পূর্ববর্তী অংশ:
সুদ কি ‘রিবা’ নয়? -১
রিবা আরবী শব্দ। যার মুজমা আলাইহি (সর্বজনবিদিত) ও মুতাওয়ারাছ (অনুসৃত) অর্থ রিবা সংক্রান্ত আয়াত ও হাদীসসমূহের তরজমা থেকেই স্পষ্ট। আর তা এই যে, ঋণের বিপরীতে মূলধনের অতিরিক্ত কোনো কিছুর শর্তারোপ করাই হল রিবার চুক্তি আর অতিরিক্ত বস্তু হচ্ছে রিবা। এতে ঋণের ধরন ও শর্তকৃত অর্থ কম-বেশি হওয়ার কোনো পার্থক্য নেই।
‘‘সুদ’’ ফার্সি, উর্দু ও বাংলা ভাষার শব্দ। এটি অর্থনীতির একটি পরিভাষাও বটে। এই তিন ভাষার মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করা হোক, তিন ভাষার নির্ভরযোগ্য অভিধানসমূহে সুদ-এর অর্থ খোঁজা হোক এবং অর্থনীতির পরিভাষাসমূহের সকল অভিধানগ্রন্থ অধ্যয়ন করা হোক, কোথাও পাওয়া যাবে না যে, সুদের অর্থ কস্ট অব ফান্ড বা কস্ট অব এডমিনিস্ট্রেশন। সুদ-এর অর্থ সবখানে এমনটিই পাওয়া যাবে যে, ‘‘ঋণ গ্রহণ বাবদ ঋণের পরিমাণের হিসাবে যে অতিরিক্ত লাভ বা অর্থ দেওয়া হয়।’’ তবে পুঁজিবাদের কোনো কোনো প্রবক্তা সুদ ‘অমানবিক’ নয় দাবি করে তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এমন ব্যাখ্যা (কস্ট অব ফান্ড…) পেশ করেছেন। কিন্তু এর দ্বারা তো কোনো বিষয়ের স্বরূপ পরিবর্তন হয়ে যায় না!
সুদ যদি রিবা না হয় তবে বাংলা ভাষায় রিবার নাম কী হবে- এই ভাইয়েরা কি তা বলে দিবেন?
আচ্ছা, কেউ যদি মনে করে, বাংলা ভাষার নিয়মে কিংবা পশ্চিমা নীতিতে, বহুল ব্যবহৃত কোনো শব্দ ও পরিভাষার প্রতিষ্ঠিত অর্থের বিকৃতি সাধন করা যায়, তাহলে এটা তার বিষয়। আমরা তো শুধু এতটুকু বলব যে, কুরআন-সুন্নাহ রিবাকে হারাম সাব্যস্ত করেছে। ইসলামে রিবা নিষিদ্ধ। আর রিবার অর্থ ও মর্মও নছ দ্বারা প্রমাণিত এবং তা প্রতিষ্ঠিত ও সর্বজনবিদিত। আর এর মধ্যে ব্যাংকের সুদ/ব্যবসার সুদও অন্তর্ভুক্ত। এজন্য নিঃসন্দেহে এটি ইসলামের নিষিদ্ধ রিবার শামিল। একে সুদ বলা না বলা তাদের মর্জি।
ভাষার ভিন্নতা কিংবা পরিভাষার বিভিন্নতার অপব্যবহার করে হারামকে হালাল সাব্যস্ত করা শুধু এই দেশ ও ভাষার লোকদের অপরাধ নয়। ইংরেজি ভাষার লোক, যারা সুদকে বৈধ করতে চান তারা বলেন রিবা ও ইন্টারেস্ট এক নয়। ‘ইউজারি’ রিবা হতে পারে কিন্তু ‘ইন্টারেস্ট’ রিবা নয়। আরবী ভাষারও কিছু এমন হতভাগা আছে যারা বলে, ‘ফায়েদা’ আর রিবা এক নয়। তবে মুসলিম উম্মাহর দ্বীনদার লোক আলহামদুলিল্লাহ এসব ধোঁকাবাজদের সম্পর্কে অবগত আছেন। এহেন হীলা-বাহানা শুধু সুদে কেন, যে কোনো হারামের জন্যই ব্যবহার করা হতে পারে। যেমন, ‘খমর’ হারাম কিন্তু বর্তমানের মদ তো খমর নয়। হিজাব ফরয কিন্তু পর্দা আর হিজাব এক নয় … ইত্যাদি। এমনিভাবে যার যেমন ইচ্ছা বলতে পারে। হীলা-বাহানা আবিষ্কার করে হারামের জন্য কোনো বৈধতার ছুতা বের করা নতুন কিছু নয়।
কস্ট অফ ফান্ড এবং কস্ট অফ এডমিনিস্ট্রেশন শব্দ ব্যবহার না করলেও তখনকার কাফেররা اِنَّمَا الْبَیْعُ مِثْلُ الرِّبٰوا (তরজমা : ব্যবসা রিবার মতোই) বলে হয়ত এমন দাবিই করতে চেয়েছিল। তারা বুঝাতে চেয়েছিল, ব্যবসায় যেমন মূলধন খাটিয়ে লাভ নেয়া হয় তেমনি রিবার ক্ষেত্রেও অর্থ ঋণ প্রদান করে তার ভাড়া হিসেবে লাভ নেয়া হয়। অর্থাৎ তারাও ঋণের অতিরিক্ত নেয়াকে ‘কস্ট অফ ফান্ড’ বলে দাবি করতে চেয়েছিল। বলা যায়, ভিন্ন শব্দে হলেও দেড় হাজার বছর পরে একই কথা উচ্চারিত হল।
সুদের পক্ষে যুক্তি পেশকারীরা এটাও বলে থাকে যে, এটি (সুদ) রিবার মত অমানবিক নয়; বরং তা মানবিক ও উপকারী। অথচ প্রচলিত পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত ব্যক্তি মাত্রই জানেন যে, সুদ তথা রিবা তখন যেভাবে অমানবিক ছিল এখনও সেভাবেই যুলুম ও অমানবিক। সে যুগেও তা সম্পদকে এককেন্দ্রিক বা কিছুলোক কেন্দ্রিক করে ফেলার জন্য দায়ী ছিল। বর্তমান সুদী ব্যবস্থাও একই দোষে অভিযুক্ত।
বৃটেনের অক্সফ্যাম ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা এ কথার পক্ষে সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। যাতে বলা হয়েছে, পুরো পৃথিবীর ৯৯% সম্পদ ভোগ করছে মাত্র ১% মানুষ। পক্ষান্তরে ৯৯% লোকের জন্য থাকছে মাত্র ১% সম্পদ। এটি সুদ ভিত্তিক অমানবিকতারই একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
তাছাড়া আল্লাহ তাআলার হারামকৃত কোনো বিষয় যদি কারো দৃষ্টিতে অমানবিক না-ও হয় তবুও তা শুধু এ জন্যই হারাম হবে যে, আল্লাহ তাআলা তা হারাম করেছেন। মুমিনের দৃষ্টিতে ঈমানই সবার আগে। ইসলামী বিধিনিষেধই তার কাছে বৈধ-অবৈধের মানদন্ড।
সুদের অসারতা নিয়ে অসংখ্য প্রামাণিক কিতাবাদি যুগে যুগে লেখা হয়েছে। আমরা এ প্রসঙ্গে সবিস্তার আলোচনার প্রয়োজন মনে করি না। শুধু একটি উদাহরণ পেশ করতে চাই। ব্যবসায়ী যখন ব্যাংক থেকে সুদী লোন নিয়ে ব্যবসায় লোকসান দেয় অথবা নিতান্তই কম পরিমাণে লাভ করে তখন কিন্তু ব্যাংক সে লোকসানের অংশীদার হয় না বা নিজের সুদের হারও কমিয়ে দেয় না। অর্থাৎ ঋণদাতা সর্বাবস্থায় সুদ নেয়াকে অনিবার্য মনে করে থাকে। ব্যাংগুলো তো এর উপরে অনেক ক্ষেত্রে আবার প্রসেসিং ফি নামেও মোটা অংকের টাকা নিয়ে থাকে। সুদ যদি হয়ে থাকে তাদের ভাষায় কস্ট অফ এডমিনিস্ট্রেশন তাহলে প্রসেসিং ফি’টা কী? সুদ যদি কস্ট (খরচ) হয়ে থাকে তাহলে কি ব্যাংকগুলো কখনো লাভ করে না? খরচ পরিমাণ টাকাই কি তবে ব্যাংকগুলো ঋণগ্রহীতা থেকে উঠিয়ে থাকে?
আমরা মুসলমানদের জন্য স্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, ইসলামে যে জিনিসগুলো হারাম তার মধ্যে সুদ নিকৃষ্টতম। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লাম-এর ভাষায় সুদগ্রহীতা, দাতা, এর লেখক ও সাক্ষীগণ সবাই অভিশপ্ত। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৮)
অতএব এ ধরনের কথায় বিভ্রান্তিতে না পড়ে সবারই কর্তব্য, নিজেদের ঈমান-আমলের হেফাযত করা।
আমরা আজকের আলোচনা রিবা ও সুদ পর্যন্তই সীমিত রাখলাম। প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকগুলো যথাযথভাবে শরীয়া অনুসরণ করে কি না, এগুলো ইসলামী অর্থনীতির আদর্শ নমুনা কি না- এসব বিষয়ে এ স্বল্প পরিসরে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম।
Pingback: সুদ কি ‘রিবা’ নয়? -১ - ইসলাম বার্তা