বান্দার শুকর ও কৃতজ্ঞতা আল্লাহ রাববুল আলামীনের বড় পছন্দ। তিনি চান বান্দা প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর শুকর আদায় করুক, যাতে তিনি নিআমতে–অনুগ্রহে তাকে ভরিয়ে দিতে পারেন এবং যা দিয়েছেন, বাড়তি দান দ্বারা তাকে পরিপূর্ণ করে তুলতে পারেন। যত শুকর ততোধিক দান–এটাই তাঁর বিধান। তিনি এর নিশ্চয় তা দিয়ে বলেন–
لئن شكرتم لازيدنكم
তুমি যদি শুকর আদায় কর, আমি তোমাকে আরও বেশি দেব। শুকর গোযার হওয়ার জন্য এটা এক ঐশী প্রণোদনা। এরকম অনুপ্রেরণা দায়ী আয়াত কুরআন মজীদের পাতায় পাতায় চোখে পড়ে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিওয়াসাল্লাম– এর হাদীস ও আছে প্রচুর। জ্ঞানবান ও বুদ্ধিমানের জন্য তাতে শুকর গোযারির যথেষ্ট সবক রয়েছে। কিন্তু দয়াময় আল্লাহ বান্দাকে তো জানেন। আলস্য ও উদাসীনতা তার মজ্জায় মেশানো। বড় আনমনা। মনের সংযোগ ছাড়া তো সবক হাসিল হয় না। তাই মনোযোগ সৃষ্টির জন্য চোখের সামনে খুলে দিয়েছেন নানা দৃশ্যপট, যা দেখলেই মনে কৃতজ্ঞতা জাগার কথা। প্রতিটি মানুষের সামনেই এমন কত দৃশ্যই না বিরাজ করে, যা তার বহুবিধ সম্পন্নতা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেন বলে দেয়–আহা, চেয়ে দেখ তোমার কত আছে! শিক্ষানবিস মন ঠিকই তা থেকে সবক গ্রহণ করে। সে কৃতজ্ঞতায় আনত হয়ে বলে ওঠে–
اللهم لك الحمد ولك الشكر
রাববুল আলামীনের শিক্ষা কারিকুলাম বড় বিচিত্র এবং তা অতি পূর্ণাঙ্গ। তিনি ছবির সাহায্যে শিক্ষা দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি বান্দাকে হাতে–কলমেও শুকরের তালিম দিয়েছেন। বাস্তব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শুকর গোযার রূপে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেছেন। দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা প্রবাহ ও বয়ে চলা জিন্দেগীর চড়াই–উৎরাইয়ের প্রতিলক্ষ্য করুন না, এ কি কেবলই প্রাকৃতিক আয়ু পূরণের চলমানতা? এর ভেতর কি কোন পরিকল্পিত নির্মাণ নেই? এ কালক্ষয় নয় কি কোন পূর্ণতা বিধানের সুব্যবস্থিত প্রক্রিয়া? আচরিত জীবনে বান্দা যত অবস্থার সম্মুখীন হয়, তার প্রতিটি দ্বারাই মহান আল্লাহ মূলত বান্দাকে তাঁর সত্যিকারের বান্দা রূপে গড়ে তোলার বাস্তব প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। বান্দা যদি তাতে নিজ ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগ করে তবে এ প্রশিক্ষণের সুফল সে পাবেই। ওই ইচ্ছা শক্তির প্রয়োগটুকু তার দরকার, যেহেতু সে জড় নয়, বুদ্ধিমান জীব। বান্দা ইচ্ছা করলে তার প্রতিটি হাল থেকেই নিজেকে কৃতজ্ঞরূপে গড়ে তোলার প্রশিণ নিতে পারে। কিন্তু পার্থিব জীবনে মোহাচ্ছন্ন মানুষ বড় স্থূলদর্শী।
আপাত দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে সে নিজেকে আরও বিস্তার ও আরও গভীরে নিয়ে যেতে পারেনা বা নিয়ে যেতে চায়না। ফলে সে কুদরতি প্রশিক্ষণের সুফল ভোগ থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। কিন্তু সে কি চিরবঞ্চিতই থেকে যাবে? দয়াময় আল্লাহ তাআলার ইচ্ছা সেরকম নয়। তিনি দিতেই চান। সুতরাং পরবর্তী ধাপরূপে তিনি বাধ্যতামূলক কিছু কর্মসূচি দিয়েছেন, যা পালন করলে মানুষ বাস্তবিক শুকর গোযার বান্দা হয়ে ওঠতে পারে। সেই কর্মসূচির অন্যতম প্রধান অংগ রমযানের রোযা।
রোযার অপর নাম সবর। রোযায় সবরের প্রশিক্ষন হয় সরাসরি এবং তা অতি স্পষ্ট। কিন্তু এতে যে শুকরের ও সবক বরং প্রশিক্ষণ রয়েছে সেদিকে নজর কমই যায়। অথচ এ প্রশিক্ষণ ও অস্পষ্ট নয়।
যা যা থেকে বিরত থাকার দ্বারা রোযা হয় তা অতি বড় নিআমত। খাদ্য যে কত বড় নিআমত তা কেনা বোঝে? বরং নিআমত বললে প্রথম নজরটাই খাদ্যের দিকে যায়, যেহেতু এর দ্বারা প্রাণ রক্ষা হয়। আর পানির অপর নামই তো জীবন। তৃতীয় জিনিস স্ত্রীনিবিড় তা হল জীবনাগম ও জীবন বিস্তারের উপায়। সুতরাং এটাও অনেক বড় নিআমত। কিন্তু এসব নিআমত সহজলভ্য ও অনায়াস ভোগ্য হওয়ায় এর উপলব্ধি খুব জাগন্ত নয়। তাই কম মানুষই এর জন্য শুকর আদায় করে। আর করলেও শুকরের ভাষাগত উচ্চারণকেই অধিকাংশ লোক যথেষ্ট মনে করে। ঠিক প্রাণ দিয়ে অনুভব করেনা দয়াময়ের কী মূল্যবান দান, সে সতত ভোগ করে যাচ্ছে! বস্ত্তত রোযা সেই অনুভব সৃষ্টির অতিউত্তম ব্যবস্থা।
রোযা রাখার দ্বারাই উপলব্ধি করা যায় খাদ্য–পানি কত দরকারি জিনিস। পেটেু ক্ষুধা, বুকে তৃষ্ণা, অথচ পানাহার দ্বারা তা নিবারণ করা যাচ্ছেনা। দীর্ঘ সময় এ কষ্ট বরদাশত করতে হচ্ছে আর ক্রমেই কষ্ট তীব্রতর হচ্ছে। অন্য সময় হলে তো ক্ষুদা, পিপসা আঁচ করা মাত্র তা নিবারণের চেষ্টা করা হত, কিন্তু এসময় প্রবৃত্তির যতই চাহিদা হোক এবং শারীরিক যত কষ্টই হোক পানাহার বারণ। ফলে বান্দা চাহিদা দমন করে কষ্ট সয়েই যায়। এভাবেই সময় বয়ে যেতে থাকে। পরিশেষে সূর্যাস্তকালে যখন ইফতার সামগ্রি নিয়ে বসা হয় তখন দিন মনের দমিত সেই চাহিদার উচ্ছিষ্ট স্ফূরণে অকিঞ্চিতকর খাবার ও অমৃতসম মনে হয়। তখন সামনে যা–ই থাকে, পরম সমাদরে তা গ্রহণ করা হয়। এক পেয়ালা পানিতে হৃদয়–মন জুড়িয়ে যায়। ভুখা শিরা–উপশিরায় প্রাণরস সিঞ্চিত হয় আর অনাহারক্লিষ্ট শরীর শক্তি–সজীবতা ফিরে পায়। অকস্মাৎ খুলেযায় চেতনার দ্বার। অনুভব–উপলব্ধির উন্মেষে তখন বুঝে আসে পানির কদর আর খাদ্যের মূল্য। এছাড়া যে জীবন বাঁচেনা, এর সাময়িক অভাবেও যে দেহ মন চলচ্ছক্তি হারায়, সে সত্য তখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। তা দেহকে সচল রাখা ও জীবনকে রক্ষা করার এই অমূল্য অবলম্বন আল্লাহরই তো দান! কত দয়াময় মহান আল্লাহ, যিনি আমাদের জীবন রক্ষার ও আমাদের দেহমনে শক্তি যোগানোর জন্য কত অফুরান নিআমত বিশ্বচরাচরে ছড়িয়ে দিয়েছেন! হররোজ–হরদম আমরা কত সহজে–সাচ্ছন্দ্যে তা ভোগ করে যাচ্ছি! কতটা আনন্দ, কতটা তৃপ্তি, কতটা সুখ–সুধায় আপ্লুত এ জীবন। সুতরাং শুকর আল্লাহর! অশেষ শুকর তাঁর। শুকর এত সব নিআমত দানের জন্য। শুকর এ নিআমতের উপলব্ধি দানের জন্য এবং শুকর তাঁর শুকর গোযারির প্রশিক্ষণ দানের জন্য। রোযা আমাদের অন্তরে এ উপলব্ধিকে উজার করারই এক উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। রোযা রেখেই আমরা বুঝতে পারি পানির মূল্য। উপলব্ধি করতে পারি খাদ্যের কদর। এ উপলব্ধির সত্যিকার স্ফূরণ ঘটে ইফতার কালে। তাই ইফতারের সময়টা শুকর ও কৃতজ্ঞতায় আনত হওয়ার সময়। এসময় প্রাণ খুলে শুকর আদায় করা চাই। ভক্তি–রসে স্নাত কণ্ঠে বলে ওঠা চাই–
اللهم لك الحمد ولك الشكر
হে আল্লাহ! তোমারই সব প্রশংসা। তোমাকেই জানাই সবকৃতজ্ঞতা।
اللهم لك صمت وعليك توكلت وعلى رزقك أفطرت
হে আল্লাহ! তোমারই জন্য রোযা রেখেছি, তোমারই উপর নির্ভর করেছি এবং তোমারই দেওয়া রিযিক দ্বারা ইফতার করেছি।
তোমার দেওয়া নিআমতে ঘুচে গেছে সারা দিনের সব ক্লান্তি। নিবারণ হয়েছে ক্ষুধা–পিপাসা। দেহ মনে ছেয়ে গেছে শান্তি ও প্রশান্তি–
ذهب الظمأ وابتلت العروق وثبت الأجر إن شاء الله
হে আল্লাহ! পিপাসা মিটে গেছে, শিরাগুলো সঞ্চিত হয়েছে আর ইনশাআল্লাহ ছওয়াব তো আছেই।
এভাবে টানা এক মাস চলে নিআমতের মূল্য বোঝা ও শুকর আদায়ের প্রশিক্ষণ। দিনের বেলা পানাহার বর্জন করে ক্ষুদা পিপাসার কষ্ট ভোগ ও সেই কষ্ট ভোগের মাধ্যমে জীবনের জন্য খাদ্য–পানীয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব, পরিশেষে ইফতার করে ক্ষুদা পিপাসার কষ্ট নিবারণ ও তা নিবারণের মাধ্যমে খাদ্য–পানীয়ের মহিমা হৃদয়ঙ্গম–এ ধারাতেই রোযাদারের মন শুকর গোযারির অনুপ্রেরণা পায় এবং শুকরের ভাষা হৃদয়–মন ছাপিয়ে চোখে–মুখে বাঙময় হয়ে ওঠে।
টানা এক মাস এবং মাত্র এক মাস। মাসের শেষ দিকেই শরীর জবাব দিতে শুরু করে দেয়। তারপর আর ও রোযা হলে বড় কষ্ট হত। দয়াময় আল্লাহ সে কষ্ট হতে বান্দাকে মুক্তি দিয়েছেন। এমনকি মাসের ভেতরে ও যদি কষ্ট সীমা ছাড়িয়ে যায় অর্থাৎ অসুস্থতা, বার্ধক্য বা অতিরিক্ত দুর্বলতার কারণে রোযা রাখা সম্ভব না হয় তবে রোযা রাখার ফযীলত থেকে বান্দা যাতে বঞ্চিত না হয় সে সুযোগ ও রাখা হয়েছে। কাযা বা ফিদিয়ার সে সুবিধা ও তাঁর আরেক নিআমত। কৃতজ্ঞতা বোধকে বিকশিত করে তোলার এ ও আরেক সুযোগ। অপারগতার ক্ষেত্রে রমযানের রোযার যদি কোন বিকল্প না থাকত, তবে বান্দা পেত কি মননশীলতা চর্চার এ সুযোগ? কিংবা যদি সারা বছরই থাকত রোযা, তবে অখন্ড চর্চায় সম্ভব হত কি নিজেকে জুড়ে রাখা? সুতরাং বান্দা, শুকর আদায় কর আল্লাহ প্রদত্ত এ সুবিধার জন্য। শুকর গোযারিই এ সুবিধার লক্ষ্য। ইরশাদ হয়েছে– ‘আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই করতে চান। তোমাদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করতে চাননা, যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে পথ দেখিয়েছেন সেজন্য আল্লাহর তাকবীর পাঠ কর এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। (বাকারা :১৮৫)
রমযানের পর রোযা ফরয না থাকার ফলে রোযার অন্যান্য শিক্ষার সাথে শুকর গোযারির শিক্ষাকে ও কাজে লাগানোর সুযোগ লাভ হয়েছে। যখনই পিপাসা তখনই পানি পান এবং যখনই খিদে তখনই খাদ্য গ্রহণ করতে পারার ফলে অন্তরে এই কৃতজ্ঞতাবোধ জাগ্রত হতে পারে যে, ইয়া আল্লাহ! জীবন রক্ষা ও দেহ মনে শক্তি যোগানোর এই যে আয়োজন, এতো তোমারই দান। রোযা রাখিয়ে তুমি বুঝিয়ে দিয়েছ, তোমার এ দান কত মূল্যবান এবং কত প্রয়োজনীয়! সেই মহামূল্যবান নিআমত আবার এই দিন গুলিতে করে দিয়েছ অবারিত। এখন যখনই ইচ্ছা ও যখনই প্রয়োজন তা ভোগ করতে পারছি।
নেই পরিমিত চাহিদা দমনের চাপ,
নেই প্রয়োজন পূরণে বারণ–বাধা।
কতই না অনুগ্রহ তোমার। সুতরাং
اللهم لك الحمد ولك الشكر
এ ভাবে রমযানে রোযা রাখার দ্বারা পানাহার সামগ্রির নিআমত বোঝা ও তার শুকর আদায়ের যে সবক ও প্রশিক্ষণ লাভ হয়েছে তার বদৌলতে সারা বছরই বান্দা এ নিআমতের জন্য শুকর গোযার হয়ে চলতে পারে। সেই সঙ্গে অপরাপর নিআমতের জন্যও। কেননা এক নিআমত তো অন্য নিআমতের ও স্মারক। রোযা রাখার সাথে সমস্ত অঙ্গ–প্রত্যঙ্গসহ শারীরিক সুস্থতা, জান মালের নিরাপত্তা, দারা–পরিবার সকলের পারস্পরিক সৌহার্দ্য–সম্প্রীতি মোটকথা শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুরই সম্পর্ক রয়েছে। আর আল্লাহ তাআলা যেহেতু নিজদয়ায় এসব কিছুর ব্যবস্থা করেছেন তখন রোযার মাধ্যমে যে কৃতজ্ঞতাবোধের উন্মেষ ও বিকাশ নিজ চরিত্রে সাধিত হয়ে যায়, সকল ক্ষেত্রেই তার স্বাক্ষর রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে। কিন্তু বান্দা সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগায় কি? কিংবা ঠিক কতজন তা কাজে লাগায়? আল্লাহ তাআলা আক্ষেপের ভাষায় বলেন–
وقليل من عبادى الشكور
আমার শুকর গোযার বান্দা বড় কম।
হে আল্লাহ! বোঝা যাচ্ছে কম হলে ও তোমার শুকর গোযার বান্দা বাস্তবে আছে। তুমি নিজ দয়ায় আমাদেরকে ও সেই অল্প সংখ্যকদের কাতারভুক্ত করে নাও।