফলে এর বরকত থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। তাই মশক করে করে এর অভ্যাস গড়তে হবে।

হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. বলেন, যখনই কেউ আমার কাছে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করে, সাথে সাথে আমি আল্লাহ তাআলার দিকে রুজু করি এবং মনে মনে দুআ করি, আল্লাহ! এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর আমার অন্তরে দান কর। আল্লাহ তাআলার শোকর, কখনো এর অন্যথা হয় না।

পরবর্তী অংশ=
তাকওয়া হাসিলের উপায়-৩

Leave a Comment

Your email address will not be published.