সহযোগী হও, প্রতিপক্ষ হয়ো না

বর্তমান সময়ে আমাদের সামনে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর মাঝে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, দ্বীনের বিভিন্ন শাখার কর্মীদের মাঝে পরস্পর সু-সম্পর্ক ও সহযোগিতার মানসিকতা বিলীন হয়ে গেছে। এমনকি পরিস্থিতি এই দাঁড়িয়েছে যে, কোনো এক শাখার একই ব্যবস্থাপনাধীন লোকদের মাঝেও পরস্পর বড় ধরনের বিরোধ দেখা দেয়। জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় হয় অন্যকে খাটো করে নিজের অবস্থান উর্ধ্বে তুলে ধরার মধ্যে। ঈমান ও কুফর, হক ও বাতিলের দ্বন্দ্বের পরিবর্তে শুরু হয় অন্য এক লড়াই। প্রত্যেকের ধারণা, আমি যা কিছু করছি বা আমার দ্বারা যে কাজ হচ্ছে, সেটিই কাজ, আর সেটিই হক ও সত্য। অন্যরা যা কিছু করছে তা কোনো কাজই না। এভাবে নিজের কাজের প্রতি গুরুত্ব দিতে গিয়ে অন্যের কাজকে তুচ্ছ মনে করার মানসিকতাটাই মুখ্য হয়ে ওঠেছে।

আমাদের মাঝে অপর কোনো শাখার বা সংস্থার কর্মীদের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন ও স্বীকৃতির মানসিকতা হারিয়ে গেছে। যার ফলে আল্লাহপ্রদত্ত মূল্যবান যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতাগুলো অসৎ ও অকল্যাণকর কাজে নষ্ট হচ্ছে। এজন্য জাতির হৃদয়বান ব্যক্তিদের ও দ্বীনের খাদিমদের চেষ্টা করতে হবে এই ব্যাধি দূর করার। যে সৌভাগ্যবানকে আল্লাহ তাআলা দ্বীনের কোনো একটি অংশে খেদমত করার সুযোগ দিয়েছেন, তার কর্তব্য, এই ব্যাধি দূর করার চেষ্টা করা।

আমেরিকায় অনেক ব্যক্তি ও সংগঠন ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আমার পরম শ্রদ্ধেয় মুরববী হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.কে তাঁর আমেরিকা সফরে ওখানকার হিতাকাঙ্খীগণ সে দেশের দ্বীনের কর্মীদের মাঝে পরস্পর সম্পর্ক ও সহযোগিতার অভাবের কথা জানিয়ে চিকিৎসার আবেদন জানালে হযরত মাওলানা রাহ.যে আলোচনা করেছিলেন তার সারমর্ম তুলে ধরছি।

‘‘দুটি বস্ত্তকে একত্রিত করার জন্য একটি মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। দুটি কাগজকে একসাথে মিলানোর জন্য গাম ব্যবহার করতে হয়। একটি কাঠকে একটি কাঠের সাথে যুক্ত করার জন্য বিশেষ ধরনের গাম ব্যবহার করা হয়। তদ্রূপ অন্তরের সাথে অন্তর জোড়া লাগানোর জন্যও একপ্রকার গাম আছে। আর তা হল ইখলাস এবং আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক। ইখলাস ও আল্লাহর সাথে সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই ঘটতে পারে পরস্পরের মিলন।’’

ইখলাসের নিদর্শন ও তা চেনার উপায় সম্পর্কে হযরত সাইয়েদ আহমদ শহীদ রাহ.-এর একটি বাণী আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা হতে পারে। তিনি বলেন, ‘দ্বীনের একটি মৌলিক স্বীকৃত নীতি হল ইখলাস ছাড়া কোনো আমল গ্রহণযোগ্য হয় না। ইখলাসের মাপকাঠি হল, দ্বীনের প্রতিটি কর্মীর প্রতি তার দ্বারা অনুগৃহীত হওয়ার অনুভূতি নিজের অন্তরে সৃষ্টি হওয়া। যদি কারো অন্তরে অন্যের দ্বারা অনুগৃহীত হওয়ার অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তাহলে বোঝা যাবে তার অন্তরে ইখলাস আছে।

ইখলাস হল, প্রত্যেকেই দ্বীনের প্রতিটি কাজকে নিজের কাজ মনে করে করবে। মনে করুন, আপনার একটি বিল্ডিং তৈরী হচ্ছে। কেউ এসে সেখানে শ্রম দিতে লাগল, বালির সাথে সিমেন্ট মিলাতে শুরু করল, ইট এগিয়ে দিল, আপনি কি এটাকে তার অনুগ্রহ বলে মনে করবেন না? আপনি তো মনে করবেন এ কাজগুলো আমারই ছিল, ঐ ব্যক্তি আমার হয়ে আমার কাজটা করে দিচ্ছে।

আল্লামা শাওকানী রাহ.ও এই মূলনীতিটির উল্লেখ করে বলেছেন, যদি কোনো ব্যক্তি কোথাও দ্বীনের কোনো শাখায় কাজ করতে থাকে আর সেখানে তার চেয়েও ভালো কোনো কর্মী চলে আসে, তাহলে ইখলাসের পরিচয় হল আগত ব্যক্তিকে অনুগ্রহকারী মনে করে কাজের সুযোগ দেবে এবং নিজে অন্যস্থানে কাজ শুরু করবে। আগত কর্মীকে পূর্ণ সহযোগিতা করবে। মোটকথা, দ্বীনী প্রতিষ্ঠান ও তার কর্মকর্তাদের মাঝে পরস্পর সম্পর্ক ও সহযোগিতার মূল ভিত্তি হতে পারে ইখলাস ও আল্লাহর সাথে মজবুত সম্পর্ক।

ইখলাস অন্তরের এমন এক অবস্থার নাম, যা প্রতিটি মানুষের থাকা উচিত। অন্তরে ইখলাস সৃষ্টি করা এবং তা বজায় রাখার হুকুমও শরীয়ত দিয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, ইখলাস সৃষ্টি করা এবং তার ওপর দৃঢ় থাকা মানুষের ইখতিয়ার ও সামর্থ্যের ভিতরের বিষয়। কখনো কখনো মানুষ কাজের শুরুতে খুবই মুখলিস থাকে। কিন্তু পরে ইখলাস কমতে কমতে শেষ হয়ে যায়। আবার কখনো এর বিপরীতও ঘটে। কাজের শুরুতে ইখলাস থাকে না, পরে ধীরে ধীরে ইখলাস নসিব হয়ে যায়। অন্তরে ইখলাস সৃষ্টি করা এবং তা বজায় রাখার জন্য অভিজ্ঞতার আলোকে একটি পদ্ধতির কথা বলছি।

অন্যের সাথে মিলে কাজ করবে এবং অন্যের পেছনে পেছনে থাকার মেজাজ তৈরী করবে। মানুষকে নিজের সাথে জুড়ানোর চেষ্টা করবে না। আজকাল দ্বীনের খাদেম এবং ধর্মীয় সংগঠনের কর্মীরা চেষ্টা করেন, সকলেই যেন আমার দলে চলে আসে এবং আমার পেছনে থেকে কাজ করে।

হযরত আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর ভাষ্যমতে, ‘‘প্রত্যেকেই অনুসরণীয় হতে চায়, তাহলে অনুসারী আসবে কোত্থেকে।’’ এজন্য নিজেকে মুক্তাদী (অনুসরণকারী) বানান। অনুসরণীয় সাজা থেকে বিরত থাকুন। অনুসারী হয়ে অন্যের সাথে মিলে কাজ করার মধ্যে শুরুতে ইখলাস থাকে এবং ধীরে ধীরে তা বাড়তেই থাকে। শুরু থেকে যদি ইখলাস না-ও থাকে, একপর্যায়ে ইখলাস সৃষ্টি হয়ে যায়। তাই দ্বীনের প্রতিটি সেবককে অন্যের সাথে মিলে ও পেছনে থেকে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া উচিত। এতে যদিও অন্তরে খুব কষ্ট লাগে কিন্তু এর মধ্যেই রয়েছে বরকত ও নিরাপত্তা। যে অন্যের সাথে মিলে কাজ করতে পারে সে দ্বীনের যে কোনো খাদেমের সহযোগী হয়ে থাকে, প্রতিপক্ষ হয় না।

হযরত আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর একটি বাণী আমাদের জন্য আলোকবর্তিকা।

‘‘দ্বীনের প্রতিটি কর্মীর সহযোগী হও, প্রতিবন্ধক নয়’’

আফসোস! মানুষ যখন নিজের ব্যক্তিগত নিমগ্নতা ও জীবিকার কাজে লেগে থাকে তখন অন্তরঙ্গতা ও ভালবাসার সাথে একে অপরের কাজে সহযোগী হয়। সেই লোকগুলোই যখন দ্বীনের কাজে যোগ দেয় তখন তৈরি হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিকতা। অথচ দ্বীন তাদের মাঝে মিলন সৃষ্টির জন্যই এসেছে। এ ব্যাপারে কুরআনে পাক ঘোষণা দিয়েছে-

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آَيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ

অর্থ : ‘‘আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখ এবং পরস্পরে বিভেদ করো না। আল্লাহ তোমাদের প্রতি যে অনুগ্রহ করেছেন তা স্মরণ রাখ, এক সময় তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে। অতপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহকে জুড়ে দিয়েছেন। ফলে তাঁর অনুগ্রহে তোমরা ভাই-ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুন্ডের প্রান্তে ছিলে। আল্লাহ তোমাদেরকে সেখান থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় নিদর্শনসমূহ সুস্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা সৎ পথ পেতে পার।’’-(সূরা আলে ইমরান- ১০৩)

কখনো কখনো কোনো মুখলিস ব্যক্তিও শিকার হয়ে যান এক ভ্রান্তির। দ্বীনের কোনো বিশেষ শাখায়, নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে, কোনো সংগঠন বা সংস্থার সাথে মিলে, অথবা কোনো বড় মুরববীর সম্মান ও ভালোবাসায় তার অধীনে কোনো একজন কাজ করছে। এখন এ কর্মীর মনে আগ্রহ জাগল, অন্য লোকেরাও যেন দ্বীনের ওই শাখায়, ওই সংগঠনের আওতায় কিংবা ওই শাইখের অধীনে কাজ করতে চলে আসে। একদিক থেকে এটা মানুষের স্বভাবজাত অনুভূতি। তবে এ আগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে যদি এ মনোভাবও সৃষ্টি হয় যে, অন্য মানুষ তার নিজস্ব দ্বীনী কাজ ছেড়ে দিক, অথবা সেই কাজ বাধাপ্রাপ্ত হোক, তাহলে সেটি সঠিক নয়। আর এটা সম্ভবও নয়।

ধরুন আপনি যদি মনে করেন আপনার পিতাকে যেহেতু আপনি পিতা মনে করেন তাই অন্যরাও নিজের পিতাকে বাদ দিয়ে আপনার পিতাকে পিতা হিসেবে গ্রহণ করবেন অথবা সকলেই নিজের মামাকে ছেড়ে আপনার মামাকে মামা বলে ডাকতে থাকবেন। এটাতো একটা ভুল চিন্তা।

আপনি দ্বীনের বিভিন্ন শাখায় ও মাধ্যমে দ্বীনের কোনো খাদেমকে সহযোগিতা করবেন এবং নিজের কাজে তার সহযোগিতাও কামনা করবেন, কিন্তু ঐ ব্যক্তিকে তার কাজ থেকে সরিয়ে নিজের কাজের সাথে যুক্ত করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। কারণ তিনি ওই কাজটির সাথে যুক্ত হয়েছেন অনেক চেষ্টা-সাধনার পর। দ্বীনের কাজের জন্য নিজের ব্যক্তিগত বিভিন্ন কাজের চাপের ভিতরে একটি তারতীব ঠিক করেছেন। আপনি যদি তাকে তার কাজ থেকে সরিয়ে দেন, তাহেল শয়তান এবং নফস তাকে সব ধরনের কাজ থেকেই সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবে।

এছাড়া এ তো জরুরি নয় যে, তার অবস্থা আপনার কর্মপদ্ধতির সাথে পুরোপুরি মিলে যাবে। বরং অধিকাংশ সময় এমন হয়, কেউ যে পদ্ধতিতে দ্বীনের কাজ করছে, যখন সেটাকে ছেড়ে দেয়, তখন অন্য ধারার কাজের সাথে নিজেকে আর মিলাতে পারে না। এমন অবস্থায় একুল-ওকুল উভয়ই ছুটে যায়।

একারণেই দ্বীনের কোনো খাদেম নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে লেগে থাকলে তাকে সে কাজ থেকে পৃথক করা কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়। তাকে তার কাজের সাথে লাগিয়ে রেখেই আপনি আপনার জন্য তার পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশা করতে পারেন। উত্তম পন্থা হল, আপনার কর্মতৎপরতা ও সংগঠনের সহযোগিতার জন্য এমন ব্যক্তিদেরই নির্বাচন করুন, যারা দ্বীনের কোনো শাখায়ই এখনও সম্পৃক্ত নয়। এধরনের লোকদেরকে দ্বীনী কাজের সাথে লাগিয়ে দেয়া হবে বড় ধরনের খেদমত।

প্রতিটি মানুষের মাঝে কিছু সৌন্দর্য ও সৌকর্ম থাকে, সাথে সাথে থাকে কিছু অপরিপক্কতা ও অক্ষমতাও। পাপ ও দুর্বলতা থেকে তো শুধু নবীরাই মুক্ত থাকেন। আমাদের মজলিসগুলোতে বসলেই পরস্পর বৈরিতার কারণে গীবতের চর্চা অবধারিত থাকে। এজন্য প্রয়োজন দ্বীনের প্রত্যেক কর্মীর অপর কর্মীর কাজকে স্বীকার করা। তাদের

অন্তরকে প্রশস্ত করা। এজন্য অন্যের দ্বারা অনুগৃহীত হওয়ার অনুভূতি প্রথমে নিজের দিক থেকে শুরু করতে হবে। এরপর কাজের সহযোগীদের মাঝে ধন্যবাদ দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। আর বাধা দিতে হবে অশোভন বাক্য ব্যবহার থেকে। এর ফলে পরস্পরের সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে। এতে জাতির গ্রহণযোগ্য একটি দলের যোগ্যতা সঠিক খাতে ব্যবহৃত হবে। এই মুমিনরাই সর্বশেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীর বাস্তব নমুনা হতে পারবেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘এক মুমিন অরেক মুমিনের জন্য দেয়ালের ইটের মতো, একে অন্যের শক্তি যোগাবে।’’

(বিশেষ দ্রষ্টব্য : উপরোল্লেখিত রচনাটি ‘আরমুগানে’র যে সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল সেই সংখ্যার শেষ পৃষ্ঠায় মুফাক্কিরে ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর বক্তব্যের নির্বাচিত একটি অংশও প্রকাশ করা হয়েছিল। বক্ষমান নিবন্ধ আর ওই বক্তব্যের অংশটুকুর বিষয়বস্ত্ত অভিন্ন হওয়ায় সেটিও এখানে সংযুক্ত করছি।)

পরস্পরের ঐক্য এবং একজন অপরজনকে নিজের সাথে মিলানো এবং কাছে টানার জন্য এখন পর্যন্ত কোনো বস্ত্ত দুনিয়াতে সৃষ্টি হয়নি। বরং ঐক্য ও ইত্তেবা এটা আল্লাহ পাকের খাছ তাওফিক ও বিশেষ পুরস্কার। যেমন : কুরআনে হাকীমে আল্লাহ তাআলা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেন,‘‘হে নবী! আপনি যদি পুরা দুনিয়ার সকল খাজানা খরচ করে দেন তাহলে ঐ সাহাবাদের অন্তরের ভালবাসা ও মহববত ঐক্য ও সম্প্রীতি তৈরি করতে পারবেন না। বরং আল্লাহ তাআলাই তার অনুগ্রহে তাদের অন্তরে ভালবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন।’’-সূরা আনফাল : ৬৩

বাহ্যত ঐক্যের উপলক্ষ হতে পারে কেবল ভীতির অনুভূতি। যখন ক্ষয়ক্ষতি ও ভীতির অনুভূতি জেগে উঠে মানুষ আপনা-আপনিই ঐক্যবদ্ধ হয়। আমরা যারা হিন্দুস্তানে আছি, পরস্পরে বিক্ষিপ্ততার শিকার হয়ে একে অপরের মাঝে ভুল বুঝা-বুঝি সৃষ্টি করছি, এর কারণ হল বিপদের আশংকা আমাদের মাঝে নেই।

আল্লাহর শোকর স্বভাবগতভাবে আমি নিরাশ নই। এই কঠিন যুগেও, মানুষ যখন ইসলাম ও মুসলমানকে বিপদের সম্মুখীন মনে করছে এবং হিন্দুস্তানেও স্পেনের মতো অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছে, আমি এমন মুহূর্তেও নিরাশ হইনি। কিন্তু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের ফলে আমার অনুভূতি এই যে, মুসলমানের অবস্থা শোচনীয় হতে চলেছে। অবস্থা তো এ পর্যায়ে চলে গেছে যে, যদি কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বা কোনো সংগঠনের সাথে অপর সংগঠনের বিরোধিতার বাস্তব মাত্রা থাকে একভাগ তাহলে সে বিরোধিতাটাই প্রকাশিত হচ্ছে শতভাগ ক্ষেত্রে।

 

আমরা এমন এক জাতি, উত্তম চরিত্রের এক মহান ইতিহাস যাদের আছে। এরপরও বিরোধের এ অবস্থাটি খুবই দুঃখজনক। সামষ্টিকভাবে পরস্পরে সহযোগিতার যোগ্যতা মুসলমানদের থেকে বিদায় নিতে যাচ্ছে। কাউকে একটু এগিয়ে যেতে দেখলে তার বিরুদ্ধে পুরো শক্তি ব্যয় করা আমাদের স্বভাবে পরিণত হয়ে গেছে। এমনও নয় যে, নীতিগতভাবে কঠোর ইখতিলাফ ও বিরোধ রয়েছে। বরং দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধকে মূল বিরোধ বানিয়ে ফাসাদ সৃষ্টি করার চেষ্টা হচ্ছে। পরিবেশ থেকে চক্ষু বন্ধ করে ফেলা এবং পরিস্থিতিকে অনুকূল করার চেষ্টা না করা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আমরা না অবস্থা বোঝার চেষ্টা করি, না দেশের দিকে খেয়াল করে কখনো একথা চিন্তা করি যে, দেশকে আমাদের কিছু দেওয়ার রয়েছে।

 

আমাদের অবস্থা একটি দ্বীপের মতো, বরং দ্বীপের মধ্যের ছোট্ট দ্বীপের মতো হয়ে গেছে। ইসলামী জাতি নিজেই একটি দ্বীপ। আবার এই দ্বীপের মধ্যে আরেকটি দ্বীপ সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান, প্রত্যেক দল, বরং প্রতিটি সংগঠন পৃথক পৃথক দ্বীপে পরিণত হয়েছে। আমার খুব ভয় হয়, এই দেশ ও দেশবাসীর কী হবে? এখন পর্যন্ত দিয়ানতদারী এবং নিষ্ঠার সাথে কোনো পক্ষ থেকে এ চেষ্টা করা হচ্ছে না, যাতে কোনো প্রতিষ্ঠান, জামাত, সংগঠন অথবা কোনো ব্যক্তির বাস্তব উপকারিতা ও তাদের গুণ ও মূল্য যথার্থ উপায়ে অনুধাবন করা যেতে পারে।

 

এখন পর্যন্ত এর কোনো চেষ্টাও করা হয়নি যে, বেশিরভাগ মানুষ বাস্তবিকভাবে আমাদেরকে বুঝতে পারে এবং আমাদের উপকারিতা ও প্রয়োজন অনুভব করতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পরস্পর মিলেমিশে দ্বীনের কাজ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

অনুবাদ : যুবায়ের আহমদ

Leave a Comment

Your email address will not be published.